উত্তরকন্যা ভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সন্দীপ পাল।
কোনও দফতরের কাজ নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে অভিযোগ উঠলে দ্বিতীয় ইনিংসে যে সেখানকার মন্ত্রী-অফিসারদের এতটুকু ছাড় দেওয়া হবে না, তা স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার উত্তরবঙ্গের সচিবালয় ‘উত্তরকন্যা’য় বসে তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে শুধু ভর্ৎসনাই করলেন না, একান্ত বৈঠকে হুঁশিয়ারি দিলেন, প্রয়োজনে দফতর তুলে দেওয়ার কথাও ভাববেন।
উত্তরবঙ্গ সফরে গত দু’দিন ধরে একাধিক বৈঠক ও ঘরোয়া আলোচনায় মুখ্যমন্ত্রী বন দফতর নিয়ে যে ভাবে ক্ষোভ ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন, তাতেই মন্ত্রী-অফিসারদের অনেকের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। জঙ্গলমহল থেকে ডুয়ার্সে বনসৃজন, বনসুরক্ষার কাজে গাফিলতিই শুধু নয়, লোকালয়ে হাতি-চিতাবাঘের হানা রুখতে বিবিধ ব্যবস্থার পরেও কেন সাফল্য মিলছে না— প্রশ্ন তুলে দৃশ্যতই বিরক্ত মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘দিনের পর দিন এটা চললে দফতরটা রেখে লাভ কি!’’
এ বার সড়ক পথে সেবক-মালবাজার-বিন্নাগুড়ি-বানারহাট হয়ে আলিপুরদুয়ারে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ডুয়ার্সের বিস্তীর্ণ এলাকার বনাঞ্চলে গাছ কেটে নেওয়া নজর এড়ায়নি তাঁর। হাসিমারায় মালঙ্গীর অতিথি নিবাসে ঘরোয়া আলোচনায় সেই প্রসঙ্গ তুলে উদ্বেগও প্রকাশ করেন তিনি।
পরে তিনি শিলিগুড়িতে ফিরে প্রশাসনিক বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী সকলের সামনেই ভর্ৎসনা করেন বনমন্ত্রী থেকে কর্তাদের। বৈঠকের পরেও বনমন্ত্রী বিনয়চন্দ্র বর্মন, বন উন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান উদয়ন গুহ এবং আমলাদের উত্তরকন্যায় নিজের ঘরে ডেকে একান্তেও চড়া গলায় জানিয়ে দেন ক্ষোভ। জানিয়ে দেন, ডুয়ার্সের জঙ্গলে কাঠ চুরি রোখা যায়নি। গত কয়েক মাস ধরে বাঁকুড়া-মেদিনীপুরে হাতির দল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাতে লোক মারা যাচ্ছে। বন দফতরের গড়িমসিতে আটকে রয়েছে একাধিক পর্যটন প্রকল্পের কাজ। বনকর্তারা কর্মীর অভাব বলে যুক্তি খাড়া করার চেষ্টা করলে মুখ্যমন্ত্রী আরও চটে যান। উল্টে বলেন, ফি-বছর বন দফতর নানা খাতে কত কোটি টাকা খরচ করে! এবং প্রশ্ন করেন, গত কয়েক মাস ধরে বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুর শহর লাগোয়া এলাকায় হাতির তাণ্ডব চলছে কেন? এর পরেই তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ঠিকঠাক কাজ না করলে দফতরের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার কথা ভাবতে হবে। পরে বনমন্ত্রী বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী অনেক নির্দেশই দিয়েছেন। সেই মতো কাজ করা হচ্ছে।’’ উদয়নবাবু বলেন, “সাত দিন হল দায়িত্ব নিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনেই কাজ করছি।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বিরক্তি বন দফতরেই আটকে থাকেনি। সেচ ও পূর্ত দফতর নিয়েও উষ্মা চেপে রাখেননি তিনি। সরকারি মহলের একাংশের বক্তব্য, এর পিছনে কারণ যে একেবারে নেই, তা নয়। সেচ দফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা উদাসীন বলেই চোখের সামনে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন নদী থেকে বোল্ডার তুলে বাংলাদেশে পাচার করে দেওয়া হচ্ছে। আবার পাকুড়ের কুচিপাথর দিয়ে রাস্তা তৈরির কথা থাকলেও অপেক্ষাকৃত ভঙ্গুর সাদা পাথর রং করিয়ে কাজ চলছে বলেও তথ্য রয়েছে সরকারের কাছে। মালদহে গঙ্গা, ফুলহার, মহানন্দায় ভাঙন রোধের কাজে বোল্ডার ফেলার নামে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগও কানে এসেছে সরকারের।
কখনও অভিযোগ এসেছে সরকারি সূত্রে। কখনও দলের বিধায়ক-নেতারাই নালিশ করেছেন। এক সরকারি কর্তার কথায়, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কাছে পূর্ত ও সেচ দফতরের দুর্নীতি সংক্রান্ত অনেক তথ্য, অভিযোগ আছে। সেগুলো যে কোনও মূল্যে রোখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।’’
মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী তথা পূর্তমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসকেও সোমবার থেকে বুধবারের মধ্যে নানা এলাকায় রাস্তা, সেতুর কাজ পরিদর্শন করতে দেখা গিয়েছে। নিম্নমানের কাজ, ঠিকাদার-ইঞ্জিনিয়ার-জনপ্রতিনিধি যোগসাজশের একাধিক অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। সে সবই মুখ্যমন্ত্রীর কানে গিয়েছে। পূর্তমন্ত্রী অরূপবাবু এবং সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে প্রশাসনের এক শীর্ষ আমলা জানান, মুখ্যমন্ত্রী দুই দফতরের সঠিক রোগ নির্ণয় করেছেন। ওষুধও নিশ্চয়ই কড়া ডোজের হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy