চার মাসের ব্যবধানে বদলে গেল অনুব্রত মণ্ডলের সুর।—ফাইল চিত্র।
চার মাসের ব্যবধানে বদলে গেল সুর!
এলাকায় অশান্তি ছড়ানোর জন্য নভেম্বরে দলের যে নেতাকে গ্রেফতার করানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি, মার্চে লোকসভা নির্বাচনের মুখে সেই নেতাকেই জামিনে মুক্ত করিয়ে আনার নির্দেশ দিলেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল! নেতার নাম উজ্জ্বল হক কাদেরি। তিনি খয়রাশোল ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন কার্যকরী সভাপতি এবং খয়রাশোলের ব্লক তৃণমূল সভাপতি দীপক ঘোষ খুনের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত।
বীরভূম ও বোলপুর, দুই লোকসভা আসনের প্রার্থী শতাব্দী রায় ও অসিত মালকে জেতাতে কী কৌশল নেওয়া হবে, দলের নেতা-কর্মীদের দায়িত্বই বা কী হবে— সেটা নিয়ে আলোচনার রবিবার সিউড়ি রবীন্দ্র সদনে জেলা কমিটির বৈঠক ডেকেছিলেন অনুব্রত। দুই প্রার্থী ও দলের সব স্তরের নেতাদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে অনুব্রত বীরভূম জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর তথা জেলা তৃণমূল সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলেন, “মলয়, উজ্জ্বলের জামিন করিয়ে দাও।’’
মলয়বাবু অবশ্য রাতে বলেন, ‘‘কোন মলয়কে উনি বলেছেন, বলতে পারব না। তবে, ওই মামলার সরকারি আইনজীবী আমি নই।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গত বছর ২১ অক্টোবর খয়রাশোল ঘেঁষা হিংলো নদীর বালির উপরে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কতীদের গুলিতে খুন হন দীপক ঘোষ। প্রথম থেকেই অনুব্রত মণ্ডল এই খুনের জন্য বিজেপি-কে দায়ী করলেও নিহতের পরিবারের লিখিত অভিযোগে খয়রাশোলে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সমীকরণই সামনে আসে। দীপকের পরিবার ও অনুগামীদের বক্তব্য ছিল, ঘটনার পিছনে হাত রয়েছে দলেরই বিপক্ষ গোষ্ঠীর। তাঁরা উজ্জ্বল হক কাদেরির নামেও অভিযোগ তোলেন সে সময়। পরে নিহত নেতার স্ত্রী পুলিশের কাছে যে লিখিত অভিযোগ করেন, তাতে নাম থাকা ১৫ জনের মধ্যে ১৪ জনই এলাকায় সক্রিয় তৃণমূল কর্মী হিসাবে পরিচিত। তবে, ওই এফআইআরে উজ্জ্বলের নাম ছিল না। পুলিশ মাত্র পাঁচ জনকে ধরে। তাঁদের এক জনই দীপক-বিরোধী শিবিরের।
উজ্জ্বল হক কাদেরি-সহ বাকি অভিযুক্তদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এই প্রশ্নে খয়রাশোলে ক্ষোভ বাড়ছিল দীপক-গোষ্ঠীর ভিতরে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে ফের অশান্তি শুরু হয়েছিল খয়রাশোলে। এর পরেই গত বছর নভেম্বরে বোলপুরের একটি কর্মিসভায় উজ্জ্বলকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন অনুব্রত। এ-ও বলেন, ‘‘ওখানকার বোম মারার নায়ক উজ্জ্বল কাদেরি!’
চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি উজ্জ্বলকে পুলিশ গ্রেফতার করে। উজ্জ্বল নিজেকে বরাবর নির্দোষ দাবি করলেও, জেলা পুলিশ সুপার শ্যাম সিংহ সেই সময় জানিয়েছিলেন, দীপক ঘোষ খুনের ঘটনাতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ছাড়া কাঁকরতলায় আরও একটি ঘটনায় তিনি অভিযুক্ত। উজ্জ্বল এখন রয়েছেন সিউড়ি জেলা সংশোধনাগারে। পুলিশ সূত্রেই খবর, এর আগে দু’বার উজ্জ্বলের জামিনের আবেদন খারিজ হয়েছে।
সেই নেতাকেই এ দিন জামিনে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন অনুব্রত! ওই নির্দেশ ঘিরে চর্চা তৃণমূলের অন্দরে। দীপক ঘোষের অনুগামীদের প্রশ্ন, খুনের অভিযোগে জানুয়ারিতে গ্রেফতার হওয়া নেতাকে কী ভাবে এত তাড়াতাড়ি জামিন করানো যায়? তাঁদের দাবি, ভোটের আগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চাপা দেওয়ার কৌশল ছাড়া এটা কিছুই নয়। দিন কয়েক আগে খয়রাশোলের কর্মিসভায় গিয়ে একই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অনুব্রত। তাঁর নির্দেশ ছিল, ‘‘সকলে মিলে চুলন। কথা বলে নিজেদের মধ্যে সমস্যা মিটিয়ে নিন। একটা খুনও যেন খয়রাশোলের বুকে আর না হয়।’’ এই অবস্থায় দলের কেউ কেউ বলছেন, ভোটের আগে খয়রাশোলে উজ্জ্বলের প্রভাবকে কাজে লাগানোই দলের উদ্দেশ্য। কিন্তু, এতে হিতে বিপরীত হতে পারেও বলেও আশঙ্কা করছেন নিচুতলার কর্মীদের একাংশ।
অনুব্রতের নির্দেশকে কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না বিরোধীরাও। বিজেপির জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় বলছেন, ‘‘গণতন্ত্র, আইনকানুন কিছুরই তোয়াক্কা করে না শাসকদল। জেলা সভাপতির এমন নির্দেশের পর আইনে কী ভাবে মানুষ ভরসা রাখবে, সেটাই প্রশ্ন। আমি আগেই বলেছিলেন, খুনে অভিযুক্ত ওই নেতাকে গ্রেফতার আসলে নাটক। সেটাই এখন প্রমাণিত হল।’’ সিপিএমের জেলা সভাপতি মনসা হাঁসদা বলেন, ‘‘গণতন্ত্র, বিচার ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে তৃণমূল। এর আগেও বিভিন্ন ঘটনায় অভিযুক্তদের তালিকায় এক নম্বরে থাকা তৃণমূলের অনেক নেতার নাম বাদ দিতে দেখা গিয়েছে। আসলে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে যে কোনও অনৈতিক কাজ যে ওরা করতে পারে, এটা তারই নমুনা।’’
অভিযোগ উড়িয়ে অনুব্রতের দাবি, ‘‘উজ্জ্বল জামিন পেতেই পারে। আইন আইনের পথে চলবে। তাই বলেছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy