পুরভোটে দেখা যায়নি এই সক্রিয়তা। ধর্মঘট সমর্থক ও পুলিশ। আসানসোলে। ছবি: শৈলেন সরকার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কবে পরীক্ষা নেবে, সেটা রাজ্য সরকার কেন ঠিক করতে যাবে এ প্রশ্ন আগেই উঠেছিল। সাধারণ ধর্মঘটের আগের দিন এ প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘‘আমি তো পরীক্ষা নেওয়ার মালিক নই। এটুকু বলতে পারি, বৃহস্পতিবার বাংলা সচল থাকবে।’’
বৃহস্পতিবার দেখা গেল, শিক্ষামন্ত্রীর সুর বদলে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসনে হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে এ দিন তাঁর বক্তব্য, ‘‘একশো বার স্বাধিকারে হাত দেব। মাইনেটা তো আমিই দিই।’’ এমন সদম্ভ ‘মালিকসুলভ’ মন্তব্য শুনে বিরোধীরা তো বটেই, হতভম্ব রাজ্যের শিক্ষা জগতেরও বড় অংশ। তাঁরা বলছেন, বাম জমানায় শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল। সেই প্রক্রিয়াকে অনিলায়ন বলে অভিহিত করে থাকেন অনেকেই। কিন্তু প্রয়াত অনিল বিশ্বাসও প্রকাশ্যে কোনও দিন এমন কথা বলেছেন বলে মনে করতে পারছেন না কেউই।
অথচ রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি প্রত্যেকেই স্বশাসিত। কবে তারা পরীক্ষা নেবে, কবে পরীক্ষার ফল ঘোষণা করবে— এ সব সিদ্ধান্ত নিয়ে আইনত রাজ্য সরকারের কিছুই বলার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাথায় আচার্য হিসেবে আছেন স্বয়ং রাজ্যপাল। প্রয়োজনে বিভিন্ন বিষয়ে উপাচার্যরা তাঁর কাছে পরামর্শ নেন।
বৃহস্পতিবার বিরোধীদের ডাকা ধর্মঘটের দিন কিন্তু পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে এক রকম বাধ্য করেছে রাজ্য সরকারই। নবান্নের নির্দেশ পেয়ে পিছিয়ে দেওয়া পরীক্ষা বৃহস্পতিবারই হবে বলে নতুন নির্দেশিকা জারি করতে হয়েছিল রবীন্দ্রভারতী, যাদবপুর, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়কে। কিন্তু পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে এ দিন যথেষ্ট নাকাল হতে হয় পরীক্ষার্থীদের। এ ভাবে তাদের সমস্যায় ফেলার কী কারণ, কেনই বা রাজ্য সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করল, তা জানতে চাওয়া হয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে। সেই সময়ই পার্থবাবু ওই মন্তব্য করেন।
অথচ পার্থবাবুর দল ক্ষমতায় আসার পরে দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বলেছিলেন, শিক্ষাক্ষেত্র থেকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ দূর করা তাঁর সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। কিন্তু কখনও যাদবপুর, কখনও প্রেসিডেন্সি, কখনও বর্ধমান বা গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বারবারই হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। এ দিন অবশেষে পার্থবাবু খোলাখুলিই জানিয়ে দিলেন, সরকার মাইনে দেয়। অতএব হস্তক্ষেপ করার অধিকার ‘একশো বার’ সরকারের আছে।
প্রাক্তন উপাচার্যরা স্বাভাবিক ভাবেই মন্ত্রীর কথার কড়া সমালোচনা করেছেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন শিক্ষক তথা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রজতকান্ত রায় বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আলাদা স্বাধীনতা আছে। আইন মানলে এর স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।’’ যাদবপুরের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসুও অনেকটা একমত। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এ তো একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। কোনও নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী এমন কথা বলেন কী করে! বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বাধীন ভাবে কাজ করার অধিকার
না থাকলে শিক্ষার উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হবে।’’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন শিক্ষিকা, প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন উপাচার্য মালবিকা সরকার বলেন, ‘‘মন্ত্রী এমন কথা বলেছেন, এটা বিশ্বাস করতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। তবে আমরা তো রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে বিশ্বমানের করে তুলতে চাই। বিভিন্ন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তো সরকার-সহ অনেকের অনুদানে চলে। সেখানেও কি হস্তক্ষেপ হয়?’’
বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ডের শিক্ষক সুগত বসু বর্তমানে তৃণমূল সাংসদ। তিনি এই বিতর্কে ঢুকতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মন্ত্রী এমন কথা বলেছেন কি না, সেটা ওঁর কাছ থেকে না জেনে কিছু বলব না।’’ বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর প্রতি প্রাক্তন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘‘আদালতের বেতনও তো সরকার দেয়। তা হলে কি আদালতের রায়ের ব্যাপারেও সরকার হস্তক্ষেপ করবে?’’ কিন্তু বাম আমলেও তো অনিলায়নের অভিযোগ উঠত। সে ব্যাপারে কী বলবেন? সুদর্শনবাবু বলেন, ‘‘বাম আমলে কোনও দিন এ রকম আচরণ করা হয়নি। অনিলায়ন শব্দটারই কোনও মানে হয় না।’’
শিক্ষাবিদেরা অবশ্য সুদর্শনবাবুর শেষোক্ত দাবিটি মানছেন না। বিজ্ঞানী বিকাশ সিংহর মন্তব্য, ‘‘এমন আচরণ তো নতুন নয়!’’ আইআইএম-কলকাতার অর্থনীতির শিক্ষক অনুপ সিংহও বলছেন, ‘‘যে যখন সরকারে থাকে, সে-ই তখন স্বশাসনে হস্তক্ষেপ করে। আগে হয়তো সেটা অব্যক্ত ছিল, এখন সামনাসামনি বলা হচ্ছে।’’ কিন্তু ধর্মঘটের দিন পরীক্ষা নেওয়াটা স্বশাসনে হস্তক্ষেপের থেকেও বৃহত্তর ব্যাপার বলে মনে করেন অনুপবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘এটা ছাত্রছাত্রীর সুবিধে-অসুবিধে দেখার ব্যাপার। ধর্মঘটের দিন পরীক্ষা না হওয়াই ভাল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy