Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

একা রামে রক্ষা নেই, দোসর ‘নেতা’ রঞ্জনও

এক জন বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে ধরা পড়েছেন। অন্য জন মারা গিয়েছেন সস্ত্রীক। রঞ্জন মাইতি আর রামপদ মাইতি— পিংলার বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে এই দুটি নাম। এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের অভিযোগে, প্রায় সব আমলেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা রঞ্জনের মদতেই বেআইনি বাজির কারবার চালাতেন রামপদ। সব জেনেও ‘জানত না’ পুলিশ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা ও খড়্গপুর শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৫ ০৩:৪৬
Share: Save:

এক জন বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে ধরা পড়েছেন। অন্য জন মারা গিয়েছেন সস্ত্রীক। রঞ্জন মাইতি আর রামপদ মাইতি— পিংলার বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাচ্ছে এই দুটি নাম। এলাকাবাসীর একটা বড় অংশের অভিযোগে, প্রায় সব আমলেই রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকা রঞ্জনের মদতেই বেআইনি বাজির কারবার চালাতেন রামপদ। সব জেনেও ‘জানত না’ পুলিশ।

স্থানীয় সূত্রের খবর, ব্রাহ্মণবাড়ের ছেলে রঞ্জন গত কয়েক বছর ধরে এলাকায় তৃণমূল কর্মী বলে পরিচিত হলেও রাজ্যে পালাবদলের আগে তিনি সিপিএম করতেন। ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআইয়ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন কিছু দিন। সম্প্রতি বিজেপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তাঁর। দুই মেদিনীপুরে পুলিশ থেকে রাজনৈতিক নেতাদের অনেকে রঞ্জনকে এক ডাকে চিনতেন বরাত দিলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাতবোমা পৌঁছে দেওয়ার ‘ক্ষমতা’র জন্য।

বিস্ফোরণের পরে অবশ্য রঞ্জনকে নিজেদের লোক বলে মানতে চাইছে না তৃণমূল। দলের জেলা কার্যকরী সভাপতি অজিত মাইতির দাবি, ‘‘রঞ্জন বেশ কয়েক মাস হল আমাদের দলের সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছিল। এখন ও বিজেপির দিকে ঝুঁকেছিল।’’ যদিও পিংলার বিজেপি নেতা গৌর ঘড়াইয়ের অভিযোগ, “রঞ্জন মাইতি তৃণমূলের একনিষ্ঠ কর্মী। পুলিশের সহযোগিতায় ও তৃণমূলের মদতে বাজি ব্যবসার আড়ালে বোমা তৈরি করত সে।’’

সাত ভাইয়ের পরিবারে রঞ্জন মেজো। বছর পনেরো আগে মুণ্ডমারির কাছে একটি ভিডিও হল চালাতেন তিনি। কিন্তু সম্প্রতি সেই ব্যবসা বন্ধ করেন। গ্রামবাসীর দাবি, বছর চল্লিশের রঞ্জন গাঁজা-চাষও শুরু করেছিলেন। তবে সে কাজ এগোয়নি। পরে বাড়ির পাশের জমিতে পোলট্রি বানান। কিন্তু পোলট্রি বন্ধ করে পাশের সুদছড়া গ্রামের বাসিন্দা বোমা বাঁধায় দক্ষ রামপদকে ওই পোলট্রির জমিতে এনে বসিয়েছিলেন। শুরু হয়েছিল বেআইনি বাজি কারখানা। সেখানে চকোলেট বোমা তো বটেই, জল-বোমা, গাছ-বোমা জাতীয় নানা নিষিদ্ধ শব্দবাজিও তৈরি হতো।

স্থানীয় বাসিন্দাদের স্মৃতিচারণ, পিংলার সুদছড়া গ্রামের বাসিন্দা রামপদর নিজের বাড়িতেই আগে বাজির কারখানা ছিল। দুই মেদিনীপুর, হাওড়া এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে বোমা সরবরাহ করায় বছর বত্রিশের রামপদও অভিযুক্ত বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। কিন্তু ২০১২ সালে এক বার বাসে বাজির মশলা আনার সময় পিংলার মুণ্ডমারির কাছে আগুন ধরে যাওয়ায় গোলমালে জড়ান তিনি। পরে সুদছড়া গ্রামে তাঁর বাজি কারখানাতেও বিস্ফোরণ হয়। তারপরই এলাকাবাসী রামপদকে গ্রামছাড়া করেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, ‘‘২০১৩-র গোড়ায় স্ত্রী রিনাকে নিয়ে পাশের ব্রাহ্মণবাড় গ্রামে রঞ্জনের বাড়িতেই ওঠে রামপদ। তৈরি হয় রাম-রঞ্জন জুটি।’’ রঞ্জনের বৃদ্ধা মা ঊর্মিলাদেবী অবশ্য বলেন, “সে সময় আমি কয়েক মাস ছিলাম না। তখনই ওই জমিতে এক জন ভাড়া নিয়ে বাজি কারখানা বানিয়েছিল। সারা দিন ওরা কী করত, জানি না। ”

গ্রামবাসীর অবশ্য অভিযোগ, তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ বলে এলাকায় পরিচিত রামপদ নামেই ওই জমি ভাড়া নিয়েছিলেন। তাঁকে সামনে কারখানা চালাতেন এলাকার দাপুটে তৃণমূল কর্মী রঞ্জনই। পুলিশকে একাধিক বার কারখানার কথা জানানো হলেও লাভ হয়নি। বাজি কারখানার কাছেই বাড়ি প্রণতি টুডুর। তাঁর কথায়, ‘‘পুলিশকে বেআইনি এই কারখানার কথা অনেক বার বলেছি। গ্রামবাসীরাও অভিযোগ জানিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি।’’

স্থানীয় জামনা পঞ্চায়েতটি তৃণমূলের দখলে থাকলেও ব্রাহ্মণবাড় গ্রামের পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের। সালমা বিবি নামে সেই পঞ্চায়েত সদস্যাও গ্রামবাসীদের সুরে পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘আমি নিজে পিংলা থানার ওসি-কে ওই অবৈধ কারখানার কথা জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি কোনও কথায় গুরুত্ব দেননি। উল্টে আমাকে থানা থেকেই বের করে দেওয়া হয়!’’ জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে লিখিত ভাবে জানিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে তাঁর দাবি। জেলা পুলিশ এবং প্রশাসন মানছে, ওই বাজি কারখানাটি বেআইনি ছিল। তার বাইরে রাম-রঞ্জন নিয়ে মুখে কুলুপ তাদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE