Advertisement
১১ মে ২০২৪

পকেটে পেঁয়াজ নিয়ে সুব্রত জঙ্গলপ্রবাসে 

সামনের আসনে বসা ব্যক্তির জামাকাপড়ে পেঁয়াজের গন্ধ হলে, অন্য সওয়ারের নাকে তখন খবরের গন্ধ। প্রশ্নটা তাই পিছনে বসা সহধর্মিণীকেই করা গেল। পেঁয়াজ কেন রাখতে বলছেন? 

বাঁকুড়ার রানিবাঁধে প্রচারে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

বাঁকুড়ার রানিবাঁধে প্রচারে সুব্রত মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় 
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০১৯ ০৩:১৭
Share: Save:

‘‘পেঁয়াজটা পকেটে ভরেছ?’’ এসইউভি’র পিছনের আসন থেকে প্রশ্নটা গেল।

‘‘হ্যাঁ, রাখছি। পেঁয়াজ রেখে রেখে জামাকাপড়ে গন্ধ হয়ে গিয়েছে’’— জবাব সামনের আসনে বসা ব্যক্তির।

‘‘তা হোক, শরীরটা আগে।’’ ‘বাধ্য-ব্যক্তি’ ছাঁচি পেঁয়াজ পকেটে পুরলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল।

সামনের আসনে বসা ব্যক্তির জামাকাপড়ে পেঁয়াজের গন্ধ হলে, অন্য সওয়ারের নাকে তখন খবরের গন্ধ। প্রশ্নটা তাই পিছনে বসা সহধর্মিণীকেই করা গেল। পেঁয়াজ কেন রাখতে বলছেন?

‘‘আরে ওই যে বলে, ছাঁচি পেঁয়াজ রাখলে লু লাগে না। দেখছ তো কী রোদ! টোটকা আর কী?’ বাঁকুড়ার ভোটবাজারে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের রণকৌশলের অঙ্গ হিসেবে টোটকাও থাকছে। গত ১১ মার্চ ভোটের দিন ক্ষণ ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন। ১৩ মার্চ থেকে বাঁকুড়ার হোটেলে ঘাঁটি গেড়েছেন তিনি। সর্বক্ষণের সঙ্গী চার জন— স্ত্রী ছন্দবাণী, বোন তনিমা এবং দুই সহকর্মী দেবু রায়চৌধুরী ও স্বপন মহাপাত্র। প্রচারেও থাকছেন তাঁরা। স্ত্রী আর বোন তো তাঁকে কাছছাড়া করছেন না কোনও ভাবেই।

তবে বাঁকুড়ায় লড়তে এসে সুব্রতবাবুকে আপাতত ছাড়তে হয়েছে অনেক কিছু। বাংলার হাতেগোনা যে ক’জন ‘সনাতনী’ ধুতি-পাঞ্জাবিতে রাজনীতি করেন, তাঁদের মধ্যে জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী এক জন। পদযাত্রা, রোড-শো, কর্মিসভায় ঠাসা কর্মসূচির জেরে ধুতি ছেড়ে পাজামায় পা গলিয়েছেন সুব্রতবাবু। বাজারে নতুন আম এসেছে। কলকাতায় থাকলে এখন রোজ রাতে একটি গোটা আম বরাদ্দ ছিল তাঁর। কিন্তু এখন প্রতিদিন ১০-১১ ঘণ্টার ‘আউটডোর’ করে রাতের খাবারে বরাদ্দ রুটি-তরকারি।

রোজ সকালে উঠে তিনি হাঁটছেন, খোল বাজাচ্ছেন, শিবের মাথায় জল ঢালছেন, রানিবাঁধ-রাইপুরের জঙ্গলঘেরা আদিবাসী গ্রামে গ্রামে ঘুরছেন। জঙ্গলের ভিতরে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ওভারহেড জলের ট্যাঙ্ক দেখে শিশুর সারল্যে বলে উঠছেন, ‘‘ওই দেখ, আমার জল।’’

টানা দেড় মাস বাঁকুড়ায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে তামাটে হয়েছে চেহারা। কমেছে ওজনও। কিন্তু হুড খোলা জিপের মাথায় বড় ছাতা বাঁধতে দেননি। পায়ে স্নিকার বা চোখে রোদ চশমা পরার শত অনুরোধও ফিরিয়ে দিয়েছেন। এত রোদে সানগ্লাস তো ব্যবহার করতে পারেন? তাঁর জবাব, ‘‘আমরা পুরনো আমলের লোক। জনসংযোগে বেরিয়ে ছাতা, স্নিকার, চশমা চলে না। ভোটাররা ভাল চোখে দেখে না। এ সব এখনকার কালচার।’’ পর ক্ষণেই একডালিয়া-কর্তার রসিকতা, ‘‘শুধু ভোটাররাই তো আমাকে দেখছে না। আমিও ভোটারদের দেখছি। খালি চোখেই ওদের মনের ভাব বোঝা যায়। চশমা পরে নয়।’’

লোকসভাতে যখন দাঁড়ালেনই তখন দক্ষিণ কলকাতায় নয় কেন? সুব্রতবাবু বলছেন, ‘‘দক্ষিণ কলকাতার চেয়ে বাঁকুড়া আমার বেশি পছন্দ। লু-গরম আমি সহ্য করতে পারি, কারণ, এখানকার হাওয়া মিষ্টি। জঙ্গলের হাওয়ার স্বাদই অন্য। কলকাতার হাওয়াটা অন্য রকম।’’ স্বভাবরসিক ‘ছাত্রনেতার’ ঠোঁটের কোণে তখন দুষ্টু হাসি।

সাত সকালে সদর থেকে বেরিয়ে গাড়ি তখন রানিবাঁধের আখখোটা মোড়ে। সামনে বিরাট হরিনামের দল। বাজছে খোল-করতাল। শিব-মন্দিরে জল ঢাললেন। না ঢাললে উপায় নেই, সেই মন্দির বানিয়েছেন স্থানীয় যুব-তৃণমূল নেতা। ঝপাঝপ ছবি উঠল। শুরু হল হুড খোলা জিপে রোড শো।

এ তল্লাটে একটি কথা খুব ছড়িয়েছে। ‘বাঁকুড়ার ঘরে ঘরে সুব্রত’। ব্যাপারটা কী? তিনি বলেন, ‘‘বাঁকুড়ার ঘরে ঘরে আমি তো আছিই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের টাকায় জল দিয়েছি। ঘর দিয়েছি, ১০০ দিনের কাজ দিয়েছি। ঘরে ঘরে পায়খানা বানিয়ে দিয়েছি। ফলে যে কথাটা প্রচার হচ্ছে, তা ভুল বলি কী করে?’’

গাড়ি ঢুকছে কোনও আদিবাসী গ্রামে। মেয়েরা দাঁড়িয়ে জঙ্গলি ফুলের মালা আর ঘটি ঘটি জল নিয়ে। গাড়ি থেকে নামতেই রণকুরার আদিবাসী মেয়েরা প্রার্থীর পা ধুইয়ে দিলেন। অবিকল চিত্তে তা মেনে নিলেন সুব্রতবাবু। ভোট প্রচার চলল কিছু ক্ষণ। তার পর ফের অন্য গ্রামের পথে। গাড়িতে উঠতেই প্রার্থীকে মুসুম্বির রস বাড়িয়ে দিলেন ছন্দবাণী। তার পর জানালেন, দিন কয়েক আগে প্রচারে এসে মহুয়া ফলের মালা পেয়েছিলেন। সেটি সযত্নে রেখেছিলেন হোটেলের ঘরে। ‘‘মাঝ রাতে সেকি ম’ম গন্ধ। ভাবছি কোথা থেকে এত গন্ধ আসছে। খোঁজাখুঁজি করে দেখি মহুয়া ফলের মালা থেকেই নেশাড়ু গন্ধ ছড়াচ্ছে’— হাসছেন ছন্দবাণী। কথা শেষ না হতেই সুব্রতবাবুর জবাব, ‘‘এত খোঁজার কী দরকার ছিল? আগে তো আমার মুখের গন্ধ শুঁকলেই পারতে।’’ গাড়ি ভর্তি সকলেই তখন হো হো করে হাসছেন।

গরমে কাহিল হয়েছেন তিনি। ভোটের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংশয় রয়েছে। তবুও স্বভাব-রসিক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হেঁয়ালি আর রসিকতায় টেনে রেখেছেন তাঁর প্রিয়জনদের। ভোজনরসিকও বটেন। মিষ্টি পেলে আর কিছু চান না। ঝিলিমিলিতে দুপুরের খাওয়ার পর টক দই এল। পরিবেশক জানতে চাইলেন চিনি দেবেন কি না। কেউ নিলেন না। সুব্রতবাবু বললেন, ‘‘দু’চামচ চিনি দাও। চিনি দিয়ে টক দই বেশি ভাল লাগে।’’ স্ত্রী কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে বললেন,‘‘এইটুকু দইয়ে এতটা চিনি নিলে?’’ সঙ্গী সাংবাদিকের খোঁচা, ‘‘বউদির কোনও কথা শোনেন না?’’

সুব্রতবাবুর সপাটে জবাব, ‘‘সব কথা শুনি। অনেকের চেয়ে বড় স্ত্রৈণ আমি। কিন্তু ভাবমূর্তিটা এমন, যে লোক ভাবে হয়তো আমার বিরাট পুরুষকার।’’ বলেই হাসছেন সাবেক ছাত্র পরিষদ নেতা। মুখে তখন টক দই।

সত্যিই তো, রাজনেতার ভাবমূর্তিটাই আসল। এত সংশয়ের মাঝে বাঁকুড়ায় সেটাই মূলধন করেছেন সারেঙ্গাবাদের সুব্রত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE