Advertisement
১১ মে ২০২৪

জয় মহারাষ্ট্র

‘ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো যে দিকে দুচোখ—যেতে তার খুশি লাগে খুব।’ কেন জানি না আজ লিখতে বসে আমার প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই পংক্তি দুটো ভীষণ মনে পড়ছে। কাল বিকেলে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ক’দিন ধরে আকাশে সেই জলভরা মেঘ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু মুম্বইয়ে এই মধ্য এপ্রিলে কখনও এ ভাবে ক্ষণিক বৃষ্টির উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। আজ এই ভিজে ভিজে নরম রোদ মাখা সকালে লিখতে বসে মনটা তাই হঠাৎই অনাবশ্যক রোমান্টিকতায় ভরপুর হয়ে উঠল।

পারমিতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০১
Share: Save:

‘ভালবাসা পেলে সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাবো যে দিকে দুচোখ—যেতে তার খুশি লাগে খুব।’ কেন জানি না আজ লিখতে বসে আমার প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই পংক্তি দুটো ভীষণ মনে পড়ছে। কাল বিকেলে হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। ক’দিন ধরে আকাশে সেই জলভরা মেঘ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। কিন্তু মুম্বইয়ে এই মধ্য এপ্রিলে কখনও এ ভাবে ক্ষণিক বৃষ্টির উচ্ছ্বাস চোখে পড়েনি। আজ এই ভিজে ভিজে নরম রোদ মাখা সকালে লিখতে বসে মনটা তাই হঠাৎই অনাবশ্যক রোমান্টিকতায় ভরপুর হয়ে উঠল।

লিখতে বসেছিলাম ‘মহারাষ্ট্র দিবস’ নিয়ে কিন্তু মনে হল যদি এ সময় রাজ পাশে থাকত! রাজ আমার রাজ। রাজের সঙ্গে সুধীজন, আপনাদের পরিচয় অনেক আগেই আমি করিয়ে দিয়েছি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মহাবালেশ্বর যাওয়ার পথে রাজের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তার পর যখনই পথের নেশায় বেড়িয়ে পড়েছি, রাজকে পেয়েছি আমার দোসর রূপে। আমার মনের দোসর সে—সবার অলক্ষ্যে সে আমার মনে বুলিয়ে দেয় দক্ষিণ হাওয়ার পরশ। আর কেউ তাকে দেখতে পায় না—শুধু আমার একান্ত আমারই মনের সাথী সে। আমি আর রাজ স্বপ্নের সাম্পানে চড়ে পাড়ি দিই কত অজানা পথ, যার সুলুক সন্ধান কেবল রাজই জানে।

আজকের সকালটা এও মায়াময়, এত সুন্দর—তার ওপর এই দিন নববর্ষের প্রথম দিন আপনারা যদিও লেখাটা কিছুদিন পর পড়বেন তাই হয়তো রাজকে ভীষণ কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল।

সেই জন্যই রাজকে নিয়ে মনে মনে বেরিয়ে পড়েছিলাম মুম্বইয়ের আনাচে কানাচে।

শহরের মধ্যে এমন জায়গা কোথায় আছে সেখানে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলা যায়। কোথায় রাজ কোথায়—তুমি এত নীরব কেন বলো আমায় বলো! মিষ্টি হাসে রাজ। ওর ভাসা ভাসা স্বপ্নালু দু’চোখ মেলে আমার দিকে তাকায় পূর্ণ দৃষ্টিতে। ওর দু’চোখের সম্মোহনে আবিষ্ট আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ওকে অনুসরণ করি।

মুম্বই শহরের একেবারে প্রাণকেন্দ্রে আমাকে নিয়ে চলে রাজ। রাজের সঙ্গে পথ চলা—সে এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতি কী করে বোঝাই আপনাদের। শহরের প্রাণকেন্দ্র অর্থাৎ একেবারে মেরিন ড্রাইভ দিয়ে চলতে চলতে এক প্রান্তে গিরগাঁও চৌপাট্টির কাছে এ কোথায় নিয়ে এলে রাজ?

রাজের মুখে সেই হাসি, সে হাসি বার বার মনে করিয়ে দেয়—আমি তো সঙ্গে আছি, ভয় কী তোমার?

ঠিকই তো, রাজ সঙ্গে আছে—ভয় কী? চোখ বন্ধ করলাম আমি—স্পর্শ করলাম তার করতল—বেশ তুমি আমায় যেখানে নিয়ে যাবে, আমি সেখানেই যেতে রাজি।

বড় রাস্তা থেকে কিছুটা ভেতরে ঢুকে লিফটে উঠলাম। লিফট থামতেই কয়েক পা হেঁটে রাজ বলল, এ বার চোখ খোলো।

চোখ খুলে আমি অবাক হয়ে গেলাম—আরে, এই মুম্বই শহরের জনারণ্যে এত উঁচুতে এমন চমৎকার এক মন্দির আর এত শান্ত, নিস্তব্ধ, নিরিবিলি—মাথার ওপর নীল আকাশ। শহরের কোনও কলকোলাহল পৌঁছচ্ছে না এখানে। মনের মাঝে কোথাও যেন উঁচু তারে বেজে চলেছে অপার্থিব সুর।

তুমি নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলে না? এর থেকে ভাল জায়গা কী আর আছে নিজেকে জানার, নিজেকে চেনার?

রাজ বলে ওঠে।

আমি মনে মনে ভাবি, রাজ তুমিই কি আমি অথবা আমিই কি তুমি? তা না হলে তুমি কী করে পড়তে পার আমার মনের কথা? এই অদ্ভুত শান্তির জায়গাটা তো আমি খুঁজে ফিরছিলাম শহরের তুমুল ব্যস্ততার মাঝে। এই বাবুলনাথের মন্দির। এই মন্দির চত্বর যে আমায় দু’দণ্ড আশ্রয় দিতে পারবে এ তুমি কী করে জানলে রাজ?

সুধীজন, আপনারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করুন বা না করুন—এই বাবুলনাথের মন্দির মন জুড়িয়ে দেবে আপনাদের। নেমে আসবে এক নির্ভার শান্তি। আমি অনুভব করেছিলাম এই শান্তি এবং তা রাজেরই সান্নিধ্যে। মন্দির চাতালে বসে থাকতে থাকতে রাজের কাছে শুনে নিয়েছিলাম বাবুলনাথের মন্দিরের ইতিবৃত্ত।

সেই দ্বাদশ শতকে হিন্দু রাজা ভীমদেব এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিবলিঙ্গ। তার পর কেটে গেছে বহু বছর। নতুন নতুন সভ্যতার আস্তরণে চাপা পড়ে গিয়েছিল এই প্রাচীন শিবলিঙ্গের ঐতিহ্য। আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে মঙ্গলবার অঞ্চলের এই অংশে ছিল বিস্তীর্ণ চারণভূমি। সেই সবুজ ছড়ানো নাতিউচ্চ টিলার ঢালে পশুচারণ করতে আসত এই রাখাল। নাম তার বালু। সকাল বেলা এই বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে সে ছেড়ে দিত তার গাভীগুলিকে। সূর্যাস্তের পূর্বে তার গাভীর দল নিয়ে সে গৃহে ফিরত। গৃহ বলতে তার মালিকেরই গৃহ—তার মালিক ছিল সম্ভ্রান্ত স্বর্ণকার পাণ্ডুরং।

এমনি ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল বেশ। গাভীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ আর অবসর সময়ে বাঁশি বাজানো ছাড়া আর বিশেষ কোনও কাজ ছিল না বাবুলের। কিন্তু হঠাৎ এক দিন সে লক্ষ করল তার গাভীদলের যে গাভীটি সব চাইতে সুলক্ষণ ও দুগ্ধবতী—নাম যার কপিলা—সেই কপিলা কোথাও নেই। কোথায় গেল কপিলা—খোঁজ, খোঁজ খোঁজ। কোথাও কপিলাকে না পেয়ে যখন দিশেহারা অবস্থা বাবুলের, তখন দেখা গেল কপিলা দূর থেকে আসছে হেলতে দুলতে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাবুল। কিন্তু পরদিনও সেই একই দৃশ্য। তার পরদিনও তাই। এমনিই ভাবে কয়েক দিন চলার পর বালুক তার মালিক পাণ্ডুরংকে জানায় ঘটনাটি। একদিন তারা দুজনে চুপিচুপি কপিলাকে অনুসরণ করে। দ্যাখে কপিলা একটি নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দাঁড়াল আর তার দুধ পড়তে লাগল মাটিতে। এ কী আশ্চর্য দৃশ্য! কপিলা চলে যেতেই দুজনে সেই স্থানে গিয়ে মাটি খুঁড়তেই দেখা দিলেন স্বয়ম্ভু শিবলিঙ্গ। সেই থেকে নাম হল তার বাবুলনাথ। তার পর সতেরোশো আশি সালে এখানে গড়ে ওঠে বাবুলনাথের মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই মন্দিরের গঠনশৈলী চমৎকার। আর সব থেকে যেটি আকর্ষক তা হল এই মন্দিরের শান্ত পরিবেশ।

চলো, বিকেল গড়িয়ে এল, সমুদ্রের তীরে একটু বসবে না?

রাজের কথায় সম্বিৎ ফেরে আমার। হ্যাঁ, চলো, রাজ মুম্বই শহরের প্রাণকেন্দ্র মেরিন ড্রাইভে একটু বসি তোমার সঙ্গে। মেরিন ড্রাইভ—সাগরের তীর ধরে এই রাস্তাটি অর্ধচন্দ্রাকারে সংযুক্ত করেছে নরিম্যান পয়েন্ট ও বাবুলনাথকে। মালাবার হিলের পায়ের তলায় লুটিয়ে রয়েছে মেরিন ড্রাইভ—পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর আর রোমান্টিক সমুদ্র সন্নিহিত পথ। সমুদ্র লাগোয়া পেভমেন্ট ধরে রাজ্যের সঙ্গে চলতে চলতে দেখি গোধূলির রঙে আকাশটা রাঙা হয়ে আছে—তারই প্রতিফলন সাগরের জলে। বড় বড় সিমেন্টের জমানো বোল্ডারের ওপর ঢেউ ভাঙছে ছলাৎ ছল। হয়তো এই শহরের অনেক না-বলা কাহিনি মুখর হয়ে উঠছে সাগরের ঢেউ ভাঙার শব্দে।

রাজ আর আমি একসময় ক্লান্ত হয়ে বসি মেরিন ড্রাইভের সমুদ্রের ধার ঘেঁষে বাঁধানো উঁচু জায়গাটায়। আমাদের চোখের সামনে আকাশ আর সমুদ্র মিলেমিশে একাকার। রাজ, আমি আকাশ হতে পারি, তুমি যদি আমার সমুদ্র হও। আকাশ আর সমুদ্রের চুম্বনে এই গোধূলির রক্তরাগে চিরকালের জন্য আঁকা হয়ে যাক আমাদের দু’টি হৃদয়ের একান্ত গহীন ভালবাসা।

রাজ, আমার রাজ, তাকে চিরদিনের জন্য পাব না বলেই বোধহয় এত গভীর এই ভালবাসা! এ বরং এক রকম ভালই। সংসারের হাজারো ঝামেলায় তাকে আমি জড়াতে চাই না। চার দেওয়ালের মধ্যে তাকে বন্দি করেও রাখতে চাই না। রাজ আমার মুক্তি আমার প্রাণের আনন্দ। মেরিন ড্রাইভে অজস্র মানুষের কোলাহলের মধ্যে থেকেও যেন আমি একা—নীরব দর্শক। রাজ পাশে থাকলে অনেক মানুষের ভিড় থেকেও আমি নিজেকে আলাদা করে নিতে পারি। অনুভব করি রাজের প্রগাঢ় সান্নিধ্য।

ধীরে ধীরে মেরিন ড্রাইভের স্ট্রিট লাইটগুলো জ্বলে ওঠে। অর্ধচন্দ্রকার এক আলোর মালা হয়ে ওঠে মেরিন ড্রাইভ—যার সাহেবি নাম কুইনস নেকলেস। স্থানীয়রা একে বলে সোনাপুর। সোনাপুর ভারি চমৎকার নাম না? ভারি আদরের নাম!

দূরে আকাশ আর সমুদ্রের দিগন্তরেখা থেকে উঠে আসছে দুটো একটা আলো। নৌকো বা স্টিমারের আলো সেগুলো। শ্লেটপাথরের মতো অন্ধকার নেমে আসছে সাগরের জলে। আজ মন চেয়েছিল রাজ, তাই তোমার সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। এ বার আমার সেই চিরপরিচিত ঘরের কোণে ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তার আগে চল আবার এক বার দেখে নিই মুম্বইয়ের ফ্লোরা ফাউন্টেন। মুম্বইয়ের ফোর্ট অঞ্চলে এই ফ্লোরা ফাউন্টেন সংলগ্ন অঞ্চলটির নাম এখন ‘হুআত্মা চৌক’। এই ‘হুআত্মা চৌক’-এর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে ‘মহারাষ্ট্র দিবস’-এর স্মৃতি।

আগামী পয়লা মে শ্রমিক দিবস এ সকলেরই জানা। এই দিনটা ‘মহারাষ্ট্র দিবস’ হিসেবেও পালন করা হয়। কেন তা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকটা বছর। স্বাধীনতার পর বম্বে ছিল গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের সম্মিলিত দ্বিভাষিক একটি রাজ্য। স্বাধীনতার পর ভাষা অনুযায়ী রাজ্য গঠিত হবে, কংগ্রেস এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় মরাঠরি ভাষার ভিত্তিতে পৃথক রাজ্য গঠনের আবেদন জানাতে থাকেন। ইতিমধ্যে অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরল ও কর্নাটক রাজ্য গঠিত হয় ভাষার ভিত্তিতে। কিন্তু বম্বে সম্পর্কে সরকারের নির্লিপ্ত মনোভাব মরাঠিদের আন্দোলনমুখী করে তোলে। সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি নামে একটি সংস্থা মরাঠি ভাষার ভিত্তিতে পৃথক রাজ্যের দাবি জানাতে থাকে ১৯৫০ সাল থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের কঠোর মনোভাব তাঁদের নিজস্ব দাবি থেকে একচুলও টলাতে পারেনি। ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংযুক্ত মহারাষ্ট্র সমিতি মুম্বইয়ের কেন্দ্র কবন্দু ফ্লোরা ফাউন্টেন এলাকায় এক জনসভার আয়োজন করে ভাষাভিত্তিক রাজ্যের দাবিতে। কিন্তু এখানে সরকারের দমননীতিতে নগ্ন রূপের এক নির্মম চিত্র ফুটে ওঠে। পুলিশের গুলিতে এই জনসভায় প্রাণ হারান প্রায় শতাধিক মানুষ। এই রক্তক্ষয়ী ঘটনার পর ১ মে ১৯৬০ সালে বম্বে রি-অর্গানাইজেশন অ্যাক্ট-এ গঠিত হয় ভাষাভিত্তিক দুটি রাজ্য—মহারাষ্ট্র ও গুজরাত। ১ মে মহারাষ্ট্র রাজ্যটির জন্ম। তাই এটি ‘মহারাষ্ট্র দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। প্রতি বছরই মহারাষ্ট্র দিবসে শিবাজি পার্কে স্যালুট নেন গভর্নর, প্যারেড হয়। এই দিনটি মরাঠি মানুষের স্মৃতিতে সতত উজ্জ্বল। মাতৃভাষাই যে মানুষের জীবনে শ্রেষ্ঠ ভাষা—আরও এক বার এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দেয় এই পয়লা মে।

আজ তবে এই পর্যন্ত থাক। আমার রাজকে এখন আমি কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। সে দখিনা বাতাসের মতো আমার ফাঁদে ক্ষণিকের জন্য আসে, আবার চলে যায়। তাকে ধরে বেঁধে রাখি এমন সে নীড় কই। ক্ষণিকের এই ভাল— রাজের সঙ্গে এই ক্ষণিকের পথ চলাতেই আমি খুশি। ভাল থেকো রাজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE