Advertisement
১০ মে ২০২৪

অনিলায়ন থেকে ভূমিসংস্কার, ত্রুটি স্বীকারে বিস্ফোরক বুদ্ধ

বামফ্রন্টের সরকারের আমলে হামেশাই অভিযোগ করতেন বিরোধীরা। সংবাদমাধ্যমে চর্চা হতো বিস্তর। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার ১০ বছরে তিনিও দলের অন্দরে বেশ কয়েক বার সরব হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পৌনে চার বছরের মাথায় এ বার তাঁদের সরকারের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে খোলাখুলি এমন কিছু ভুলের কথা নথিভুক্ত করালেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যার বেশ কয়েকটিকেই বাম রাজনীতিতে রীতিমতো বিস্ফোরক বলে ধরা হচ্ছে!

সন্দীপন চক্রবর্তী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৫
Share: Save:

বামফ্রন্টের সরকারের আমলে হামেশাই অভিযোগ করতেন বিরোধীরা। সংবাদমাধ্যমে চর্চা হতো বিস্তর। এমনকী, মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকার ১০ বছরে তিনিও দলের অন্দরে বেশ কয়েক বার সরব হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পৌনে চার বছরের মাথায় এ বার তাঁদের সরকারের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে খোলাখুলি এমন কিছু ভুলের কথা নথিভুক্ত করালেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, যার বেশ কয়েকটিকেই বাম রাজনীতিতে রীতিমতো বিস্ফোরক বলে ধরা হচ্ছে!

যেমন:

স্বীকারোক্তি ১: ‘ভূমি সংস্কার ও গ্রামোন্নয়নের কর্মসূচি এক ধরনের স্থিতাবস্থায় পৌঁছেছিল। কী হবে কার্যকর বিকল্প, তা সব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট করা যায়নি।’

স্বীকারোক্তি ২: ‘কৃষি উৎপাদনে কিছু সাফল্য এসেছিল ঠিকই। কিন্তু আরও কিছু কাজ করার ছিল। কৃষিপণ্যের সংরক্ষণ ও তাকে বাজারজাত করার প্রশ্নে দুর্বলতা ছিল’।

স্বীকারোক্তি ৩: ‘পঞ্চায়েতে কিছু কিছু জায়গায় শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির বদলে সঙ্কীর্ণ মানসিকতার বিস্তার, স্বজনপোষণ এবং কম হলেও দুর্নীতি সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের দূরত্ব বাড়িয়েছে’।

স্বীকারোক্তি ৪: ‘অনেক সাফল্য সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পরিকাঠামোর অপ্রতুলতা ছিল। তার ফলে সমস্যাও ছিল। বিশেষত, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র-সহ সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবার গুণমান রক্ষা করা মানুষের চাহিদা অনুযায়ী করা সম্ভব হয়নি’।

স্বীকারোক্তি ৫: ‘গ্রামাঞ্চলে ও শহরাঞ্চলে কিছু কিছু জায়গায় নাগরিক জীবনে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপও সাধারণ মানুষ ভাল ভাবে নেননি’।

স্বীকারোক্তি ৬: ‘শিক্ষায় রাজনীতিকরণ সব ক্ষেত্রে এড়ানো যায়নি। কিছু অবাঞ্ছিত পদক্ষেপও ছিল’।

বুদ্ধবাবুর লেখা যে দলিল প্রকাশ্যে আনা নিয়ে এখন সিপিএমের অন্দরে বিতর্ক চলছে, তারই পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে এমন সব স্বীকারোক্তি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, অতীতের ভুলভ্রান্তির কথা আন্তরিক ভাবে এবং নতমস্তকে মেনে নিয়ে মানুষের কাছে যেতে। যাতে তাঁরা বুঝতে পারেন, মানুষের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ে অনেক ভাল কাজ করার পথে ঘটে যাওয়া ভুলগুলি থেকেও বামেরা শিক্ষা নিতে প্রস্তুত।

রাজ্যে শিল্পায়নের জন্য তাঁদের সরকারের নীতিতে যে ভুল ছিল না, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ছিল ‘ব্যতিক্রম’ এই প্রশ্নে তাঁর পুরনো প্রত্যয় বজায় রেখেছেন বুদ্ধবাবু। দলের সিংহভাগও এই ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তির পাশে। কিন্তু সেই অংশটুকু সরিয়ে রাখলে একই দলিলের আরও নানা অংশে যে সব ভুল বা ঘাটতির কথা খোলাখুলি কবুল করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বাম রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে বাধ্য। এর মধ্যে দলেরই একাংশ আলাদা করে চিহ্নিত করছে শিক্ষা ক্ষেত্রের রাজনীতিকরণ নিয়ে ওই দলিলের মূল্যায়নের কথা। বলা হচ্ছে, দীর্ঘ দিন পরে দলের মধ্যেই শিক্ষায় ‘অনিলায়নে’র বিরুদ্ধ মতকে স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করলেন সিপিএমের এই পলিটব্যুরো সদস্য। অনিলায়নের বিরুদ্ধে এটাই তাঁর ‘নীরব প্রতিবাদ’! মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে বুদ্ধবাবুর সঙ্গে মসৃণ সম্পর্ক ছিল সিপিএমের তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের। তাঁর অকালপ্রয়াত বন্ধু আর বুদ্ধবাবুর জন্মদিনও এক!

তবু তৃণমূল জমানায় শিক্ষায় চরম নৈরাজ্য নিয়ে যখন প্রতিদিন প্রতিবাদ জোরদার হচ্ছে, বিকাশ সিংহের মতো বিজ্ঞানী মুখ খুলছেন, সেই সময়ে দলের মধ্যে ‘অনিলায়নে’র ভুল কবুল করে পাপস্খালনের চেষ্টা তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি!

ভূমি সংস্কারের সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে নেওয়াকেও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে সিপিএমের একাংশ। ভূমি সংস্কার এবং পঞ্চায়েতি ব্যবস্থাকে সিপিএম চির কালই তাদের সরকারের অনন্য কৃতিত্ব মনে করে। বুদ্ধবাবুর লেখা ‘পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার: একটি পর্যালোচনা’ শীর্ষক খসড়া দলিলেও সেই কৃতিত্বের কথা বলা আছে। যুক্তফ্রন্ট সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং গণআন্দোলনের উপরে দাঁড়িয়ে কী ভাবে জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার ওই দুই কাজে এগিয়েছিল, তার অনন্যতা তুলে আনা হয়েছে দলিলে। কিন্তু একই সঙ্গে মেনে নেওয়া হয়েছে, ভূমি সংস্কারের সুফলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কাজ আর পুরোটা করে ওঠা যায়নি। এ যাবৎ কালে যা বামেদের কোনও আনুষ্ঠানিক নথিতে স্থান পায়নি!

বাম জমানার প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী এবং অধুনা সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা বলছেন, “গরিব কৃষককে জমি দেওয়ার কাজ করেই মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিল বামফ্রন্ট। তাই মূল লক্ষ্য আর ছোঁয়া সম্ভব হয়নি।” রেজ্জাকের বিশ্লেষণে, জমি বণ্টন, কৃষির বিকাশ এবং কৃষি বিপণন এই তিনটি কাজ সুসংহত ভাবে হলে গ্রামের মানুষের প্রকৃত উন্নয়ন হতো। কিন্তু বাম সরকার যে কৃষকদের হাতে ছোট ছোট জমি তুলে দিয়েছিল, তারাই পরবর্তী কালে সংসারের ভার বইতে না পেরে তাদের ক্ষুদ্র জমি তুলে দিয়েছিল তুলনায় বড়লোকদের হাতে। গ্রামের শ্রেণি চরিত্রই বদলে গিয়েছিল। আবার পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সেচ-সহ যে সব কাজ মন দিয়ে করলে উৎপাদনশীলতা বেড়ে ক্ষুদ্র কৃষকের উপকার হতো, তার বদলে অন্যান্য বিষয়ে মন দিতে গিয়ে দুর্নীতি বাসা বেঁধেছিল। রেজ্জাকের কথায়, “গরিব মানুষের সব চেয়ে বড় বন্ধু হওয়ার কথা ছিল বামফ্রন্টের। উল্টে এ সবের ফলে আমরাই শত্রু হয়ে গেলাম!”

দলের অন্দরে বুদ্ধবাবুরও যুক্তি, যে কাজের উদ্দেশ্য ঠিক ছিল কিন্তু প্রয়োগে ভুল হয়েছিল সেই খামতির কথা মুক্ত কণ্ঠে মেনে নেওয়াই ভাল। তাতে জনতার দরবারে বিশ্বাসযোগ্যতাই বাড়বে। রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে বুদ্ধবাবুর ঘনিষ্ঠ এক নেতার কথায়, “তবে এর মধ্যে কোনওটাকেই বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখা ঠিক নয়। শিক্ষায় যেমন কংগ্রেস আমলের নৈরাজ্য থেকে বামফ্রন্ট গণতন্ত্রীকরণের রাস্তা তৈরি করেছিল। কিন্তু তার মধ্যেই অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ঢুকে গিয়ে কিছু সমস্যা তৈরি করেছিল, এটাও সত্যি।” একই সঙ্গে ওই নেতা অবশ্য বলছেন, “তবে তৃণমূল জমানার কাজকর্মের সঙ্গে এ সবের কোনওটাই তুলনীয় নয়!”

এখন প্রশ্ন, বুদ্ধবাবুর হাত ধরে যে ভুল কবুল এবং তার থেকে শিক্ষা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে সিপিএমের অন্দরে, আলিমুদ্দিন সেই সাহস দেখাতে পারবে কি? রাজ্য কমিটির গত দু’দিনের বৈঠকে বেশ কিছু সদস্যই যে দলিল খুঁটিয়ে না দেখে সমালোচনা করেছেন, তা নজরে এসেছে দলের রাজ্য নেতৃত্বের। যে কারণে রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে বৈঠকে বলতে হয়েছে, সুললিত ভাষায় শুধু বক্তৃতা করলে হবে না! লিখিত ভাবে যুক্তি দিতে হবে। এখন দেখার, অনিলায়ন থেকে ভূমি সংস্কারের সীমাবদ্ধতা ভুল মেনে নিয়ে দল হিসাবে সিপিএম তাদের ভাবনায় পরিবর্তন আনতে পারে কি না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE