Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

বীজে ছাড়ই সার, নোটের খরায় রবি

এক রোগ সারাতে গিয়ে আরও দশটা রোগ! এ কেমন দাওয়াই? ভেবে পাচ্ছেন না রাজ্যের কৃষি আধিকারিক থেকে প্রত্যন্ত গাঁয়ের চাষি। নোট বাতিলের ধাক্কায় রোজই হোঁচট খাচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজন। তা সামলাতে নিত্যনতুন নির্দেশ জারি করছে কেন্দ্র।

—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

সুপ্রকাশ মণ্ডল
কল্যাণী শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:০৪
Share: Save:

এক রোগ সারাতে গিয়ে আরও দশটা রোগ! এ কেমন দাওয়াই? ভেবে পাচ্ছেন না রাজ্যের কৃষি আধিকারিক থেকে প্রত্যন্ত গাঁয়ের চাষি।

নোট বাতিলের ধাক্কায় রোজই হোঁচট খাচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজন। তা সামলাতে নিত্যনতুন নির্দেশ জারি করছে কেন্দ্র। নির্দেশিকার অস্বচ্ছতায় বাড়ছে ধন্দ। তৈরি হচ্ছে নতুন সঙ্কট ও জটিলতা। এই তালিকায় নবতম সংযোজন রবি চাষের বীজ নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের সোমবারের একটি ঘোষণা। তা হল, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বীজ কেনা যাবে পুরনো ৫০০ টাকার নোটে। রবি চাষ যাতে মার না খায় সেই লক্ষ্যেই এই ছাড়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে শুধু বীজে চাষ হবে কী করে? সার এবং কীটনাশক কেনার ক্ষেত্রেও তো গেরো সেই নোটের আকাল।

শুধু কী তাই? বীজের ক্ষেত্রে যে ঘোষণা করা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টা পরেও সেই নির্দেশিকা পৌঁছয়নি রাজ্য সরকারের কাছে। নির্দেশিকা এলেও সমস্যা যে মিটবে, সেই নিশ্চয়তাই বা কোথায়? বরং তাতে সমস্যা বাড়বে বলেই মনে করছেন কৃষি আধিকারিক থেকে শুরু করে সাধারণ চাষিরা।

বীজ বিক্রির কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বলতে ন্যাশনাল সিড কর্পোরেশন (এনএসসি)। এই মুহূর্তে রাজ্যে কোনও জেলাতেই তাদের খুচরো বিপণন কেন্দ্র নেই। কিছু ডিলার থাকলেও, তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা।

বীজের জন্য রয়েছে রাজ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান স্টেট সিড কর্পোরেশন বা রাজ্য বীজ নিগমও। জেলা সদর-সহ কয়েকটি মহকুমা কৃষি খামার থেকে তারা চাষিদের বীজ বিক্রি করে। এদেরও কিছু ডিলার রয়েছে। ‘‘তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় নগন্য,’’ বলছেন খোদ কৃষিমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুই। তার উপরে চাষিদের চাহিদা মেটাতে যত বীজ দরকার, তা-ও মজুত নেই।

রাজ্য কৃষি দফতরের এক আধিকারিক বলছেন, রাজ্য বীজ নিগমের কাছে সর্ষে বা ডাল-শস্যের বীজ রয়েছে প্রয়োজনের মাত্র ২০-২৫ শতাংশ। তা ছাড়া জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় কোনও সরকারি দোকানও নেই। ফলে বেসরকারি দোকানগুলিই চাষিদের ভরসা। ফালাকাটার চাষি শ্যামল গুহ রায়ের প্রশ্ন, সরকারি প্রতিষ্ঠান ৩৮ কিলোমিটার দূরে কোচবিহার সদরে। সেখানে গিয়েও যে বীজ মিলবে, তারই বা নিশ্চয়তা কী? নিশ্চয়তা যে নেই, তা স্বীকার করছেন কোচবিহারের মুখ্য কৃষি আধিকারিক মিজানুর আহসান। তিনি জানালেন, এই মুহূর্তে জেলায় আলু চাষ হচ্ছে। কিন্তু উত্তরবঙ্গে কোনও সরকারি কেন্দ্র থেকে আলু বীজ বিক্রিই হয় না। সর্ষে বা ডাল-শস্যের বীজ বিক্রি হলেও জোগান নগণ্য। বীরভূমের ময়ুরেশ্বরের চাষি সুরজিৎ মণ্ডল জানালেন, সরকারি বীজ প্রতিষ্ঠান যে রয়েছে, সেটাই তাঁরা জানেন না। নদিয়ার কালীগঞ্জের চাষি মিরাজ শেখের বক্তব্য, ‘‘আমার মতো অনেকেই টাকা ব্যাঙ্কে রেখে আর তুলতে পারছেন না।’’ রাজ্যে সবথেকে বেশি আলু হয় হুগলিতে। জেলার এক কৃষি আধিকারিক জানালেন, জেলায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়। বীজ দরকার ১.৮ লক্ষ টন। সরকারি খামার থেকে বীজ বিক্রি হয় মাত্র ৩ হাজার টন। তা ছাড়া, পুরনো বাতিল নোটে বিক্রির কোনও নির্দেশিকা তাঁরা পাননি। শুধু তা-ই নয়, খামারগুলিতে আলু বীজ বিক্রি হচ্ছে ২৫টাকা কেজি। বেসরকারি দোকানে দাম অনেক কম।

• পুরনো নোটে বীজ বিক্রির নির্দেশ হাতেই পায়নি সরকারি কেন্দ্র

• বীজ বিক্রির সরকারি কেন্দ্র আছে, সেটাই জানেন না অনেকে

• দূরে সরকারি কেন্দ্রে গেলেও যে বীজ মিলবে, নিশ্চয়তা নেই

• বেশির ভাগ জেলায় সরকারি কেন্দ্রে আলু বীজ বিক্রি হয় না

• সরকারি কেন্দ্রে সর্ষে বা ডাল-শস্যের বীজের জোগান খুবই কম

• টাকা ব্যাঙ্কে। তোলা যাচ্ছে না। সার-কীটনাশক কী ভাবে মিলবে

• ২৪ তারিখ পর্যন্ত পুরোনো নোট চলবে। তার পরে কী হবে

ন্যাশনাল সিড কর্পোরেশন • বীজের খুচরো বিক্রির কেন্দ্র নেই রাজ্যের কোনও জেলায় • ডিলার হাতে গোনা

রাজ্য বীজ নিগম • বীজ বিক্রি জেলা সদর ও কিছু মহকুমায় • ডিলার প্রয়োজনের চেয়ে কম • চাহিদা মতো বীজ মজুত নেই

প্রশ্ন তুলছেন বীজ ব্যবসায়ীরাও। তাঁরা জানাচ্ছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে যদি পুরনো নোটে বীজ বিক্রি লে তাঁদের মারা পড়তে হবে। গাঁটের কড়ি খরচ করে তাঁরা পঞ্জাব থেকে আলু বীজ এনেছেন। আলু এমনিতেই পচনশীল। বিক্রি না হলে তাঁদের ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়তে হবে।

শুধু, বীজ নয়, চাষের জন্য চাই সার ও কীটনাশকও। সমবায় সমিতি থেকে সার বিক্রি হলেও কীটনাশকের বেশির ভাগটাই বিক্রি হয় বেসরকারি দোকান থেকে। সমবায় সমিতিগুলি পুরনো নোট নিতে পারছে না।

কৃষি দফতরের যে রিপোর্ট নবান্নে মন্ত্রীর কাছে জমা পড়েছে সেখানে যাচ্ছে, বীজ এবং সার কিনতে পারছেন না চাষিরা। এখন পর্যন্ত ৬০% আলুর বীজ বোনা হয়েছে। ৪০% বীজ টাকার অভাবে লাগানো সম্ভব হয়নি। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বীজ লাগানো না হলে আলুর ফলন কম হবে। আর উৎপাদন কম হলে দাম নাগালছাড়া হওয়ার আশঙ্কা। পূর্ণেন্দুবাবু বললেন, ‘‘কেন্দ্রের নতুন ঘোষণার যে কী অর্থ তা-ই বুঝতে পারছি না। চাষিদের মধ্যে এত বিপুল পরিমাণে বীজ বিক্রির পরিকাঠামো আমাদের নেই। কেন্দ্রের নিত্যনতুন ঘোষণায় সমস্যা বাড়ছে।’’

এই অবস্থায় দিল্লি থেকে কৃষি মন্ত্রকের তিন আধিকারিক মঙ্গলবার কলকাতায় আসেন। প্রথমে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার এবং দফতরের সচিবদের সঙ্গে সমস্যা নিয়ে বৈঠক করেন। পরে তাঁদের নদিয়ায় নিয়ে গিয়ে চাষিদের সমস্যা সরেজমিনে দেখানো হয়। কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, আজ, বুধবার তাঁরা কৃষি দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে আরও এক দফা বৈঠক করবেন।

সমস্যা শুধু রবি চাষে নয়। কৃষি দফতরের রিপোর্ট বলছে, প্রায় প্রতিটি জেলায় কৃষকরা খুচরো টাকার অভাবে ধান কাটতে পারছেন না। যন্ত্র ভাড়া করে চাষের কাজে লাগাতে পারছেন না। বন্ধ ‘লেবার পেমেন্ট’ও।

কৃষিমন্ত্রীর আশঙ্কা, ‘‘এমন চললে খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে।’’ মন্ত্রীর দাবি, অবিলম্বে ব্লকে ব্লকে বিশেষ শিবির খুলে পুরনো ৫০০ টাকার নোটে বীজ ও সার কেনা এবং চাষের সরঞ্জাম ভাড়া নেওয়ার অনুমতি দিতে হবে। রাজ্যের ৪টি কেন্দ্রীয় ও ২৬টি রাজ্য সরকারের বীজাগার থেকে ২৪ নভেম্বর মধ্যরাত পর্যন্ত পুরনো টাকায় বীজ কেনার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্র। ‘‘তার পরে কী হবে?’’ প্রশ্ন কৃষিমন্ত্রীর। জবাব হাতড়াচ্ছেন চাষিরা। এবং মোদী সরকারও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabi crops PM farmer
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE