Advertisement
E-Paper

ডনকে আবার ব্যাট ধরাতে

মৃত্যুর পনেরো বছর বাদেও ডন ব্র্যাডম্যান নিয়ে অস্ট্রেলীয় কৌতূহল কমা দূরে থাক বেড়েই চলেছে। হালফিল তাঁকে নিয়ে যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে তা তো নজিরবিহীন। দেখে এলেন গৌতম ভট্টাচার্যমৃত্যুর পনেরো বছর বাদেও ডন ব্র্যাডম্যান নিয়ে অস্ট্রেলীয় কৌতূহল কমা দূরে থাক বেড়েই চলেছে। হালফিল তাঁকে নিয়ে যে উদ্যোগ শুরু হয়েছে তা তো নজিরবিহীন। দেখে এলেন গৌতম ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১

শার্লক হোমস-পাঠক যদি হয়ে থাকেন, অ্যান্ড্রু লিমিংয়ের সঙ্গে আপনার ইতিমধ্যে পরিচয় হয়ে গিয়েছে!

অ্যান্ড্রু অবশ্য কাল্পনিক গোয়েন্দা কাহিনির কোনও চরিত্র নন, রক্তমাংসের মানুষ। অস্ট্রেলিয়ান ব্যবসায়ী। বহু বছর কাটিয়েছেন বস্টনে। কিন্তু লালচুলো, বড় মুখ আর ঠিক সেই টাইপ যে হাঁপাতে হাঁপাতে ২২১ বি বেকার স্ট্রিটে বেল বাজাতে থাকে। আর দরজা খোলার পর প্রথমেই বলে, ‘‘প্যাডিংটনে নেমে সোজা ট্যাক্সি করে এখানে চলে এসেছি। আমার খুব বিপদ মিস্টার হোমস।’’

অ্যান্ড্রু অবশ্য কোনও গোপন রহস্যজালে জড়িয়ে বিপন্ন নন। হোমসকাহিনির মতো জীবনের ঝুঁকিটুকিও তাঁর নেই। তিনি একান্ত বিপন্ন তাঁর প্যাশন নিয়ে। যে প্যাশনের উৎস ১৯০৮ সালে জন্মানো এক অস্ট্রেলীয়। ডন ব্র্যাডম্যান।

অ্যান্ড্রু লিমিংকে বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন আবিষ্কার করা গেল এমসিজি-র চার তলায়। অধীর আগ্রহে তাঁর থেকে দশ-পনেরো গজ দূরের এক বক্সের অধিবাসীর জন্য অপেক্ষারত। তাঁর নাম সচিন তেন্ডুলকর। লিমিংয়ের জীবনে যা পরিস্থিতি তাতে তেন্ডুলকর যদি ‘মিস্টার হোমস’ হতে রাজি থাকেন, তাঁর ব্র্যাডম্যান মামলার কিন্তু সুরাহা হয়ে যাবে।

যে কোনও ব্র্যাডম্যান-ভক্ত লিমিংয়ের ভিজিটিং কার্ড দেখলে চমকে উঠবেন। ৫২ শেফার্ড স্ট্রিট, বাউরেল।

ব্র্যাডম্যান জমানার এক ঐতিহাসিক দিকচিহ্ন হিসেবে বাড়িটা পরিচিত। ডন অনেক বেশি বছর কাটিয়েছেন তাঁর অ্যাডিলেডের বাড়িতে। কিন্তু ব্র্যাডম্যান চিন্তা-মনন-দর্শনে যেন এটাই তাঁর জোড়াসাঁকো। নিজের উপর ডকুমেন্টারির শ্যুটিং করতে বারবার এ বাড়িতেই এসেছেন। এমনকী নিজের ইচ্ছানুসারে তাঁর ভস্মও বাড়ির গজ কুড়ি-পঁচিশের মধ্যে এখানকার ওভালে ছড়িয়ে দেওয়া। সিডনি থেকে ১১৭ কিলোমিটার দূরে এই বাউরেলই আসলে ব্র্যাডম্যানের কৈশোরের লীলাভূমি। মৃত্যুপরবর্তী বারাণসী।

লিমিং বড় ব্যবসায়ী হতে পারেন কিন্তু হালফিল অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়ায় বারবার দেখা দিচ্ছেন ব্র্যাডম্যান সম্পত্তির প্রতিপালক হিসেবে। শেফার্ড স্ট্রিটের ক্রিকেট বিশ্বখ্যাত এই বাড়িটা বেশ কয়েক বছর আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। যে দম্পতি কিনেছিলেন তাঁর এর তাৎপর্য সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন না। হতেও চাননি। বছরখানেক আগে তাঁদের হাত থেকে এটা কিনে নিয়েছেন লিমিং। আর শুধু কিনেই নেননি। একটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞায় নেমেছেন।

মোহনবাগান যে বছর ইস্ট ইয়র্ককে হারিয়ে শিল্ড জেতে, ঠিক সে বছরই বাউরালে ঘাঁটি গাড়ে ব্র্যাডম্যান পরিবার। ৫২ শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়িতে তাঁরা কাটান ১৯১১-২৪। ব্র্যাডম্যানের জীবনে তিন থেকে ষোলো বছর। লিমিং কি না চাইছেন এই ২০১৫তে বসে বাড়িটাকে ঠিক ১০৪ বছর আগের পরিস্থিতিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে! আনন্দplus-কে মেলবোর্নের হোটেলে বসে বলছিলেন পুরনো ছবি দেখে গবেষণা করে তিনি সাবেকি চেহারার একটা স্কেচ তৈরি করতে পেরেছেন। এখন হুবহু সেই স্কেচ মেনে বাড়িটাকে বদলে দিচ্ছেন।

রং ইতিমধ্যে আগে যা ছিল তা করে দেওয়া হয়েছে। ভেতরে যেখানে ব্র্যাডম্যান ও তাঁর বোনেরা শুতেন, সেখানে বেডকভারের রং পর্যন্ত অবিকল সেই পুরনো আমলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

একটা ব্যালকনি সংযোজন করা হয়েছে যেটা পুরনো আমলে ছিল না। লিমিং সেটাকে ভেঙে ফেলেছেন। কোণে একটা বিখ্যাত জলের ট্যাঙ্ক ছিল। গৃহের প্রাক্তন অধিবাসীরা সেটা রাখার কোনও কারণ দেখেননি। কিন্তু লিমিং হলেন অকৃত্রিম ব্র্যাডম্যান- ভক্ত। তিনি জানেন ওই জলের ট্যাঙ্ক বাদ দিয়ে কিশোর ডন কখনও ‘ব্র্যাডম্যান’ হত কি না সন্দেহ। ব্র্যাডম্যান কাহিনিতে ওই জলের ট্যাঙ্কের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ ওই ট্যাঙ্কেই গল্ফ বল ছু়ড়ে একটা স্টাম্প দিয়ে সেটা ফেরাত কিশোর ডন। পরবর্তী কালে ব্র্যাডম্যান একাধিকবার বলেছেন সম্পূর্ণ আনঅর্থডক্স এই অনুশীলন তাঁকে ঐশ্বর্যশালী রিফ্লেক্স দিয়েছিল। ট্যাঙ্কটা তাই শুধু ফেরতই আসেনি, তার নীচে সিমেন্টের যেমন এবড়োখেবড়ো বাঁধুনি ছিল, সেটাও অবিকল ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

লিমিং বলেন, ‘‘আইডিয়া হল, অবিকল ১০৪ বছর আগের সময়কে ফিরিয়ে আনা। আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ব্র্যাডম্যান ঢুকে হা হয়ে বলবেন, এটাই তো আমার সেই পুরনো বাড়ি।’’

যেহেতু এই চ্যালেঞ্জে জেতার সুযোগ নেই, লালচুলো ব্যবসায়ী আরও একটা অসম্ভব চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তা হল, ৫২ শেফার্ড স্ট্রিটের গবেষণাগারে বসেই ব্র্যাডম্যান রসায়নের ফর্মুলা বার করা।

ডনের সঙ্গে খেলা জীবিত সমসাময়িকরা মনে করেন আইডিয়াটাই অবাস্তব। আর্থার মরিস-নীল হার্ভিদের মতে, ব্র্যাডম্যান প্রকৃতির আপন খেয়ালে উৎপন্ন এক জিনিয়াস। যার H2 + O2 = H2O জাতীয় কোনও ফর্মুলা খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু লিমিং শুনতেই রাজি নন।

ব্র্যাডম্যানখ্যাপা হিসেবে নিজের সঙ্গে পেয়েছেন সিডনি মাঠের প্রাক্তন ট্রাস্টি রডনি ক্যাভেলিয়ারকে। এঁরা দু’জনে এখন নেমে পড়েছেন ব্র্যাডম্যানের ডিএনএ খুঁজতে। গত দু’শো বছরে ব্র্যাডম্যান বংশের ইতিহাস গবেষণা করে এটা দেখেছেন ডনের শরীরে ইতালীয় রক্ত রয়েছে। তিনি মিশ্র বংশোদ্ভূত। ক্রিকেট ইতিহাসবিদ এবং সাংবাদিকেরা এত বছর মিলিত ভাবে যা জানাতে পারেননি, তা গবেষণায় বার করে ফেলেছেন এই জুড়ি।

এখন জানা যাচ্ছে ব্র্যাডম্যানের ঠাকুর্দার বাবা ছিলেন জাহাজি। ১৮২৬ সালে হল্যান্ড যাওয়ার জন্য তিনি জাহাজে উঠেছিলেন। ভুল জাহাজে উঠে পড়ায় তিনি সিডনি পৌঁছে যান। ঠিক জাহাজে উঠলে বিশ্বক্রিকেট হয়তো এই বিস্ময়কেই পেত না যাঁর টেস্ট গড় ৯৯.৯৪। গ্রেড ক্রিকেটে গড় ৮৬.৮। শেফিল্ড শিল্ডে গড় ১১০.১৯ এবং প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৯৫.১৪।

চার্লস ডেভিস নামক এক বিজ্ঞানী সর্বশেষ গবেষণায় বার করেছেন ডনের টেস্ট গড় ১০০ই হওয়া উচিত। স্কোরিংয়ের ভুলে ১৯২৮-২৯ অ্যাসেজ সিরিজের টেস্টে তাঁর একটা বাউন্ডারি নাকি জ্যাক রাইডারকে দিয়ে দেওয়া হয়। ওই বাউন্ডারিটা পেলে টেস্ট গড় ১০০ই দাঁড়ায়।

কিন্তু লিমিং বা ক্যাভেলিয়ার এ সব গড়টড় নিয়ে এই মুহূর্তে বিচলিত নন। ওই চারটা তাঁরই ব্যাটে ছিল কি ছিল না তার চেয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হল, ব্র্যাডম্যান রহস্যের উদ্ধার। এঁরা মনে করেন, জিনের মাধ্যমে ব্র্যাডম্যানের মধ্যে এমন অনেক কিছু প্রবাহিত হয়েছিল, যা তাঁর ঐশ্বরিক ক্রিকেটকীর্তিকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তাঁরা বার করেছেন ব্র্যাডম্যানের ঠাকুর্দা ছিলেন দুর্ধর্ষ শ্যুটার। শব্দ শুনে নিখুঁত গুলি করতে পারতেন। বাবা জর্জও শ্যুটার হিসেবে খারাপ ছিলেন না। ডনের বোনরা ভাল টেবিল টেনিস খেলতেন। ব্র্যাডম্যান নিজে ভাল শ্যুটার ছিলেন। এঁদের ধারণা, ক্রিকেট যেহেতু টিপের খেলা, এই শ্যুটিংয়ের পরম্পরা তাঁর ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করেছিল। জলের ট্যাঙ্কে প্র্যাকটিস দিয়েছিল রিফ্লেক্স। বাউরালের গ্রামীণ পরিবেশ দিয়েছিল মনোসংযোগ ক্ষমতা।

এঁদের মনে হচ্ছে কোনও কৈশোর ক্রিকেট প্রতিভাকে যদি একই প্রণালীর ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তা হলে কি কৃত্রিম ব্র্যাডম্যানের ডিএনএ তৈরি সম্ভব?

জন ব্র্যাডম্যান, স্বয়ং ব্র্যাডম্যান -পুত্র কী মনে করেন? উত্তর, তিনি এমন অসম্ভব চ্যালেঞ্জে বিশ্বাসী নন। জনের সমস্যা অন্য। বাউরালের ব্র্যাডম্যান জাদুঘরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আজও আহামরি নয়। অ্যাডিলেড ওভালে যত্নের সঙ্গে সাজানো ব্র্যাডম্যান কালেকশনের সঙ্গেও তিনি সম্পর্ক রাখেন না। বাকি পৃথিবী আসলে জনকে দেখে এক চিরসন্দেহবাদী, অত্যধিক খুঁতখুঁতে, খামখেয়ালি মানুষ হিসেবে। তাঁর অবশ্য কিছু আসে যায় না। তিনিই ডনের একমাত্র আইনানুগ উত্তরাধিকার। লিমিং যে শেফার্ড স্ট্রিটের বাড়িটাকে ১৯১১ সালে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন এতে ব্র্যাডম্যান-পুত্র যথেষ্ট প্রভাবিত। এর ফলে ক্রিকেট ট্যুরিস্টদের কাছে যে বাউরাল জাদুঘরের চেয়ে ডনের পুরনো বাড়ি অনেক বেশি আরাধ্য হিসেবে বিরাজ করবে তাতে তাঁর কোনও সমস্যা নেই। জন চান এই মডেল সফল হলে অ্যাডিলেডের বাড়িটাকেও একই রকম ভিনটেজ টাচ দেবেন।

আপাতত ২ হোল্ডিং স্ট্রিট, কেনসিংটন পার্কের পৃথিবী বিখ্যাত বাড়িটা তিনি তালা বন্ধ করে রেখেছেন। পঞ্চাশ দশকের এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমশ আরও জরাজীর্ণ অবস্থায় পৌঁছোচ্ছে। অথচ এখানেই রয়েছে ব্র্যাডম্যানের শেষ জীবনের যাবতীয় স্মারক। পুরনো চেহারায় বাড়িকে ফিরিয়ে আনতে আনুমানিক প্রয়োজন বারো কোটি টাকা। সরকারের কাছে জন বা লিমিং কেউই যেতে চান না। অস্ট্রেলীয় সরকার এক্ষুনি রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু তারপর পুরো সরকারই ঢুকে পড়বে।

তা হলে ভরসা কে? ভরসার নাম সচিন রমেশ তেন্ডুলকর।

বাউরাল জাদুঘরকে যেমন সম্প্রতি আবির্ভাবে আরও মহিমান্বিত করে দিয়েছেন তেন্ডুলকর। এই প্রকল্পেও কি তাঁকে পেতে পারেন লিমিংরা? বা জন নিজে?

এমসিজি বক্সের বাইরে অপেক্ষাটা তাই সচিনের জন্য। পুরনো বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, ব্র্যাডম্যান ডিএনএ ফেরত আনা— সবেতেই সচিনের সাহায্য দরকার। কী দাঁড়াল তা হলে?

ডনকে আবার ব্যাট ধরাতে তেন্ডুলকর।

Don Bradman Donald Bradman cricket Gautam Bhattacharya Sachin Tendulkar mcg cricket ground Melbourne Australia abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy