উদ্যোগ: হিঙ্গলগঞ্জের কনকনগর এস ডি ইনস্টিটিউশনের ছাত্রীদের শারীরচর্চার সুযোগ করে দিতে তৈরি হয়েছে ফুটবল দল। নিজস্ব চিত্র
পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে আলিয়ার গাজি। কিন্তু অধিকাংশ দিনই তার স্কুল কামাই। মাঝেমধ্যে যে দিন আসে, ক্লাস টিচার পড়া জিজ্ঞেস করলেই ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। ব্ল্যাকবোর্ডে তাকে নানা ভাবে পড়া বোঝানোর চেষ্টা চলে। কিন্তু ক্লাসে টুঁ শব্দও করে না সে। খাতায় এলোমেলো আঁকিবুঁকি ছাড়া আর কোনও অক্ষর পাওয়া যায় না আলিয়ারদের খাতায়। “এই সব ছেলেমেয়েদের কী পড়াব!”— অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংয়ে প্রায়ই এমন বলে থাকেন হতাশ শিক্ষকেরা।
সপ্তম শ্রেণির জ্যোতির্ময়। নিচু ক্লাসে তবু পড়াশোনা করত। কিন্তু যত উঁচু ক্লাসে উঠেছে, ততই ওর ‘জ্যোতি’ ম্লান হয়েছে। জ্যোতির্ময়ের অভিভাবককেও ডাকা হয়েছে স্কুলে। প্রতিটি বিষয়ে ছেলের পড়াশোনার হাল শুনে তিনি একটাই উত্তর দিতে পেরেছেন, “প্রাইভেটে তো দিয়েছি স্যর!”
পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েও নিজের নাম ঠিকঠাক লিখতে পারে না, এমন বহু পড়ুয়া এ রাজ্যের নানা সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে আছে। ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট’ (এএসইআর) বা ‘প্রথম’ নামক সংস্থাগুলির দেশজোড়া রিপোর্টে ছাত্রছাত্রীদের এই ‘না-পারা’টাই প্রকাশিত হয়। কিন্তু ‘না-পারার’ কারণগুলি নিয়ে স্কুলে-স্কুলে ইতিবাচক চর্চার অবকাশটা তৈরি হয় না। ভোট আসে যায়, সরকার থাকে বা যায়, আমাদের দেশ ও রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায় বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও বা শিক্ষাশ্রী-কন্যাশ্রী-সবুজ সাথীর মতো সরকারি প্রকল্পের পরেও আলিয়ার-জ্যোতির্ময়দের ‘জ্যোতি’ ধারাবাহিক ভাবে কমতে থাকে! খাতায়-কলমে ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি বাড়লেও শ্রেণিকক্ষে তাদের নিয়মিত উপস্থিতি চোখে পড়ে না।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
স্কুলগুলিতে বিশেষ মূল্যায়ন বা প্রজেক্ট জমা দেওয়ার দিন ছাত্রছাত্রী বেশি আসলেও বিপদ। বসার জায়গার অভাব। একটি ছয় ফুট লম্বা বেঞ্চে পাঁচ-ছ’জন করে পড়ুয়া বসতে বাধ্য হয় তখন। আট থেকে দশ ইঞ্চি চওড়া বসার বেঞ্চে পাঁচ ঘণ্টা গুমোট গরমে বসে থাকাটাই যেখানে অস্বাস্থ্যকর, সেখানে পড়াশোনার গুণগত মান কী ভাবে বেঁচেবর্তে থাকতে পারে!
হিঙ্গলগঞ্জের আদিবাসী অধ্যুষিত নবীনগঞ্জ এফপি স্কুলে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। ছোট্ট ক্লাসঘরে প্রধান শিক্ষক অফিসের কাজ করছেন। সেই ঘরেই প্রথম শ্রেণির পঠনপাঠন চলছে। মেঝেতে বসে জনা পনেরো ছাত্রছাত্রী। জিজ্ঞাসা করলাম, “ওরা নীচে বসে কেন?” প্রধান শিক্ষক বললেন, “ওরা প্রি-প্রাইমারিতে পড়ে। ওদের জন্য ক্লাসরুম বরাদ্দ নেই!” ওই ক্লাসঘরেই মিড-ডে মিলের চালের বস্তাগুলিও ডাঁই করে রাখা। এমন ‘মাল্টি পারপাস’ শ্রেণিকক্ষ শুধু যে হিঙ্গলগঞ্জের ওই স্কুলেই আছে, তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযানের তরফে শ্রেণিকক্ষের আদর্শ মাপ বলা হয়েছিল ৬৬ বর্গ মিটার। কিন্তু ক’টি স্কুলে এ রকম শ্রেণিকক্ষ আছে?
বহু ছাত্রী টিফিনের পরে স্কুলে থাকতে চায় না। কারণ স্কুলের শৌচাগার ব্যবহারের উপযোগী নয়। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ২৫ থেকে ৩০ জন পড়ুয়াপিছু একটি করে ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার থাকার কথা। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে, গড়পড়তা সরকার-পোষিত ‘অভাগা’ স্কুলগুলিতে ৫০০-৬০০ পড়ুয়াদের জন্য থাকে মাত্র দু’টি বা তিনটি অপরিচ্ছন্ন এবং অস্বাস্থ্যকর শৌচাগার।
স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ভাল বসার জায়গা নেই। ঘরে যথেষ্ট আলো-বাতাস নেই। গ্রীষ্মে লোডশেডিং-এ অবস্থা আরও চরমে ওঠে। তাই তো রাজ্য সরকারকে বাধ্য হয়ে ফি বছর গরমের ছুটি বাড়াতে হয়। মেনে নিতে হয়, সরকার-পোষিত স্কুলে গরমে ক্লাস চালানোর উপযোগী পরিবেশটাই নেই।
এ বছরেই ছাত্রছাত্রীর অভাবে কলকাতার ৭৫টি সরকার পোষিত স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট বলছে, অসমে ৪৭৬টি নিম্ন প্রাথমিক এবং ৯৫টি উচ্চ প্রাথমিক সরকারি স্কুলে এক জন ছাত্রও
ভর্তি হয়নি। এএসইআর-এর সাত বছরের সমীক্ষায় (২০০৭-২০১৪) জানানো হয়েছে, সরকারি স্কুলে ছাত্র ভর্তি ৭২.৯ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৩.১ শতাংশে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি আয়োগের সভা ইতিমধ্যেই ‘নন-পারফর্মিং’ এবং ‘হলোড’ স্কুলগুলিকে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে পিপিপি মডেলে জুড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ অতিশী মারলেনারা দিল্লির সরকারি স্কুলগুলিতে কত অল্প সময়ের মধ্যে বড়সড় পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছেন। বেসরকারি স্কুলের পরিকাঠামোকে টেক্কা দিয়ে দিল্লির সরকারি স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা ৩.৫ শতাংশ বেশি পাশ করেছে। এ বছর দিল্লির সরকারি স্কুলে পাশের হার ৯৪.২৪ শতাংশ।
আসলে ‘দিল্লি সরকার’ যেটা পারে, ‘দিল্লির সরকার’ সেটা পারে না। তাই তো দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাখাতে জিডিপি-র ৩.১ শতাংশ বরাদ্দেই আটকে থাকেন। সরকারি স্কুলে যে পরিকাঠামো বদলানো প্রয়োজন, তা জানলেও মানতে চান না। এ বছর মোট দেশবাসীর ৪০ শতাংশ শিশু-কিশোর-যুবক। তাঁদের মধ্যে ৫ কোটি ২০ লক্ষ জেড-প্রজন্মের ভারতীয় নাগরিক। দেশের ১৯তম জাতীয় লোকসভা নির্বাচনে তাঁরাই অংশ নেবেন ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। অথচ তাঁদেরই শিক্ষার উৎকর্ষ প্রসঙ্গ ‘ভিশন-২০৩০’-তে উপেক্ষিত থেকে যাবে।
রং লাগালেই স্কুলের পরিকাঠামো বদলায় না, তা বুঝতে হবে। শিক্ষার উৎকর্ষ বাড়াতে দেশের সার্বিক মনোযোগ ফিরে আসুক এ বার। তাই আর একটা নির্বাচনের দিকে খুব আশা নিয়ে তাকিয়ে আছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy