Advertisement
১০ মে ২০২৪

পারলেন না সিব্বলও, মন্ত্রিত্ব ছাড়ার শর্তেও মিলল না জামিন

লড়ার জন্য দিল্লি থেকে চার্টার্ড বিমানে উড়িয়ে আনা হয়েছিল নামজাদা আইনজীবীকে। আদালতে জামিন-যুদ্ধ উতরোতে যিনি কিনা মক্কেলের মন্ত্রিত্বকে বাজি রাখতেও কসুর করলেন না! কিন্তু প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বলের সেই সওয়ালও বৃথা গেল। তাঁর মক্কেল, অর্থাৎ রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদনগোপাল মিত্রের বন্দিদশা কাটল না। বৃহস্পতিবার আড়াই ঘণ্টা শুনানির পরে সারদা-কেলেঙ্কারিতে ধৃত মদনবাবুর জামিন-আর্জি খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৩
Share: Save:

লড়ার জন্য দিল্লি থেকে চার্টার্ড বিমানে উড়িয়ে আনা হয়েছিল নামজাদা আইনজীবীকে। আদালতে জামিন-যুদ্ধ উতরোতে যিনি কিনা মক্কেলের মন্ত্রিত্বকে বাজি রাখতেও কসুর করলেন না!

কিন্তু প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বলের সেই সওয়ালও বৃথা গেল। তাঁর মক্কেল, অর্থাৎ রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদনগোপাল মিত্রের বন্দিদশা কাটল না। বৃহস্পতিবার আড়াই ঘণ্টা শুনানির পরে সারদা-কেলেঙ্কারিতে ধৃত মদনবাবুর জামিন-আর্জি খারিজ করে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি আশা অরোরার ডিভিশন বেঞ্চের যুক্তি— অভিযুক্ত এক জন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থেই জামিনের আবেদন নাকচ করা হচ্ছে।

সারদা-কাণ্ডে সিবিআই মদনবাবুকে গ্রেফতার করেছিল ২০১৪-র ১২ ডিসেম্বর। জেল হেফাজতে এই আট মাসের সিংহভাগটা অবশ্য এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডেই কাটিয়েছেন মন্ত্রী। ইতিমধ্যে নিম্ন আদালতে বারবার তাঁর জামিন-আর্জি নাকচ হয়েছে। এ দিন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চেও তা-ই হওয়ার পরে মন্ত্রী শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন। মদনবাবু নিজে এ দিন কোর্টে ছিলেন না। হাসপাতালে বসে খবর পেয়ে তিনি দৃশ্যতই হতাশ হয়ে পড়েন। পোড়খাওয়া নেতা পরে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, ‘‘আশা ছাড়ছি না। সুবিচার পেতে দরকারে সুপ্রিম কোর্টে যাব।’’

সিবিআই-কৌঁসুলিরা বারবার বিভিন্ন আদালতে দাবি করে আসছেন যে, মন্ত্রী মদন মিত্র যারপরনাই ‘প্রভাবশালী।’ যে তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে এ দিন সওয়াল শুরু করেছিলেন সিব্বল। যুক্তি দিয়েছিলেন, মদনবাবু মন্ত্রী থাকাকালীনই গ্রেফতার হয়েছেন। ‘‘তা হলে উনি প্রভাবশালী হলেন কী করে?’’— প্রশ্ন তোলেন সিব্বল। আদালতকে তিনি এ-ও জানান, জামিন পেলে তাঁর মক্কেল মন্ত্রিত্ব ছাড়তে তৈরি। সিবিআইয়ের পাল্টা সওয়ালে বলা হয়: মদন মিত্র চরম স্তর পর্যন্ত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। ‘মন্ত্রীর প্রতিপত্তি এতটাই যে, তাঁর সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার রিপোর্ট দিতে জেলও ডরায়।’’— উদাহরণ দেন কেন্দ্রীয় ব্যুরোর আইনজীবীরা।

এমতাবস্থায় বিচারবিভাগীয় হেফাজত থেকে মদন মিত্রকে ছাড়া উচিত হবে না বলে সিবিআই দাবি করে। মদনের ‘প্রভাবের’ দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে সিবিআই-কৌঁসুলি কে রাঘবচারুলু বেঞ্চকে বলেন, ‘‘উনি গ্রেফতার হওয়ার আগে এক জন এজেন্ট বা আমানতকারীও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে গোপন বয়ান দিতে রাজি হননি। অথচ মন্ত্রী গ্রেফতার হতেই তাঁরা একে একে বয়ান দিচ্ছেন!’’ সিবিআইয়ের আশঙ্কা, তদন্তের এই মাঝ পথে মদন মিত্র ছাড়া পেলে ওঁরা আর মুখই খুলবেন না। প্রভাব প্রসঙ্গে মন্ত্রীর গত ছ’মাসের ‘ঠিকানা’র কথাও উল্লেখ করেন সিবিআইয়ের আইনজীবী। কী রকম?

মদনবাবু গত ডিসেম্বরে গ্রেফতার হয়ে দিন পনেরো জেলে কাটিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সপ্তাহ দুয়েক বাদে তিনি জেলে ফিরলেও বেশি দিন থাকেননি। গত ফেব্রুয়ারিতে আবার অসুস্থ হয়ে এসএসকেএমের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হন। তখন থেকে ওটাই তাঁর ঠিকানা। শুধু মাসখানেক আগে কেবিন নম্বরটি বদলেছে। ‘‘মদন মিত্র ফেব্রুয়ারি থেকে উডবার্ন ওয়ার্ড আটকে বসে আছেন। যাবতীয় সুযোগ-সুবিধে ভোগ করছেন।’’— মন্তব্য রাঘবচারুলুর। তাঁর আরও আক্ষেপ, ‘‘মদন মিত্র বিচার বিভাগকেও সম্মান দেন না। ওঁর নামে চার্জশিট পেশ হওয়া ইস্তক একটি বারের জন্যও ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে আসেননি!’’

বিচারপতি মাত্রে জানতে চান, ‘‘প্রায় ছ’মাস ধরে উনি (মদন মিত্র) হাসপাতালে রয়েছেন! কী হয়েছে?’’ রাঘবচারুলুর জবাব, ‘‘কেউ জানে না! রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত।’’

পাল্টা হিসেবে সিব্বল তাঁর মক্কেলের মেডিক্যাল রিপোর্ট পেশ করে দাবি করেন, মদনবাবু যথেষ্ট অসুস্থ। ‘‘না হলে সিবিআই কেন ওঁকে জেলে ফেরতের আর্জি জানাচ্ছে না?’’— প্রশ্ন ছুড়ে দেন মদনবাবুর কৌঁসুলি। তাঁর কথায়, ‘‘এর আগে কোর্টে যখন মদন মিত্রের মেডিক্যাল রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে, তখনও তো সিবিআই প্রতিবাদ করেনি!’’

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

অন্য দিকে সারদার কর্মকাণ্ডে মদন মিত্র-সহ রাজ্যের শাসকদলের বিভিন্ন নেতার ‘ভূমিকা’ উল্লেখ করেন রাঘবচারুলু। কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘এখন বাংলায় একটা প্রবাদ চালু হয়েছে— লাগে টাকা, দেবে সুদীপ্ত সেন।’’ তাঁর বক্তব্য, ২০১১-র পরে পশ্চিমবঙ্গে চারটে অবৈধ অর্থলগ্নি সংস্থার রমরমা হয়েছে— সারদা, রোজ ভ্যালি, এমপিএস এবং আইকোরের। রোজ ভ্যালির সঙ্গেও পরিবহণমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সংশ্রব ছিল বলে সিবিআই-কৌঁসুলি দাবি করলে বিচারপতি মাত্রে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন, রোজ ভ্যালির সঙ্গে এ দিনের জামিন-মামলার সম্পর্ক নেই।

এর পরে সারদার সঙ্গে মদনবাবুর ‘মাখামাখি’র উল্লেখ করে সিবিআই-কৌঁসুলি বলেন, ‘‘উনি দাবি করেছেন, অনেক আগেই সারদা কর্মী ইউনিয়নের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন। আসলে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছাড়েননি।’’ রাঘবচারুলুর পর্যবেক্ষণ, অন্তত দু’শোটি কোম্পানির ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হওয়ার সুবাদেও মদনবাবু বিলক্ষণ প্রভাব বিস্তার করেছেন। তাই জনস্বার্থেই ওঁকে বিচারবিভাগীয় হেফাজতে রাখার জন্য তিনি আদালতকে আবেদন জানান।

প্রসঙ্গত, গত আট মাসে মদনবাবু একাধিক বার জামিন চেয়েছেন। তবে সে সব মামলা হয়েছে নিম্ন আদালতে। হাইকোর্টে এটাই ছিল তাঁর জামিন-আর্জির প্রথম শুনানি। আগে মদনবাবু হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করলেও একাধিক বিচারপতি মামলা শুনতে চাননি। ফলে গত এপ্রিলে তিনি হাইকোর্ট থেকে আর্জি ফিরিয়ে আবার নিম্ন আদালতে যান। কিন্তু গত জুনে আলিপুর কোর্টে আর্জি নাকচের পরে ফের দ্বারস্থ হয়েছিলেন হাইকোর্টের।

এখানেও শেষরক্ষা হল না। দু’পক্ষে যুক্তি-তর্কের লড়াই শেষে পরিবহণমন্ত্রীর জামিনের আর্জি এ দিন খারিজ করে দেয় বেঞ্চ। ‘হাই প্রোফাইল’ মামলাটিতে দুই দুঁদে আইনজীবীর সওয়াল-জবাব শুনতে আইনজীবী মহলে ছিল বিপুল উৎসাহ। সতেরো নম্বর ঘরের এজলাসে প্রচুর আইনজীবী এসে ভিড় করেন। ভিড়ের চোটে মাঝে কিছুক্ষণ শুনানি স্থগিতও রাখতে হয়। উপরন্তু সকাল থেকে হাইকোর্ট চত্বরে লোক জমেছিল চোখে পড়ার মতো। যাঁদের মধ্যে ছিলেন মদন-অনুগামীরাও।

এবং কপিল সিব্বলের মতো নামী আইনজীবী তাঁদের নেতাকে বার করে আনতে পারবেন বলে ওঁদের অনেকে আশায় বুক বেঁধেছিলেন। ক’দিন আগে আলিপুর কোর্টে মদনের জামিনের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামোল্লেখ করে বিতর্কে জড়ান আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হন, মদন পড়েন বিড়ম্বনায়। দলীয় সূত্রের খবর: এ বার মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই জামিন-মামলা লড়ার জন্য মদন শিবির উড়িয়ে এনেছিল সিব্বলকে, যিনি আগে মমতা-সরকারের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়েছেন।

সেই সিব্বলের সওয়ালও ব্যর্থ হওয়ায় মদন শিবির ম্রিয়মান। নেতার মুখে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার আভাসেও হতাশা বিশেষ কাটছে না। বস্তুত হাইকোর্টের আইনজীবীদের অনেকের মতে, জেল এড়িয়ে হাসপাতালে থাকাটাই মদনবাবুর বিরুদ্ধে গিয়েছে। ‘‘বেঞ্চের বুঝতে দেরি হয়নি যে, প্রভাব খাটিয়েই উনি টানা ছ’মাস উডবার্নে রাজার হালে রয়েছেন।’’— মন্তব্য এক আইনজীবীর। এই মহলের অভিমত, জামিন-আর্জি খারিজ করার পিছনে যে কারণ এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ দেখিয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে অন্য আদালত থেকেও জামিন পেতে সমস্যায় পড়তে পারেন মন্ত্রী মদনগোপাল মিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE