বাঁ দিক থেকে নলিনীকান্ত সরকার, উমাপদ ভট্টাচার্য ও নজরুল ইসলাম।
সাদা পাথর দালানের কোণে একটা বসার টুল। অমন অদ্ভুতদর্শন আসবাব বড় একটা চোখে পড়ে না আজকাল। বহুকাল আগে তৈরি কাঠের সামান্য ওই টুলই কৃষ্ণনগরের গনাই পরিবারের অমূল্য সম্পদ। চারপুরুষ ধরে তাঁরা সযত্নে আগলে রেখেছেন সেটি।
জ্যৈষ্ঠ পড়লেই ওই টুল ঘিরে নানা স্মৃতি পাক মারতে থাকে কৃষ্ণনগর ছুতোরপাড়ার ৩০, উমাচরণ মুখার্জি লেনে গৌতম ও আরতি গনাইয়ের বাড়িতে। সে স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে এক নাম— কাজী নজরুল ইসলাম।
গনাই পরিবার সূত্রে জানা যায়, বাড়ির দুই ছেলে তারাচাঁদ এবং বসন্ত স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়েছিলেন। ১৯২১ সাল নাগাদ নজরুল এলেন কৃষ্ণনগরে। তারাচাঁদের সঙ্গে পরিচয় হল তাঁর। জলঙ্গির পাড়ে স্বদেশি আখড়ায় যাওয়ার পথে এক দিন তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এলেন তিনি। সে দিন ওই টুলেই বসেছিলেন কাজী।
সেই থেকে টুলটি যত্ন করে আগলে রেখেছে গনাই পরিবার। স্কুলশিক্ষিকা আরতি বলেন, “আজ থেকে সাতানব্বই বছর আগে কাজী সাহেব এসেছিলেন এ বাড়িতে। তখন আমরা কোথায়!” বাড়ির সামনে সাদা পাথরের ফলকে ওঁরা কবি-কথা খোদাই করেও রেখেছেন। কৃষ্ণনগর জজকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী গৌতম বলেন, “আমি মা-বাবা, পিসিমার মুখে শুনেছি। আমাদের মুখ থেকে ছেলেরা শুনছে।”
বছর দুই বাদে নজরুল যান মুর্শিদাবাদে— ১৯২৩ সালের মে মাসে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ লিখে তিনি তখন ইংরেজের বিষ নজরে। রাজদ্রোহের অপরাধে কারারুদ্ধ। হুগলি জেল হয়ে তাঁর ঠাঁই হল বহরমপুর জেলে। দু’নম্বর সেলে বসে লিখে চললেন একের পর এক কবিতা। যার বেশির ভাগ পরবর্তী কালে ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যগ্রন্থে স্থান পায়। ডিসেম্বরে মুক্তি পেলে কৃষ্ণনাথ কলেজের পড়ুয়ারা এসে হইহই করে কবিকে নিয়ে গেল তাঁদের হোস্টেলে। দেওয়া হল রাজকীয় সংবর্ধনা।
সেই শুরু। এরপর কবি যত দিন সুস্থ ছিলেন, তাঁর সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে থেকেছে এ জেলা। বহরমপুর, নিমতিতা, জিয়াগঞ্জ, লালগোলা। তাঁর বহু বিখ্যাত গানের জন্ম মুর্শিদাবাদে। লোক-গবেষক শক্তিনাথ ঝাঁ লিখছেন “মুর্শিদাবাদ জেলা নজরুল সঙ্গীতের যৌবনের উপবন ছিল।” নজরুল গবেষক প্রকাশ দাস বিশ্বাস জানান, বহরমপুরে কবির সখ্য গড়ে ওঠে বছর চারেকের বড় ‘ফেনু’ ওরফে উমাপদ ভট্টাচার্যের। হুগলিতে নিজের বাড়ি করার আগে পর্যন্ত কবি থাকতেন বহরমপুরে কাদাই এলাকায় তাঁরই আশ্রয়ে। অনেক নজরুলগীতির স্বরলিপিকার ছিলেন তিনি, পরে কবি যাকে তাঁর স্বরলিপি গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড উৎসর্গ করেছিলেন।
মুর্শিদাবাদে কাজীর অন্য ঘনিষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী শশাঙ্কশেখর সান্যাল এবং তাঁর খুড়তুতো ভাই নলিনাক্ষ সান্যাল। ছিলেন ‘দাদাঠাকুর’ শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, বিপ্লবী নলিনীকান্ত সরকার, ব্রজভূষণ গুপ্ত বা লালগোলার এম এন অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষক বরদাচরণ মজুমদার। এই বরদাচরণের কাছেই যোগাভ্যাস করতেন নজরুল। তাঁকে গুরু মেনেছিলেন। সাহিত্যিক নীহারুল ইসলামের কথায়, ‘‘পুত্র বুলবুলের অকালমৃত্যুর ব্যথা ভুলতে কবি লালগোলায় রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায় প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরে যেতেন। সেখানে প্রতিমার দুই পা শৃঙ্খলিত। জনশ্রুতি, এর পরেই কবি ধীরে-ধীরে তন্ত্রে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।
১৯২৩ সালে যা ছিল বহরমপুর জেল, এখন সেটি বহরমপুর মানসিক হাসপাতাল। বছরভর হুঁশ না থাকলেও আজ, ১১ জ্যৈষ্ঠ নজরুলের জন্মদিনে সেই কারাকক্ষে নিয়মরক্ষার ধূপ জ্বলবে।
সঙ্গের ছবিটি সংগৃহীত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy