Advertisement
০৬ মে ২০২৪
West Bengal News

কোন্দল সামলাতে নয়া ফর্মুলা, পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই ‘দলনেতা’ বসাচ্ছে তৃণমূল

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে ‘দলনেতা’ পদটির নাম আলাদা করে শোনা যায় প্রথম বার। তৃণমূল জানায়, জেলা পরিষদগুলিতে সভাধিপতি, সহ-সভাধিপতির পাশাপাশি আলাদা করে একজন দলনেতাও থাকবেন।

সব পক্ষকে তুষ্ট রাখার পথ খুঁজতে এ বার গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে আলাদা করে ‘দলনেতা’ নির্বাচন করা হচ্ছে। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

সব পক্ষকে তুষ্ট রাখার পথ খুঁজতে এ বার গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে আলাদা করে ‘দলনেতা’ নির্বাচন করা হচ্ছে। অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৮ ১৮:০১
Share: Save:

চিন্তা বিরোধীদের নিয়ে খুব একটা ছিল না। পঞ্চায়েতের আগে তৃণমূল নেতৃত্বের চিন্তা মূলত নিজেদের নিয়েই ছিল। গত কয়েকটা বছরে দল যে রকম হু-হু গতিতে বেড়েছিল বাংলার প্রতিটি প্রান্তে, সে ভাবেই বেড়েছিল দলীয় কোন্দলও। তার জেরে অনেক এলাকায় কণ্টকিত হতে পারে জয়ের পথ, বুঝেছিলেন নেতৃত্ব। ব্যালট পেপারে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ছাপ পড়া আটকাতে শাসক দলকে প্রবল কসরৎ করতে হয়েছে ভোটের আগে। এ বার তাই আগেভাগেই সতর্ক তৃণমূল। সব পক্ষকে তুষ্ট রাখার পথ খুঁজতে এ বার গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে আলাদা করে ‘দলনেতা’ নির্বাচন করা হচ্ছে।

পঞ্চায়েতের কোনও স্তরেই ‘দলনেতা’ নামের কোনও পদ আগে ছিল না। যে দল গরিষ্ঠ, সেই দলের সদস্যরা একজনকে দলনেতা নির্বাচিত করতেন ঠিকই। কিন্তু তাঁর পরিচিতি‘দলনেতা’ হিসেবে হত না। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকে বলা হত ‘প্রধান’। পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ‘সভাপতি’। জেলা পরিষদ স্তরে ‘সভাধিপতি’। এ ছাড়া থাকতেন ‘উপ-প্রধান’, ‘সহ-সভাপতি’ এবং ‘সভাধিপতি’। থাকতেন বিভিন্ন দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘কর্মাধ্যক্ষ’রাও। পঞ্চায়েতের তিন স্তরে পদ বলতে ছিল এগুলোই।

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে ‘দলনেতা’ পদটির নাম আলাদা করে শোনা যায় প্রথম বার। তৃণমূল জানায়, জেলা পরিষদগুলিতে সভাধিপতি, সহ-সভাধিপতির পাশাপাশি আলাদা করে একজন দলনেতাও থাকবেন। অর্থাৎ পরিষদীয় দলের নেতা হিসেবে যিনি নির্বাচিত হবেন, তিনিই সভাধিপতি হবেন, এমনটা নয়।

পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরেও ওই পদকে আলাদা করে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল।

আরও পড়ুন: টক্কর দু’দলের, কেন্দ্রে পরেশ

২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৪টি জেলা বিরোধীদের দখলে গিয়েছিল। জলপাইগুড়ি এবং উত্তর দিনাজপুর পেয়েছিল বামেরা। মালদহ এবং মুর্শিদাবাদ পেয়েছিল কংগ্রেস। ওই চার জেলা পরিষদে কিন্তু আলাদা কোনও দলনেতা ছিলেন না। প্রথা মতো পরিষদীয় দলের নেতাকেই সভাধিপতি পদে বসিয়েছিল কংগ্রেস এবং বামেরা। পরে অবশ্য ওই চার জেলা পরিষদও শাসকের দখলে চলে যায়। আর এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনও জেলাই বিরোধীরা দখল করতে পারেনি। ফলে সব জেলা পরিষদেই সভাধিপতি, সহ-সভাধিপতি পদের পাশাপাশি পৃথক একজন দলনেতা নির্বাচন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে এ বার।

তবে, এ বার আর শুধু জেলা পরিষদে সীমাবদ্ধ থাকছে না দলনেতা পদটি। পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরেও ওই পদকে আলাদা করে তুলে ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল। বোর্ড গঠনের আগেই সর্বত্র দলনেতা নির্বাচন সেরে ফেলছে রাজ্যের শাসক দল।

উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতি তথা রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বললেন, ‘‘আমরা দলনেতা নির্বাচন সেরে ফেলেছি। জেলার ৯০টা গ্রাম পঞ্চায়েতে আপাতত বোর্ড গঠন করা যাবে। বোর্ড গঠন করা যাবে৫টা পঞ্চায়েত সমিতিরও। বাকিগুলো মামলার কারণে আপাতত হবে না। ৯০ গ্রাম পঞ্চায়েতে আমাদের টিকিটে নির্বাচিত সদস্যদের ডেকে নিয়ে বৈঠক করে আমরা দলনেতা নির্বাচন করে দিয়েছি। ৫টা পঞ্চায়েত সমিতিতেও দলনেতা নির্বাচন সারা।’’

প্রায় একই কথা শোনা গেল বীরভূমের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের মুখেও। তিনি বিশদ হিসাবে গেলেন না। বললেন, ‘‘আমার এখানে সব সারা। দলনেতা নির্বাচনও হয়ে গিয়েছে। কে প্রধান, কে উপ-প্রধান, কে সভাপতি, কে সহ-সভাপতি— সব আমরা ঠিক করে ফেলেছি। কাজ কমপ্লিট।’’

প্রশ্ন হল, প্রথমে জেলা পরিষদে এবং তার পরে পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে আলাদা করে দলনেতা রাখার পথে তৃণণূল হাঁটল কেন? বিজেপি, বামফ্রন্ট বা কংগ্রেস যে সব বোর্ড পেয়েছে, সেখানে তো এ ভাবে দলনেতা রাখার প্রয়োজন পড়ছে না। এই প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের কেউই সোজাসাপটা জবাব দিতে চাইছেন না। ঘুরিয়ে জবাব দিচ্ছেন বা নিজের নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

আরও পড়ুন: ঝুলেই রইল পঞ্চায়েত-রায়, ভোট কি অবৈধ? প্রশ্ন আদালতের

জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলছেন, ‘‘দলনেতা আবার নতুন পদ কোথায়? এ পদ তো ছিলই। বোর্ড গঠনের ভোটাভুটির আগে তো সব দলকেই নিজেদের দলনেতা নির্বাচিত করতে হয়।’’ উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূলের সভাপতির এই ব্যাখ্যায় ভুল কিছু নেই। দলনেতা সব দলকেই নির্বাচিত করতে হয়। কিন্তু যিনি দলনেতা হন, তিনিই তো প্রধান বা সভাপতি বা সভাধিপতি হন। অর্থাৎ ওই পদকে আলাদা করে কখনও তো তুলে ধরা হয় না। জ্যোতিপ্রিয় বললেন, ‘‘না না, তা বললে কী করে হবে। দলনেতাই যে প্রধান বা সভাপতি বা সভাধিপতি হবেন, এর কোনও মানে নেই। দলনেতা পরিষদীয় দলকে নেতৃত্ব দেবেন, তিনি সমন্বয় করবেন, প্রশাসনিক কর্তারা পরিষদীয় দলকে কিছু জানাতে চাইলে দলনেতার মাধ্যমে জানাবেন। কেউ হুইপ অমান্য করে কাজ করছেন কি না, দলনেতা দেখবেন। কম কাজ নাকি! দলনেতা আলাদাই রাখতে হবে।’’

দলনেতা পদ যখন একটা রয়েছে, তখন সেটাকেও তো কাজে লাগাতে হবে: অনুব্রত মণ্ডল

আর অনুব্রত মণ্ডলের ব্যাখ্যা এ ক্ষেত্রেও সংক্ষিপ্ত এবং তাঁর নিজের মতো। তিনি বললেন, ‘‘দলনেতা পদ যখন একটা রয়েছে, তখন সেটাকেও তো কাজে লাগাতে হবে। শুধু শুধু পদটা ফেলে রাখার মানে হয় নাকি? সেই জন্যই পঞ্চায়েতের সব স্তরেই আমরা আলাদা করে দলনেতা ঠিক করে দিচ্ছি।’’

দাপুটে জেলা সভাপতিদের ব্যাখ্যা যা-ই হোক, তৃণমূলের অন্য অনেক নেতাই কিন্তু একান্ত আলাপচারিতায় স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, পঞ্চায়েতের তিন স্তরেই দলনেতা পদকে আলাদা করে তুলে ধরা হচ্ছে মূলত গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সামাল দেওয়ার জন্য। প্রায় সব এলাকাতেই দুই বা ততোধিক গোষ্ঠীতে ভাগাভাগি হয়ে রয়েছে তৃণমূল। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও অনেক অঞ্চলেই বোর্ডের দখল নেওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। তাই প্রধান বা সভাপতির সমান্তরাল গুরুত্বের পদ তৈরি করে সব গোষ্ঠীকে খুশি রাখার বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে নেতৃত্বকে। অর্থাৎ একটি গোষ্ঠীর হাতে যদি প্রধান পদ যায়, তা হলে অন্য গোষ্ঠীকে দলনেতা পদ দেওয়া হচ্ছে। তৃতীয় কোনও গোষ্ঠী থাকলে উপ-প্রধান পদ দিয়ে তুষ্ট করার চেষ্টা হচ্ছে। ফর্মুলা অনেকটা এ রকমই।

নতুন পদ তুলে ধরায় আরও একটা সুবিধা হচ্ছে। কোথাও সংরক্ষণের কারণে, কোথাও দলীয় ভাগাভাগির কারণে যোগ্য ব্যক্তিকে হয়তো প্রধান বা সভাপতি পদে বসানো সম্ভব হচ্ছে না। তাঁদের দলনেতা পদে বসিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হচ্ছে। অনেক এলাকায় আবার বয়সের কারণে জনপ্রিয় বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও নেতাকে প্রধান বা সভাপতি পদে বসানো যাচ্ছে না। দলনেতা করে তাঁদের সম্মান দেখানো হচ্ছে।

তবে দলনেতা পদটি নেহাৎ আলঙ্কারিক কিন্তু হচ্ছে না। তিন স্তরেই দলনেতাদের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রাখা হচ্ছে। প্রকল্প রূপায়ণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোর জন্য শেষ পর্যন্ত সভাধিপতি, সভাপতি বা প্রধানদের হস্তাক্ষরই দরকার পড়বে। কিন্তু পরিষদীয় দলের বৈঠক ডাকা, হুইপ জারি করা, সব অংশের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা বা প্রশাসনিক কর্তাদের (বিডিও, এসডিও, ডিএম) সঙ্গে যোগাযোগ রাখার মতো বিষয়গুলো দলনেতারাই সামলাবেন।

আরও পড়ুন: প্রকৃত কংগ্রেস’ হলে তৃণমূলে আসুন: অভিষেক

এই পদের জন্য কাদের বেছে নেওয়া হচ্ছে, তা-ও বিশদে বিশ্লেষণ করলেন জ্যোতিপ্রিয়। বললেন, ‘‘এলাকায় সবচেয়ে সিনিয়র নেতা বা সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা বা সর্বমান্য কোনও নেতাকেই আমরা দলনেতা করছি। যাকে-তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না।’’ গ্রাম পঞ্চায়েতগুলোর ক্ষেত্রে দলনেতারাই এ বার নিজেদের নিজের এলাকায় গিয়ে বৈঠক ডাকবেন বলে তিনি জানিয়েছেন। সেই বৈঠকেই পঞ্চায়েত সদস্যরা স্থির করবেন, কে প্রধান বা কে সভাপতি হবেন। জানিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।

(বাংলার রাজনীতি, বাংলার শিক্ষা, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার স্বাস্থ্য, বাংলার আবহাওয়া - পশ্চিমবঙ্গের সব টাটকা খবর আমাদের রাজ্য বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE