Advertisement
১১ মে ২০২৪
বিচারপতির যুক্তিতে জব্দ কর্মবিরতি

কড়া দাওয়াইয়ে শুনানিতে হাজির কিছু কৌঁসুলি

আবেদন-নিবেদন, অনুরোধ-উপরোধে কাজ হয়নি। ক্ষোভ বা খেদ প্রকাশেও না। কিন্তু তাঁরাও যে শক্তের ভক্ত, তলব পেয়ে তড়িঘড়ি কাজে যোগ দিয়ে তার প্রমাণ দিলেন কর্মবিরতি আন্দোলনে নামা আইনজীবীদের একাংশ। কর্মবিরতির ব্যারাম সারাতে কড়া দাওয়াইয়ের নিদান দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি অসীম রায়। নিছক নিদান নয়, তা প্রয়োগও করলেন। এবং ফল মিলল হাতে হাতে। সেই ওষুধের ঠেলায় বৃহস্পতিবার, কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনে অন্তত তাঁর আদালতে শুনানিতে যোগ দিলেন বেশ কিছু আইনজীবী। বিচারপতি রায়ের ওষুধটা কী?

অসীম রায়

অসীম রায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

আবেদন-নিবেদন, অনুরোধ-উপরোধে কাজ হয়নি। ক্ষোভ বা খেদ প্রকাশেও না। কিন্তু তাঁরাও যে শক্তের ভক্ত, তলব পেয়ে তড়িঘড়ি কাজে যোগ দিয়ে তার প্রমাণ দিলেন কর্মবিরতি আন্দোলনে নামা আইনজীবীদের একাংশ।

কর্মবিরতির ব্যারাম সারাতে কড়া দাওয়াইয়ের নিদান দিলেন কলকাতা হাইকোর্টের প্রবীণ বিচারপতি অসীম রায়। নিছক নিদান নয়, তা প্রয়োগও করলেন। এবং ফল মিলল হাতে হাতে। সেই ওষুধের ঠেলায় বৃহস্পতিবার, কর্মবিরতির দ্বিতীয় দিনে অন্তত তাঁর আদালতে শুনানিতে যোগ দিলেন বেশ কিছু আইনজীবী।

বিচারপতি রায়ের ওষুধটা কী?

এক কথায় দাওয়াইটা হচ্ছে যুক্তির যুযুৎসু প্যাঁচ। এবং তা মানতে না-চাইলে কঠোর ব্যবস্থার লগুড়।

এ দিন শুরুতেই বিচারপতি রায় জানিয়ে দেন, কর্মবিরতির মধ্যে কোনও আইনজীবী যদি মক্কেলের হয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন, সে-ক্ষেত্রে ওই আন্দোলন চলাকালীন সেই মামলা শুনানির জন্য উঠলে সংশ্লিষ্ট কৌঁসুলি তাতে যোগ দিতে বাধ্য। বিচারপতির এই যুক্তিতেই এ দিন হাইকোর্টের একটি এজলাসে আইনজীবীদের কর্মবিরতি হালে পানি পেল না। শুনানি হল দিনভর।

বেজায় গরমের দোহাই দিয়ে হাইকোর্টের আইনজীবীরা বুধবার থেকে তিন দিনের কর্মবিরতির ডাক দেন। ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর সে-দিন আইনজীবীদের বলেছিলেন, ‘‘স্কুলের বাচ্চাদের মতো আপনারা শুধু ছুটি চান কেন?’’ কর্মবিরতির পথে না-যেতে অনুরোধ করেন তিনি। বিচারপ্রার্থীদের কথা ভেবে প্রধান বিচারপতি তাঁদের জানান, গরম বোধ হলে তাঁরা গাউন না-পরেই মামলা লড়তে পারেন। তিনি সেই অনুমতি দিচ্ছেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে বিচারপতি রায় কড়া মনোভাব দেখাতেই কর্মবিরতির ছবিটা ফিকে হয়ে কর্মতৎপরতার দিকটা বেশ উজ্জ্বল হয়েছে বলে মনে করছেন আইনজীবীদের একাংশ। কর্মবিরতির মধ্যেই বিচারপতির রায়ের যুক্তির কাছে কার্যত হার মেনে এ দিন তাঁর আদালতে ২৩টি মামলার শুনানিতে যোগ দেন অভিযুক্ত পক্ষের বেশ কিছু আইনজীবী। তাঁরা হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনের সিদ্ধান্ত সমর্থন করে কর্মবিরতিতে সামিল হয়েছিলেন। যে-সব আইনজীবী কর্মবিরতির ডাকে সাড়া দেননি, তাঁদের অনেকেই জানান, হাইকোর্ট কড়া হলে যে অনেক কিছুই করা যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

সেটা সম্ভব হল কী ভাবে? বিচারপতি রায়ের এজলাসে এখন মূলত আগাম জামিনের মামলা হয়। এ দিন আদালতের কাজ শুরু হতেই দেখা যায়, অভিযুক্ত পক্ষের অধিকাংশ আইনজীবী তাঁর এজলাসে হাজির হননি। এসেছেন শুধু কয়েক জন সরকারি আইনজীবী। একটি মামলায় অভিযুক্ত পক্ষের এক আইনজীবী হাজির না-হওয়ায় বিচারপতি রায় তাঁর অফিসারদের কাছে জানতে চান, কবে ওই মামলা দায়ের করা হয়েছে? অফিসারেরা জানান, মামলাটি দায়ের হয়েছে ১০ জুন (ওই দিনই কর্মবিরতি শুরু হয়)। সে-দিন আরও কিছু মামলা করা হয়েছে বলেও জানান অফিসারেরা।

তার পরেই বিচারপতি রায় বলেন, ‘‘কর্মবিরতি চলাকালীন যদি কোনও আইনজীবী আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন, তা হলে মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে ওই আইনজীবী হাজির থাকবেন না কেন? যদি মামলাগুলি কর্মবিরতির আগে দায়ের হত, তা হলেও না-হয় বুঝতাম।’’ তাঁর মন্তব্য, আইনজীবীরা আদালত-চত্বরে আসছেন। চেম্বারে যাচ্ছেন। মামলা ফাইল করছেন। অথচ শুনানিতে আসছেন না! এটা কী ধরনের আচরণ?

এ দিন বেশ কয়েকটি মামলার শুনানিতে দেখা যায়, অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী হাজির থাকলেও কর্মবিরতির জন্যই সরকারি কৌঁসুলি হাজির হননি। মামলার কেস ডায়েরি রয়ে গিয়েছে সরকারি আইনজীবীর হেফাজতে। তা জেনে ক্ষুব্ধ বিচারপতি রায়ের প্রশ্ন, ‘‘কেস ডায়েরি তো আদালতের সম্পত্তি। সরকারি আইনজীবী কী করে সেটা নিজের হেফাজতে রেখে মামলার শুনানিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারেন?’’

তত ক্ষণে বিচারপতি রায়ের ডিভিশন বেঞ্চে হাজির হয়েছেন রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র। সরকারি আইনজীবীদের হেফাজতে কেস ডায়েরি আটকে থাকার বিষয়টি জয়ন্তবাবুকে জানান বিচারপতি রায়। জয়ন্তবাবু আশ্বাস দেন, তিনি নিজে বিষয়টি দেখবেন।

বিচারপতি রায় তখনই বিভিন্ন মামলার নথিতে থাকা অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীদের মোবাইল নম্বর পড়ে শোনান কোর্ট অফিসার এবং উপস্থিত আইনজীবীদের। তাঁদের নির্দেশ দেন, ওই আইনজীবীদের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে এখনই জানিয়ে দেওয়া হোক, তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁদের বেলা ২টোয় তাঁর আদালতে হাজির থাকতেই হবে। আদালতে হাজির ছিলেন পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) মনজিৎ সিংহ। পিপি জানান, তিনি নিজে ওই আইনজীবীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। বিচারপতি রায় পিপি-কে বলেন, ‘‘যে-সব সরকারি আইনজীবী কেস ডায়েরি নিয়ে আদালতে হাজির হননি, তাঁদের যেন বেশ কিছু দিনের জন্য কোনও মামলা দেওয়া না-হয়।’’

বেলা ২টোয় বেশ কয়েক জন আইনজীবী আদালতে হাজির হন। ২৩টি মামলায় দু’পক্ষের শুনানির শেষে রায়ও দেন বিচারপতি রায়। যে-সব আইনজীবী আদালতে হাজির হননি, তাঁদের উদ্দেশে বিচারপতি জানিয়ে দেন, আজ, শুক্রবারেও শুনানিতে তাঁরা হাজির না-হলে তিনি কড়া পদক্ষেপ করবেন। এমনকী এক পক্ষের বক্তব্য শুনেই তিনি একতরফা নির্দেশও দিয়ে দিতে পারেন।

আইনজীবীদের কর্মবিরতির বিষয়টি এ দিন বিধানসভাতেও ওঠে। রাজ্যের বিভিন্ন নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টে কত মামলা বিচারাধীন রয়েছে এবং এ ব্যাপারে সরকার কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, প্রশ্নোত্তর পর্বে আইন ও বিচার দফতরের প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের কাছে তা জানতে চান কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া।

আইনমন্ত্রী জানান, নিম্ন আদালতে ২৫ লক্ষ ৫৬ হাজার ৭৬১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। তার মধ্যে ফৌজদারি মামলা ১৯ লক্ষ ৯৩ হাজার ৩১টি। আর হাইকোর্টে ফয়সালার অপেক্ষায় রয়েছে দু’লক্ষ ৮৬ হাজার ৩০৬টি মামলা। তার মধ্যে ফৌজদারি মামলা দু’লক্ষ ৩০ হাজার ৬৯৭টি। মন্ত্রী জানান, বিচার প্রক্রিয়ার উপরে সরকারের কোনও হাত নেই। তবে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে উচ্চ আদালত যদি পরিকাঠামোর ব্যাপারে বিশেষ কোনও নির্দেশ দেয়, সরকার অবশ্যই সেটা পালন করবে।

এর পরেই মানসবাবুর অতিরিক্ত প্রশ্ন ছিল, ‘‘কোথাও বিচারকের অভাবে বিচার হচ্ছে না। কোথাও বা আইনজীবীরা খুব গরমে বা খুব ঠান্ডায় ছুটি নিয়ে নিচ্ছেন। এ ক্ষেত্রেও কি সরকারের কিছু করার নেই?’’

আইনমন্ত্রী চন্দ্রিমাদেবীর জবাব, ‘‘ছুটির ব্যাপারে সব সিদ্ধান্তই নেয় বার কাউন্সিল। আদালত বিচারক চাইলেই আমরা নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করে দিই। এর বাইরে সরকারের কিছু করার এক্তিয়ার নেই।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE