Advertisement
১১ মে ২০২৪
National News

‘২৫ বছরের রাজত্ব উপড়ে দিলাম, ইনি তো মাত্র ৭ বছর’

কলকাতায় বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ— ২৫ বছরের সরকার উপড়ে গেল, ইনি তো মাত্র ৭ বছর।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৪৬
Share: Save:

দলটাকে বড়বাজারের বাইরে বার করতে হবে— মুরলীধর সেন লেনে খুব পরিচিত এই কথাটা। বাংলার বিজেপি নেতাদের বার বার এ কথাটা বলতেন অটলবিহারী বাজপেয়ী। দল বড়বাজারের বাইরে বেরিয়েছে, গত কয়েক বছরে তো ভালই বেরিয়েছে। কিন্তু দলটার গায়ে বাঙালি ছাপ আরও স্পষ্ট করে আঁকতে চান বিজেপি নেতৃত্ব। সেই লক্ষ্যে অন্যতম হাতিয়ার ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব। তোড়জোড় প্রায় চূড়ান্ত। তেমনই এক সন্ধিক্ষণে কলকাতায় বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ— ২৫ বছরের সরকার উপড়ে গেল, ইনি তো মাত্র ৭ বছর।

ত্রিপুরায় ন’মাস আগে পতন ঘটেছে ২৫ বছরের পুরনো বাম সরকারের। উত্তর-পূর্বের বাঙালি প্রধান রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন বিপ্লব দেব। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক নানা বিতর্ক বিপ্লবকে ঘিরে, বিতর্ক ত্রিপুরার প্রথম বিজেপি সরকারকে ঘিরে। সল্টলেকের ত্রিপুরা ভবনে বসে বিপ্লব দেব কিন্তু প্রায় প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তরেই ওভার বাউন্ডারি হাঁকানোর চেষ্টা করলেন।

মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নানা বিষয়ে আপনার একের পর এক মন্তব্য নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছে। সে বিষয়ে কী বলবেন?

‘‘হ্যাঁ, বিতর্ক হয়েছে। তবে ওগুলো মিডিয়ার তৈরি করা বিতর্ক।’’ বললেন বিপ্লব। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, যে বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছিল, তার অনেকগুলোতেই পরে নিজেদের কথা গিলে নিতে হয়েছে মিডিয়াকে। মুচকি হেসে বিপ্লব বলেন, ‘‘একটা বিষয় তো প্রমাণিত হল, পশ্চিমবঙ্গে যে ভাবে মিডিয়ার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে, আমাদের ত্রিপুরায় তা হচ্ছে না।’’

কলকাতায় বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চ্যালেঞ্জ বিপ্লবের। নিজস্ব চিত্র।

বামেরা ত্রিপুরায় হারা মাত্রই যে ভাবে লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলা হয়েছিল, সেটা কি উচিত কাজ ছিল?

বিপ্লব বললেন, ‘‘আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন? মানিক সরকারকে জিজ্ঞাসা করুন। তখনও আমি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিইনি। মানিক সরকারই তদারকি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালাচ্ছিলেন।’’

আরও পড়ুন: ‘শিক্ষিকা হয়ে এত গয়না কোথা থেকে পেলেন?’ শোভন-বৈশাখীকে একহাত দুলালের

শুধু লেনিনের মূর্তি ভাঙা তো নয় বিপ্লববাবু, সিপিএমের একের পর এক পার্টি অফিসও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে!

বিপ্লব দেব এ বার আরও সপ্রতিভ। বললেন, ‘‘হ্যাঁ, ভেঙে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিজেপি ভাঙেনি।’’

তা হলে? কে ভাঙল?

‘‘আমি ভেঙেছি। সরকারি জায়গা বেআইনি ভাবে দখল করে পার্টি অফিস বানিয়ে রেখেছিল। আমি প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছি, সরকারি জমি দখলমুক্ত করতে। যেগুলো সরকারি জমিতে ছিল না, সেগুলো ভাঙিনি। ত্রিপুরায় এখনও সিপিএমের আট-নশো পার্টি অফিস রয়েছে। দেখে আসুন।’’

লেনিন মূর্তিই হোক বা বিরোধী দলের পার্টি অফিস, সরকারই ভাঙুক বা বিজেপি— এতে কি মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবের সুনাম বাড়ছে? বিপ্লব নিজে যা-ই বলুন, গোটা দেশের মিডিয়ার সামনে ত্রিপুরার পরিস্থিতির ফলাও প্রচার করছে সিপিএম। তাতে বিপ্লবকে তথা বিজেপি সরকারে ঘিরে বিতর্ক বাড়ছে বই কমছে না। আর সেই বিতর্কের দিকে আঙুল দেখিয়েই বাংলার সিপিএম নেতারা এখন বলতে শুরু করেছেন— বিজেপি সরকারের পাঁচটা বছর কাটতে দিন, ফের ফিরছে বামফ্রন্ট, ঠিক যে ভাবে ১৯৮৮-তে ক্ষমতায় ফেরা কংগ্রেসকে ১৯৯৩-তেই ছুড়ে ফেলেছিল বামফ্রন্ট।

ত্রিপুরায় রেশন বিতরণ করছেন মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব। ফাইল চিত্র।

হেসে ফেললেন বিপ্লব দেব। বললেন, ‘‘সবে তো ন’মাসের সরকার। এর মধ্যেই এত কিছু ভেবে ফেললেন সিপিএম নেতারা?’’ তার পরে বিশদ ব্যাখ্যায় গেলেন ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী। কী কী প্রশাসনিক পদক্ষেপ করেছেন, পরিকাঠামোর উন্নয়ন কী ভাবে ঘটাচ্ছেন, উন্নয়নে গতি আনতে কী ভাবে পঞ্চায়েত সচিবদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সরাসরি যোগাযোগ রাখছে, কী ভাবে সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এনেছেন, সরকারি কাজের বরাতে দুর্নীতি রুখতে কী ভাবে ই-টেন্ডার চালু করে দিয়েছেন— একে একে মেলে ধরলেন ফিরিস্তি। তার পরে সদ্য শেষ হওয়া পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের হিসেবটা তুলে ধরলেন। আর ততোধিক আত্মবিশ্বাস নিয়ে জানালেন, পুরসভাগুলি নির্বাচন আসছে, একটা আসনেও জিতবে না বামেরা।

আরও পড়ুন: স্থগিতাদেশ জারি ডিভিশন বেঞ্চের, কোর্টেই ফের আটকাল বিজেপির রথের চাকা

কেন জিতবে না? ন’মাসের মধ্যে সিপিএম কি মুছে গেল নাকি?

‘‘হ্যাঁ, মুছেই গেল।’’ বললেন বিপ্লব। ‘‘নীচের তলায় কোনও লোকজন নেই। সিপিএমের লোকজন দলে দলে বিজেপি-তে চলে এসেছেন। এখনও আসছেন।’’

তা হলে তো ঘোর বিপদ বিপ্লববাবু! বিরোধী দলগুলি থেকে ঝেঁটিয়ে লোক ভাঙিয়ে এনে তৃণমূলে এখন যে রকম ঠাঁই নাই-ঠাঁই নাই রব, যে ভাবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে একের পর এক প্রাণ ঝরার অভিযোগ উঠছে, ত্রিপুরায় বিজেপির সেই অবস্থা হবে না তো?

আবার সহাস্য জবাব ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর: ‘‘আমাদের দল আর তৃণমূলকে এক ভাববেন না। আমরা ভোটার লিস্টের প্রত্যেকটা পাতা ধরে ইউনিট বানিয়েছি। একটা পাতায় যত জনের নাম, তত জন ভোটাদের দায়িত্বে এক জন করে ‘পৃষ্ঠা প্রমুখ’। যে-ই দলে আসুন, যে দল থেকেই আসুন, ওই কাঠামোর মধ্যে থেকে তাঁদের কাজ করতে হয়। এসেই কেউ নেতা হয়ে যান না।’’ বিপ্লবের প্রশ্ন, ‘‘তৃণমূল জীবনে ওই কাঠামো তৈরি করতে পারবে? যদি পারত, এত মারামারি হত?’’

এ হেন ঘোর আত্মবিশ্বাসী বিপ্লব দেবকেই বাংলায় বেশি করে প্রচারে আনতে চাইছে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। রথযাত্রা হোক বা না হোক, বিভিন্ন রাজ্য থেকে তথা জাতীয় স্তর থেকে বিজেপির হেভিওয়েটরা এ বার ঘন ঘন যাতায়াত শুরু করবেন বাংলায়। কিন্তু এককালে যে বাংলায় বিজেপির পরিচিতি ছিল অবাঙালি ঘেঁষা দল হিসেবে, সেই বাংলায় শুধুমাত্র অবাঙালি হেভিওয়েটদের উপর নির্ভর করতে চাইছেন না শিব প্রকাশ-কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা। দেশের অপর একটি বাঙালি প্রধান প্রান্তও যে বিজেপির উপরেই ভরসা রেখেছে, তা বেশি করে তুলে ধরতে চাইছেন তাঁরা। অতএব বাঙালি মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেবকে দিয়ে বাংলার নানা প্রান্তে সভা করানোর আয়োজন এ বার।

বিজেপির রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কথা তো হয়েইছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বার্তা পৌঁছে গিয়েছে বিপ্লব দেবের কাছেও। তাই বিশেষ কাজে এক দিনের জন্য কলকাতায় এসেই বিপ্লব দেব শুক্রবার ত্রিপুরা ভবনে ডেকে নেন রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুকে। ক’টা সভা তাঁকে করতে হবে, কোন কোন এলাকায় করতে হবে, রথযাত্রা হলে কী ভাবে সময় দিতে হবে, বিকল্প উপায়ে যাত্রা বেরোলে কর্মসূচি কী রকম হবে— সে সব নিয়ে মিনিট পঁয়তাল্লিশ বিশদ আলোচনা করেন।

এ সবের ফাঁকেই ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে। প্রসঙ্গ ছিল বাংলার বিজেপি-কে দেখে তিনি কতটা আশাবাদী? ত্রিপুরার মতো ফল কি এ রাজ্যে হওয়া সম্ভব?

প্রথমে বিপ্লবের সাবধানী জবাব: ‘‘ত্রিপুরা ছোট রাজ্য, পশ্চিমবঙ্গ অনেক বড়। বেশি খাটতে হবে। কিন্তু অসম্ভব কিছুই নয়।’’

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিতিন গডকড়ীর সঙ্গে বিপ্লব দেব। ফাইল চিত্র।

কিন্তু বিপ্লববাবু, প্রতিপক্ষটা কে, সেটাও তো দেখা দরকার। মিতভাষী মানিক সরকারের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট আর দোর্দণ্ডপ্রতাপ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল তো এক নয়।

ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ফের সপ্রতিভ। বললেন, ‘‘ত্রিপুরায় কত বছরের সরকার ছিল, আর এখানে ক’বছর, সেটাও তো ভাবতে হবে। ২৫ বছর ধরে রাজত্ব করছিল ওখানে। তাদেরকে উপড়ে ফেলতে পারলাম। আর এখানে তো মাত্র সাত বছর।’’ বিপ্লবের ব্যাখ্যা, ‘‘দাদাগিরি-গুন্ডাগর্দির রাজত্ব মানুষ কিছুতেই মেনে নেন না। অত্যাচারের কারণে মুঘল গিয়েছে, অত্যাচারের কারণে ব্রিটিশ গিয়েছে। আর এখানে তো মাত্র সাত বছরের একটা সরকার।’’

এত আত্মবিশ্বাস!

স্মিত হেসে বিপ্লব বলেন, ‘‘বিশ্বাস হচ্ছে না তো? অমিত শাহও এক সময়ে বিশ্বাস করতে পারেননি। ত্রিপুরায় ক্ষমতায় আসার এক বছর আগে অমিতজিকে বলেছিলাম, আমাদের সরকার হচ্ছে। উনি বলেছিলেন— তোমাকে কি ভূতে পেয়েছে! বলেছিলাম বিশ্বাস রাখতে। ফলাফল সবার সামনে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE