Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দল বদলের মধ্যে জব্বর লড়াই আসল-নকলের

নকল হইতে সাবধান! তা হলে আসল কে? সরকার গঠনের সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই প্রশ্নটা উঠে গেল। এবং আসল-নকলের দ্বন্দ্বে দীর্ণ তৃণমূলে, সে প্রশ্নটা সামনে এল বছরের প্রথম দিনেই। ঘটনাচক্রে যা দলের প্রতিষ্ঠা দিবসও।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৪
Share: Save:

নকল হইতে সাবধান!

তা হলে আসল কে?

সরকার গঠনের সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই প্রশ্নটা উঠে গেল। এবং আসল-নকলের দ্বন্দ্বে দীর্ণ তৃণমূলে, সে প্রশ্নটা সামনে এল বছরের প্রথম দিনেই। ঘটনাচক্রে যা দলের প্রতিষ্ঠা দিবসও।

বৃহস্পতিবার, বছরের প্রথম দ্বিপ্রহরেই নদিয়ার করিমপুর ফার্ম মোড়ে শ’তিনেক গজের ব্যবধানে দলের দুই গোষ্ঠী সভা করে ঘোষণা করেছে, ‘আসল’ তৃণমূল তারাই।

যেখানে প্রথম পক্ষ, মাইক ঠুকে ‘হ্যালো টেস্টিং... আসল তৃণমূলের সভায় যোগ দিয়ে সভা সাফল্যমণ্ডিত করুন’ বলার মিনিট দশেকের মধ্যেই ঢিল ছোড়া দূরত্বের জামতলা মোড় থেকে পাল্টা গোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ উড়ে এসেছে, ‘আসল তৃণমূল কারা, তা এই সভায় এসে দেখে যান’।

কোচবিহারের মাথাভাঙায়, আসল-নকলের লড়াইটা, দুই সভা থেকে মাইকে পারস্পরিক হুমকি গড়িয়েছে হাতাহাতিতে। নীরব দর্শক হয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরে দু-পক্ষকে নিরস্ত করতে এগিয়ে এসেছিল পুলিশ। তবে শাসক দলের দুই গোষ্ঠীর উত্তেজিত কর্মীদের হাতে পাঁচ পুলিশ কর্মী-সহ জখম অন্তত ১১ জন।

আসল-নকলের এই লড়াইয়ে দলে অস্বস্তি বেড়েছে। কিন্তু তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা ধরিয়ে দিচ্ছেন দলের অন্য এক রোগের কথা, “প্রতিষ্ঠা দিবসেই আসল-নকলের লড়াই লজ্জার। তবে গোষ্ঠী বিবাদের জেরে কর্মীদের অনেকেই দল বদলের পথে পা বাড়িয়েছে, ভয়ের সেটাই।”

শাসক দলে কোন্দল নতুন নয়। নতুন এটাই, আসল-নকলের নিরন্তর আকচাআকচিতে ‘বীতশ্রদ্ধ’ অনেকেই পা বাড়িয়ে রয়েছেন বিজেপি-র দিকে।

এ দিন যেমন, করিমপুর-১ ব্লক তৃণমূলের সভাপতি চিররঞ্জন মণ্ডল ও তাঁর অনুগামীদের সভায় এসেছিলেন মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। ভুলেও তিনি জামতলার সভার দিকে পা বাড়াননি। সেই সভার আয়োজক ব্লক তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি তরুণ সাহা এবং সাধারণ সম্পাদক সুশান্ত পালের দাবি, নেতা-মন্ত্রী এনে ‘আসল’ তৃণমূল কর্মীদের সভা ভরাতে হয় না। এই দড়ি টানাটানির মধ্যে দলের একাংশ কবুল করছেন, “এর চেয়ে বিজেপি ভাল। দলাদলি অন্তত নেই।”

বাম জমানার শুরু থেকেই করিমপুর বিধানসভা সিপিএমের দখলে। স্থানীয় দু’টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং সিংহভাগ গ্রাম পঞ্চায়েতও সিপিএমের দখলে। এমনকী, করিমপুর পান্নাদেবী কলেজে ছাত্র সংসদ টিএমসিপি-র দখলে থাকলেও তার দখল নিতে মরিয়া এবিভিপি। যার নেপথ্যে তৃণমূলেরই একাংশ বলে দলের খবর। জেলায় বিজেপি-র সদস্য সংখ্যা যে বাড়ছে, শাসক দলের জেলা নেতারাও তা মানছেন। এই প্রেক্ষিতে দলের প্রতিষ্ঠা দিবসে দু-পক্ষের ‘বিষোদ্গার’ যে নিচুতলার কর্মীদের আরও বিভ্রান্ত করবে, মেনে নিচ্ছেন জেলা তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা।

দলীয় কোন্দলে জেরবার বীরভূমেও যে পদ্ম-গন্ধ জোরালো হচ্ছে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের ঘনিষ্ঠ এক নেতাও তা কবুল করেছেন। তাঁর হিসেব, “গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের কারণে হৃদয় ঘোষ ও নিমাই দাসদের হাত ধরে যে দলবদল শুরু হয়েছিল সেই ধারা চলছে।” তিনি জানান, বাঁধনগ্রাম, গোপালনগর, কসবা, বিদ্যাধরপুর, দামোদরপুর, কেশবপুরে বহু তৃণমূল কর্মী বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। মাকড়ার লাগোয়া সাত্তোরে এখনও তৃণমূলের দাপট রয়েছে। কিন্তু লাগোয়া মহুলা, যাদবপুর, কেন্দ্রডাঙাল, সালন, বেলুটি জুড়ে বাড়ছে বিজেপির প্রভাব। নেপথ্যে দলের ‘নির্লজ্জ’ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ইলামবাজারের তৃণমূল নেতা শেখ সদাই কিছু অনুগামী নিয়ে বিজেপিতে ভিড়েছেন। বিজেপি-র এক জেলা নেতার কথায়, “একটু অপেক্ষা করুন, আরও চমক রয়েছে। তৃণমূলের আরও বড় মাপের জেলা নেতারা বিজেপিতে যোগ দেবেন অচিরেই।”

দলের জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি শেখ সুফিয়ানকে শো-কজের পরেই পূর্ব মেদিনীপুরেও তৃণমূলের পালে চেনা জোয়ার হারিয়ে গিয়েছে বলে দলীয় সূত্রেই খবর। ‘দলবিরোধী’ কাজের অভিযোগ উঠলেও সুফিয়ানের বিরুদ্ধে এই চিঠি-চাপাটি যে শাসক দলে গোষ্ঠী-কোন্দলের চেনা ছবি তা অধিকাংশ কর্মীর কাছেই স্পষ্ট। তাঁদের অনেকে তাই দলবদলের কথা ভাবছেন বলে কানাঘুষো। কর্মিসভায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বার্তা দিতে হচ্ছে, “আমরা সবাই এক। আমরা কিন্তু স্ট্রং। তাতে যদি কেউ মনে করেন অন্য পার্টিতে যাব, দরজা খোলা, যান।”

আসানসোল থেকে জিতে কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন বাবুল সুপ্রিয়। সেই আসানসোল-দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলে ‘কল্পতরু উৎসব’ ঘিরে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনে মতানৈক্য মাথাচাড়া দিয়েছে। বছরের প্রথম দিনে দুর্গাপুরে কল্পতরু উৎসব হয়। পরিচালনায় থাকে ক্ষমতাসীন দলের শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘দুর্গাপুর সাংস্কৃতিক মেলা কমিটি’। দলীয় সূত্রে খবর, এ বার আয়োজকের দায়িত্ব পেতে উঠে পড়ে লেগেছে দলের অন্য একটি গোষ্ঠী। ‘ব্যস্ত’ বলে এ দিন মেলায় আসেননি শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক। মেলা উদ্বোধন করে দুর্গাপুরের মেয়র অপূর্ব মুখোপাধ্যায় বলেন, “মেলা কমিটি থেকে কারও কারও সরে যাওয়ার কথা শুনেছি। তবে দলে না থাকতে চেয়ে কারও চিঠি পাইনি।”

আসানসোল-দুর্গাপুরের বিজেপি-র এক শীর্ষ নেতা বলেন, “প্রথমে গোষ্ঠীবিবাদ তার পরে দলত্যাগ, তৃণমূল-ত্যাগের এটাই চেনা রুট।” তাঁর দাবি, আসানসোলের বহু তৃণমূল নেতাই বিজেপির দিকে পা বাড়িয়ে।

সাড়ে তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পরে দলে কোন্দল পাকতে শুরু করেছিল সিপিএমে। তৃণমূলে আসল-নকলের লড়াইয়ে তা সাড়ে তিন বছরেই মালুম হচ্ছে। যার নেপথ্যে দলে ভাঙনের সুর শুনছেন কি নেতারা? প্রতিষ্ঠা দিবসে দলনেত্রীর টুইট, ‘ষোলো বছর বয়স হল দলের, সকলকে অভিনন্দন।’ দলের এক নেতার মন্তব্য, “ভাঙনের জেরে দলের বয়সটা ষোলোতেই না থমকে যায়!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

tmc bjp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE