Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আলোহীন জাতীয় সড়ক যেন মৃত্যুফাঁদ

গুরুত্বপূর্ণ বহু সড়ক-সেতু দীর্ঘ দিন ধরে আলোহীন। প্রাণ হাতে যাতায়াত করতে হয় অসংখ্য মানুষকে। নিরাপত্তার অভাব প্রতি পদে। খোঁজ নিল আনন্দবাজার। আজ যশোর রোড নিয়ে সীমান্ত মৈত্রের প্রতিবেদন।দিনের আলোতেই এই সড়কে দুর্ঘটনার বিরাম নেই। আর রাতে আলোহীন সড়কে প্রতি মুহূর্তে বিপদের হাতছানি। কয়েক হাত অন্তর দু’পাশে প্রাচীন সব গাছ স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে। তার কোনওটা আবার নুয়ে পড়ে রাস্তার উপরে চলে এসেছে। রাস্তার কিছু দূর অন্তর অসংখ্য বাঁক। দিনের বেলাতেই বোঝা দায়, উল্টো দিক থেকে গাড়ি আসছে কিনা।

রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি। যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

রাস্তার দু’পাশে গাছের সারি। যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।

শেষ আপডেট: ১১ জুন ২০১৫ ০০:৫০
Share: Save:

দিনের আলোতেই এই সড়কে দুর্ঘটনার বিরাম নেই। আর রাতে আলোহীন সড়কে প্রতি মুহূর্তে বিপদের হাতছানি। কয়েক হাত অন্তর দু’পাশে প্রাচীন সব গাছ স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে। তার কোনওটা আবার নুয়ে পড়ে রাস্তার উপরে চলে এসেছে। রাস্তার কিছু দূর অন্তর অসংখ্য বাঁক। দিনের বেলাতেই বোঝা দায়, উল্টো দিক থেকে গাড়ি আসছে কিনা। গাছ এড়াতে যান চালকেরা রাস্তার এক পাশে সরে এসে গাড়ি নিয়ে যেতে বাধ্য হন। সব মিলিয়ে রাতে চালকদের ঝুঁকি খুবই বেড়ে যায় বারাসত থেকে বনগাঁ ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়ক যশোর রোডে। পথচারীদেরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা পুরোদস্তুর।

বারাসতের পর থেকে বনগাঁর পেট্রাপোল সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তাটি প্রায় ৬০ কিলোমিটার। বেশির ভাগ অংশই কার্যত আলোহীন। বাজার এলাকাগুলি বাদ দিলে পুরো রাস্তা গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। ওই রাস্তাতেই পেট্রাপোল থেকে যাতায়াত করে অসংখ্য পণ্যবাহী ভারি ট্রাক। তাদের বড় হেড লাইটের আলো সরে গেলেই সড়ক ঢেকে যায় অন্ধকারে। পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে যাঁরা যাতায়াত করেন, তাঁদের প্রাণ হাতে যাতায়াত করতে হয়।

বাজার এলাকাগুলিতেও পর্যাপ্ত আলো রয়েছে, এমন ভাবাটাও ভুল। সন্ধ্যা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা থাকা পর্যন্ত যশোর রোড যতটা আলোকিত থাকে, দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলে ওই আলো আরও ক্ষীণ হয়ে আসে।

মঙ্গলবার মাঝ রাতে বিড়া চৌমাথা এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, দোকানপাট সব বন্ধ। স্বাভাবিক ভাবেই দোকানের আলো নিভে গিয়েছে। আলোকস্তম্ভে দু’টি হ্যালোজেন যশোর রোডে মিটমিট করে আলো ছড়াচ্ছে।

বিড়া চৌমাথা ছাড়িয়ে গুমার দিকে এগোতেই চোখে পড়ল অন্ধকারের মধ্যে যশোর রোড দখল করে দু’পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি ট্রাক। সড়কের উপরে কয়েকটি জায়গায় দেখা গেল বালি-খোয়ার স্তূপ। যানবাহনের হেড লাইটের আলো ছাড়া দু’হাত দূরের কোনও কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সড়কের দু’ধারে কলাবাগান ও বন জঙ্গল। দূরে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। দেখা গেল, কোনও কোনও ট্রাকের একটি মাত্র হেড লাইট জ্বলছে। কিছুটা দূর থেকে বোঝা সম্ভবই নয়, সেটি ট্রাক না অন্য ছোট কোনও গাড়ি। এ বাবে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ে বলাইবাহুল্য। বেশির গাড়ির ক্ষেত্রে দেখা গেল, উল্টো দিকের গাড়িকে ‘ডিপার’ করে সঙ্কেত পাঠানোর ধার ধারে না কেউ। বড় গাড়ির আলো ছোট গাড়ির চালকদের মুখে সরাসারি এসে পড়ছে। চোখ ধাঁধিয়ে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ায়।

চারিদিকে অন্ধকার থাকায় রাস্তায় পাশে কতটা জায়গা আছে, তীব্র গতিতে গাড়ি চালানো সময়ে বোঝা মুশকিল। অনেক ক্ষেত্রেই চালকেরা সড়কের পাশে থাকা গাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মারেন। এক ট্রাক চালকের বক্তব্য, ‘‘আলো তো নেই, তাই অনেকটাই নিজেদের অভিজ্ঞতা ও অনুমানের উপরে ভরসা করে এই রাস্তায় গাড়ি চালাতে হয়। প্রচুর গাছ ও বাঁকের জন্য একেক জায়গায় কিছুই দেখা যায় না।’’ শীতের সময়ে ঘন কুয়াশার মধ্যে সমস্যা আরও বাড়ে। গাড়ির গতি কম পেরোতে হয় গোটা পথ। তাতে সময়ও লাগে অনেক বেশি।

যশোর রোডে আলো বসানোর কোনও নির্দেশ আমাদের দফতর দেয়নি। ফলে এই মুহূর্তে এমন পরিকল্পনাও নেই।

জয়ন্ত চক্রবর্তী (আধিকারিক, জাতীয় সড়ক)

রাতের বেলা নিজেদের অভিজ্ঞতা ও অনুমানের
ভরসায় গাড়ি চালাতে হয় এই রাস্তায়।

বারাসত থেকে বনগাঁগামী এক ট্রাক চালক।

বিপদ এড়াতে গাছে এক সময়ে গাছের গায়ে লাল ‘রিফ্লেক্টর’ বসানো হয়েছিল। গাড়ির আলো পড়লে বোঝা যেত। কিন্তু সেগুলির বেশির ভাগই এখন অকেজো। তা ছাড়া, সর্বত্র রিফ্লেক্টর নেই। গাইঘাটা থানা এলাকার কিছু গাছে দেখা গেল।

গুমা চৌমাথায় দেখা গেল, দু’টি হ্যালোজেন জ্বলছে। বিড়া চৌমাথা থেকে গুমা চৌমাথা এলাকার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। ওই পথে সড়কের আশপাশে বাড়িঘর তেমন নেই। অনেকটা এলাকা জুড়েই খোলা মাঠ। পথচারী, বাইক আরোহী সাইকেল আরোহী ও অন্য যানচালকেরা ওই পথে যাতায়াত করেন সাবধানে। অতীতে দুষ্কৃতীদের কাছে জায়গাটি ছিল কার্যত ‘স্বর্গরাজ্য’। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে চুরি-ছিনতাই লেগেই থাকত। স্বাভাবিক ভাবেই সে কথা যাঁরা জানেন, ওই পথটুকু দ্রুতগতিতে পেরনোর চেষ্টা করেন। গুমা চৌমাথা থেকে অশোকনগরের দিকে আসার বেশ কিছুটা পথও আলোহীন। চোখের সামনে এক ট্রাক চালক একটি কুকুরকে পিষে দিয়ে চলে গেলেন।

অশোকনগর থানার খোশদেলপুর এলাকা থেকে যশোর রোডে আলো দেখা গেল। ওই এলাকা থেকে হাবরার চোংদা মোড় পর্যন্ত প্রায় দশ কিলোমিটার পথে কম-বেশি আলো আছে। ওই এ‌লাকাটুকু আশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভা এবং হাবরা পুরসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। স্থানীয় পুর প্রশাসন এবং বিধায়ক সাংসদদের তহবিলের আর্থিক সহযোগিতায় সড়কের পাশে আলো বসেছে। কিন্তু গ্রামীণ এলাকার হাল ফেরেনি। খোশদেলপুর এলাকায় দেখা গেল, সড়কের পাশে ত্রিফলা বসানো হয়েছে বিল্ডিং মোড় পর্যন্ত। হাবরা শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকায় একটি বড় হাইমাক্স টাওয়ার বসানো হয়েছে। হাবরা-বিডিও অফিস পাশের শ্রী চৈতন্য কলেজে আলো জ্বলছে। সেই আলো যশোর রোডে এসে পড়ছে।

কিন্তু হাবরার চোংদা মোড়ের পর থেকে ফের সড়ক আলোহীন। গাইঘাটার কলাসীমা বাজার ধর্মপুর বাজারে কিছু আলো আছে। ধর্মপুর বাজারের পর থেকে জলেশ্বর মোড় পর্যন্ত কোনও আলোর চিহ্ন নেই। জলেশ্বর মোড়ের আগে যশোর রোড গিয়েছে দু’পাশে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। জলেশ্বর মোড় এলাকায় অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে অতীতে মোটর বাইক ছিনতাইয়ের বহু ঘটনা ঘটেছে। তবুও আলো বসেনি রাস্তায়। গাইঘাটায় বাজার এলাকায় দেখা গেল, বেশ কিছু ত্রিফলা বসানো। কিন্তু বেশির ভাগই জ্বলে না। একই অবস্থা গাইঘাটা থানার মোড় এলাকাতেও। বকচরা বাজারেও ত্রিফলা থাকলেও জ্বলতে দেখা গেল না। চাঁদপাড়া বাজারে আলো আছে। কিন্তু দোগাছিয়া কালুপুর বাজারে কোনও আলো নেই। বনগাঁ শহরে যশোর রোডে আলো আছে। কিন্তু শহর ছাড়িয়ে গ্রামীণ এলাকায় ঢুলকেই ফের আঁধার পথ। জয়ন্তীপুর জামতলা এলাকায় দেখা গেল, যুবকেরা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছে। নম্বরপ্লেটহীন বেশ কিছু মোটর বাইকও চোখে পড়ল নানা এলাকায়। বাংলাদেশ থেকে দুষ্কৃতীরা রাতে ওই সব এলাকায় মাঝে মধ্যেই এসে জড়ো হয়। খবর পেয়ে পুলিশ অভিযানে গেলে তারা অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে যায়।

যশোর রোডে আলো না থাকায় পুলিশের কাজেও অসুবিধা হচ্ছে। বনগাঁর এসডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো বলেন, ‘‘আমরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তল্লাশি (নাকা) করতে পারি না কারণ, তা হলে ট্রাক এসে পুলিশ কর্মীদের ধাক্কা মারতে পারে। নিজেদের নিরাপত্তার দিকটাও মাথায় রাখতে হয়। কিন্তু দুষ্কৃতীরাও অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে।’’

হারবা-১ পঞ্চায়েত সমিতি ও গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির এলাকার মধ্যে যশোর রোডের একটা বড় অংশ পড়ে। আলোর ব্যবস্থা করতে তাঁরা কী পদক্ষেপ করেছেন?

হাবরা-১ পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, ‘‘স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত সমিতির এলাকাতেও যশোর রোডে এলইডি আলো বসানো হবে।’’ গাইঘাটা পঞ্চায়েত সমিতির সহ সভাপতি ধ্যানেশনারায়ণ গুহ জানিয়েছেন, পঞ্চায়েত সমিতির এলাকার মধ্যে যশোর রোডের উপরে বাজারগুলিতে আলো বসানো হয়েছে। তবে আলো বসানোর মতো আর্থিক পরিকাঠামো আমাদের নেই।’’

কী বলছে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ?

তাদের বক্তব্য, যশোর রোডটা কোনও এক সময়ে পূর্ত দফতরের অধীনে ছিল। পরে জাতীয় সড়কে পরিবর্তিত করা হয়েছে। ফলে একটি জাতীয় সড়ক তৈরির সময়ে যে পরিকাঠামো গড়ে ওঠে, যশোর রোডের ক্ষেত্রে তা হয়নি। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের বনগাঁ মহকুমার আধিকারিক জয়ন্ত চক্রবর্তী বলেন, ‘‘যশোর রোডে আলো বসানোর কোনও নির্দেশ আমাদের দফতর দেয়নি। ফলে এই মুহূর্তে আমাদের তরফে আলো বসানোর কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে স্থানীয় ভাবে পুরসভা, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি আলো বসাচ্ছে। আমরা অনুমতিও দিচ্ছি।’’ জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে অবশ্য সামগ্রিক ভাবে এ নিয়ে কোনও ভাবনা-চিন্তা করা হয়নি বলে জানিয়েছেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি রহিমা মণ্ডল।

সব মিলিয়ে রাতের যশোর রোডে যাতায়াতের আশঙ্কা কাটার কোনও আশু সম্ভাবনাই নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

National Highway Barasat road Ashok Nagar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE