Advertisement
১১ মে ২০২৪

অ্যামাজনে শঙ্কর

ঘাপটি মারা অ্যানাকোন্ডা। ডাঙায় ব্ল্যাক প্যান্থার। র‌্যাটেল স্নেকের কিম্ভুত আওয়াজ। মৃত্যুকে সিলি পয়েন্টে রেখে শঙ্কর ব্রাজিলের অ্যামাজনে। এই জুনেই। জানাচ্ছেন ইন্দ্রনীল রায় অ্যামাজন রেন ফরেস্টের ঠিক মাঝখানে তখন শঙ্কর। চারপাশে এমন জঙ্গল যে দুপুর দেড়টার সময়ও সন্ধে ছ’টার মতো অন্ধকার। সর্বক্ষণের সঙ্গী আকাশ ভাঙা বৃষ্টি।

শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০১৬ ০০:০৯
Share: Save:

অ্যামাজন রেন ফরেস্টের ঠিক মাঝখানে তখন শঙ্কর। চারপাশে এমন জঙ্গল যে দুপুর দেড়টার সময়ও সন্ধে ছ’টার মতো অন্ধকার। সর্বক্ষণের সঙ্গী আকাশ ভাঙা বৃষ্টি।

এমন পরিস্থিতিতে তিরিশ ফুটের অ্যানাকোন্ডার সঙ্গে চলেছে শঙ্করের মরণ-বাঁচন লড়াই।

এটা প্রথম ধাপ। অ্যানাকোন্ডাকে পরাস্ত করলেই যে শঙ্কর বেঁচে যাবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। সেখান থেকে পালাতে গিয়ে জলে শঙ্করকে ধাওয়া করে অ্যামাজনের সবচেয়ে বড় ‘প্রেডেটর’ ব্ল্যাক কেম্যান কুমির। অ্যামাজনের লক্ষ লক্ষ প্রাণীর মধ্যে যাকে বলা হয় সবচেয়ে বিপজ্জনক। সেই ব্ল্যাক কেম্যান থেকে বেঁচেও রেহাই নেই। এর পরেই তাকে ধাওয়া করে জাগুয়ারের দল। তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে হিংস্র ব্ল্যাক প্যান্থার।

এখানেই শেষ নয়! সবশেষে তাকে বাঁচতে হবে ৯০০ ভোল্টের কারেন্ট তৈরি করতে পারা ইলেকট্রিক ইল-এর থেকে।

এ ছাড়া প্রতিটা পদক্ষেপে রয়েছে র‌্যাটেল স্নেকের ছোবলের ভয়। এমন ছোবল যা খেলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে মৃত্যু অবধারিত।

এছাড়াও পুরো অ্যাডভেঞ্চারে তার সর্বক্ষণের সঙ্গী ট্যারেন্টুলার মতো বিষাক্ত মাকড়সা, মানুষ-খেকো পিরানহা আর অজস্র বুলেট অ্যান্ট।

ওয়েলকাম টু অ্যামাজন।

দ্য ডেথ ফরেস্ট।

বাজেট এ বার কুড়ি কোটি

ওপরের কোনওটা ফিকশন নয়, পুরোটাই চিত্রনাট্যের অংশবিশেষ। দুর্গমতম অ্যামাজনেই হতে চলেছে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’‌য়ের অনুপ্রেরণায় কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবির শ্যুটিং।

আফ্রিকার ‘চাঁদের পাহাড়’‌য়ের সিকুয়েল। যদিও পোশাকি নাম ‘শঙ্করের অ্যামাজন অভিযান’। মৌলিক এই গল্পটা গত দেড় বছর ধরে লিখেছেন কমলেশ্বর নিজেই।

শঙ্করের চরিত্রে? এ বারও দেব। শ্যুটিং শুরু জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে। মুক্তি এ বছর ২২ ডিসেম্বর। যা খবর, ‘শঙ্করের অ্যামাজন অভিযান’ই হতে চলেছে আজ অবধি হওয়া সবচেয়ে বড় বাজেটের বাংলা ছবি। গতবার ‘চাঁদের পাহাড়’‌য়ের বাজেট ছিল ১৫ কোটি। এ বার তার থেকে ৫ কোটি টাকা বেশি ধার্য করা হয়েছে। মোট বাজেট ২০ কোটি। প্রযোজনায় ভেঙ্কটেশ ফিল্মস।

কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের অন্দরমহলে ২০ কোটির বাজেটের থেকেও বেশি আলোচনা চলছে অ্যামাজনের শ্যুটিংকে ঘিরে থাকা নানা মৃত্যুফাঁদের।

মা-কে কিছু বলিনি

পুরো শ্যুটিং নিয়ে অসম্ভব উত্তেজিত দেব নিজেও। গত তিন মাস ধরে জিমে যাচ্ছেন রোজ। খাওয়া-দাওয়ার ওপর পুরো কনট্রোল এনে ফেলেছেন। টলি ক্লাবে রোজ চলছে সাঁতার। ট্রেনিং চলছে ঘোড়ায় চড়ারও। আর কিছুতেই অ্যামাজনে শ্যুটিংয়ের কথা বলছেন না নিজের মা-কেও।

‘‘মা সে দিন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, ‘আচ্ছা আফ্রিকাতে যেমন সিংহ আর হাতি ছিল, এখানে কী কী জন্তু-জানোয়ার আছে?’ যত বার মা জিজ্ঞেস করছিল, তত বার আমি কথাটা ঘুরিয়ে দিচ্ছিলাম। অ্যানাকোন্ডা, জাগুয়ার, প্যান্থার, অ্যালিগেটর! সঙ্গে প্রায় চারিদিকে র‌্যাটেল স্নেক। এ সব কেউ বলে? তবে এই স্টোরিটা বেরোবার পর অসম্ভব টেনশন শুরু হবে বাড়িতে। আমি মৃত্যুকে সত্যি ভয় পাই না। ‘চাঁদের পাহাড়’‌য়ের শ্যুটিংয়ে মৃত্যুকে সামনা সামনি অনেকবার দেখেছি। ঘোড়া থেকে পড়ে প্রায় মরতে বসেছিলাম একটু এ দিক ও দিক হলেই। তখন ২৫ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন সেলিব্রেট না করে আমার ছবিতে মালা পরাতে হত,’’ গম্ভীরভাবে বলেন দেব।

দেবের কাছ থেকেই জানা গেল, এখন তাঁর প্রতিদিনের রুটিন বাড়ি ফিরে অ্যামাজনের জন্তু-জানোয়ার নিয়ে পড়াশোনা করা।

‘‘প্রত্যেকটা সাঙ্ঘাতিক ভয়ঙ্কর বন্য জন্তু। একটু এ দিক ও দিক হলেই সব শেষ। আমি নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করছি। এটা বুঝেছি ক্যামেরার সামনে তো সতর্ক হতেই হবে, আসল সতর্কতা রাখতে হবে বাকি সময়টাতেও। জঙ্গলে যে কোনও সময় যা ইচ্ছে হতে পারে। প্রত্যেকটা ‘বুলেট অ্যান্ট’, প্রত্যেকটা ‘পিরানহা’ আপনাকে শেষ করে দেওয়ার জন্য ওত পেতে রয়েছে,’’ বলেন ঘাটালের এমপি। বুঝতে পারি এক্সাইটমেন্টের পাশাপাশি গলায় রয়েছে স্পষ্ট টেনশন।

অ্যামাজনকে কনট্রোল করা যায় না

একই রকম উত্তেজিত কমলেশ্বরও। ‘‘ধুর, ধুর, অ্যামাজনের সামনে আফ্রিকার জঙ্গল কিছুই না। আফ্রিকাতে সিংহ, হাতি, ব্ল্যাক মাম্বা ছিল ঠিকই। কিন্তু মনে রাখবেন সেখানে অ্যানিম্যাল ফার্মের ছড়াছড়ি। জন্তু-জানোয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার অত্যাধুনিক ব্যবস্থা আছে। আমরা ওই ফার্মগুলো থেকে জন্তু-জানোয়ার নিয়ে শ্যুটিং করেছিলাম। পুরো ব্যাপারটার উপর একটা কনট্রোল ছিল। অ্যামাজনে এমন কিছু নেই। অ্যামাজনকে কনট্রোল করা যায় না। যে জন্তু-জানোয়ারদের সঙ্গে আমরা শ্যুটিং করব, তাদের জঙ্গল থেকেই ধরে আনা হবে। শ্যুটিং শেষ হলে আবার জঙ্গলেই ছেড়ে দেওয়া হবে। অসম্ভব ডেঞ্জারাস শ্যুটিং। ছেলেখেলা তো নয়ই। একটু এ দিক ও দিক হলেই মৃত্যু,’’ বলে সিগারেট ধরালেন কমলেশ্বর।

জাগুয়ার

যদিও অ্যামাজন রেন ফরেস্ট দক্ষিণ আমেরিকার অনেকগুলো দেশকেই ছুঁয়ে যায়, কিন্তু এ ছবির জন্য শ্যুটিং সেই দেশে হবে, যে দেশে এই জঙ্গল দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সবথেকে বৃহৎ।

পেলের ব্রাজিল।

‘‘আমরা ব্রাজিলের মানাউস শহরে বেস ক্যাম্প করেই পুরো শ্যুটিংটা করব। ওটাই অ্যামাজন শুরু হওয়ার আগের শেষ শহর, তারপর থেকে পুরোটাই জঙ্গল। আর সত্যি সত্যি এমন কিছু দ্বীপে শ্যুটিং হবে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অ্যাটলাসেও যাদের কোনও চিহ্ন নেই। জিপিএস? গুগল ম্যাপ? সেখানে শুধুই ‘ডেটা নট ফাউন্ড’ ভেসে ওঠে। এ ছাড়াও কিছু প্রজাতির সঙ্গে শ্যুটিং আছে যারা একেবারে বাইরের মানুষ বা সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে অন্যতম ইয়ানোমামি ট্রাইব। এ ছাড়াও রয়েছে টুপি আর টাপুয়া ট্রাইবের সঙ্গে শ্যুটিং। আশা করি সব ভাল ভাবে হবে,’’ বলেন পরিচালক।

বাংলা সিনেমায় হলিউডের প্রোডাকশন ডিজাইনার

এত বিপজ্জনক শ্যুটিংয়ে যাতে কোনও ঝামেলা না হয়, সেই দিকেও নজর রয়েছে সবার। এবং সে জন্যই বাংলা ছবিতে এ বার দেখা যাবে হলিউডের প্রোডাকশন ডিজাইনারকে।

‘‘হ্যাঁ, আমাদের পুরো ছবির প্রোডাকশন ডিজাইনার হিসেবে রয়েছেন অস্কার রামোস। যিনি সেই বিখ্যাত হলিউডি ছবি ‘অ্যানাকোন্ডা’রও প্রোডাকশন ডিজাইনার ছিলেন। ওই ছবিটার কিছু লোকেশনেও আমরা শ্যুটিং করতে পারি,’’ বলেন কমলেশ্বর, যাঁকে তাঁর পুরনো পেশার জন্য ইন্ডাস্ট্রিতে অনেকেই বলেন ডাক্তারবাবু।

অন্য দিকে ২০ কোটি বাজেটের বাংলা ছবি করতে পেরে অসম্ভব খুশি প্রযোজক শ্রীকান্ত মোহতা। এটা তাঁদের প্রযোজনা সংস্থার একশতম ছবিও। ‘‘হ্যাঁ, এটা আজ অবধি করা আমার সবচেয়ে অ্যাম্বিশাস প্রোজেক্ট। তবে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি পুরো শ্যুটিংটা যেন শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়,’’ বলেন শ্রীকান্ত।

কিন্তু গত বার ‘চাঁদের পাহাড়’‌ দেখে অনেক সমালোচনাও হয়েছিল কম্পিউটার গ্রাফিক্সের। এ বার সেটা ঠিক করার জন্য কোনও উদ্যোগ কি নিচ্ছেন তাঁরা? ‘‘অবশ্যই নিয়েছি। এ বারে আমরা অনেক আগে থেকেই কম্পিউটার গ্রাফিক্সের ওপর মন দিচ্ছি। তবে একটা কথা বলব, আমাদের এখানে বাজেট হলিউডের মতো নয়। তাই একটু আধটু ভুল হলেও দর্শক যদি আমাদের মাফ করে দেন, তবে খুশি হব। এটুকু বলতে পারি, চেষ্টা করব কোনও ভুল না করার,’’ স্পষ্ট বলেন প্রযোজক। কথায় কথায় জানা গেল, দেব ছাড়াও এ ছবিতে অভিনয় করছেন সার্বিয়ার এক অভিনেত্রী। নাম স্বেতলেনা। এ ছাড়াও রয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার অভিনেতা ডেভিড জেমস। এই অভিযানে তাঁরাও শঙ্করের সঙ্গী। ছবির সিনেমাটোগ্রাফার আগের ছবির মতোই এ বারও সৌমিক হালদার।

বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ শেষ হয়েছিল ১৯১০ সালে। এই ‘অ্যামাজন অভিযান’‌য়ের সময়কালটা ঠিক কী? ‘‘‘শঙ্করের অ্যামাজন অভিযান’‌য়ের সময়কাল ১৯১৫। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরের বছর। আফ্রিকায় যেমন শঙ্কর হিরের পাহাড়ের খোঁজে গিয়েছিল, এখানে শঙ্কর যাচ্ছে এল ডোরাডো-তে সোনার খোঁজে। এটাই গল্পের প্রেক্ষাপট,’’ বলেন কমলেশ্বর।‘শঙ্করের অ্যামাজন অভিযান’‌য়ের গল্প ছাড়াও সে দিন আরও একটা রোমহর্ষক গল্প শুনিয়েছিলেন পরিচালক ।

কী গল্প?

‘‘আমরা রেকি করতে গেছি ব্রাজিলের অ্যামাজনে। ও রকম ঘন জঙ্গলে দশ মিনিট থাকলেই গা ছমছম করে। সরু ডিঙি করে ‘টিনটিন অ্যান্ড দ্য ব্রোকেন ইয়ার’‌য়ের প্রচ্ছদের মতো আমরা চলেছি। এর মধ্যেই দেখলাম একটা ফাঁকা জায়গা। দেখব আর কী! আমার চোখে তখন জল। দেখি ওইটুকু ফাঁকা জায়গায় দু’দিকে দু’টো গোলপোস্ট। দেখছি আর কাঁদছি। ওই জঙ্গলেও ফাঁকা জায়গা পেয়েই ওরা দু’টো গোলপোস্ট ঠিক বানিয়েছে। আরে, আফটার অল দেশটা তো ব্রাজিল,’’ বলে চশমা খুলে রাখেন কমলেশ্বর। সব মিলিয়ে টালিগঞ্জ এখন পুরোপুরি অ্যামাজনময়।

২০১৩। শঙ্কর তখন আফ্রিকায়। সঙ্গে ছিল একমাত্র আনন্দplus

এক দিকে ব্রাজিলের রোম্যান্স, অন্য দিকে সাঙ্ঘাতিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর তার পাশাপাশি প্রতি পদক্ষেপে মৃত্যুর হাতছানি।

সত্যি এ রকম অভিযান আগে দেখেনি বাংলা সিনেমা।

অ্যামাজনে শঙ্কর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE