বিমূর্ত: নিখিল বিশ্বাসের কাজ। সম্প্রতি, চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে
রং-তুলির সঙ্গে যদি পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সম্পর্ক থাকে, যদি পেশাগত কাজের চাপের মাঝেও ছবি আঁকার মধ্যেই শিল্পী বাঁচার আনন্দ খুঁজে পান, যদি ইউরোপ-আফ্রিকা- এশিয়ার নানা দেশ ঘুরে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মানুষজন, তাঁদের জীবনযাত্রার উপরে প্রচুর স্কেচে তাঁর ছবির খাতা সমৃদ্ধ হয়ে থাকে— তবে স্বশিক্ষিত হলেও একজন শিল্পীর কাজে তার কিছু ছাপ থাকা স্বাভাবিক!
কিন্তু গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় সম্প্রতি ৩-দিনের এক একক প্রদর্শনীতে ওঁর ৪৫টি নানা ধরনের ছবি তুলে ধরলেও অমিতাভ চক্রবর্তী কিন্তু যোগ্যতামানে পৌঁছতে পারেননি।
আসলে ছবি তৈরির কিছু ব্যাকরণ থাকে। যদিও এর বাইরে গিয়েও বহু স্বশিক্ষিত শিল্পীই নিজস্ব এক আশ্চর্য প্রকরণ-দক্ষতায় পট জমিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু রং, রেখা, পরিসর ও রূপবন্ধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সুযোগ একজন শিল্পীকে নানা ভাবে তৈরি করে দেয়, অমিতাভ সেগুলিকে ধরতেই পারেননি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাজে যেমন শিশুসুলভ চাপল্য প্রবেশ করেছে, তেমনই অতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং একঘেয়েমির ফলে প্রতিটি কাজই একটি নির্দিষ্ট মানে পৌঁছতে গিয়ে যেন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এক ধরনের অস্থিরতা তাঁর কাজে লক্ষ করা যায়। এ ছাড়া ভীষণ রকম সচিত্রকরণের দিকেও নিয়ে গিয়েছেন বিষয়-সহ রেখাঙ্কনধর্মী ওঁর প্রায় সব কাজকেই।
কোনও পেন্টিং কোয়ালিটি কাজ করেনি ছবিতে। প্রধানত রেখানির্ভর এবং উজ্জ্বল রং ব্যবহারের চকিত দিক-নির্দেশ বুঝিয়ে দেয় যে, যেখানে চাহিদা তৈরি হয়ে আছে আরও একটু রূপবন্ধ নিয়ে খেলানোর বা রং-কে পটের বিস্তৃত শূন্য জমিতে ব্যবহারের—সেখানেই তিনি কী আশঙ্কায় যে স্পেসের খাঁ-খাঁ শূন্যতাকে ছেড়ে রেখেছেন, বোধগম্য হল না!
তবে কোথাও হয়তো কাজটি সম্পন্ন করতে গিয়ে এই ব্যাপারে যৎসামান্য ভাবনা ওঁর ছিল। তবু সে সব ছবিতে একটি আপাতগ্রাহ্য ভারসাম্য ছিল, ছবি সম্পূর্ণ হতে হতেও তা যেন হঠাৎ শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই পরে তা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রবীন্দ্রনাথের মুখ নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন অমিতাভ। সেই এক্সপেরিমেন্টাল স্টাইলাইজ়েশন দেখাতে গিয়ে নানা খ্যাতিমান শিল্পীর আঁকা রবীন্দ্রপ্রতিকৃতি, এমনকী কবির আত্ম-প্রতিকৃতিরও হুবহু আদল এসে গিয়েছে অমিতাভর কাজে। রেখাঙ্কনে, প্যাস্টেলের চওড়া টানটোনে কিংবা ব্রাশের লাইনেও কবির মুখগুলি খুবই অদ্ভুত ভাবে একইসঙ্গে সৌন্দর্য ও বিকৃতির কথা মনে পড়ায়। অতিরিক্ত রবীন্দ্র-প্রতিকৃতি না রেখে, এ ক্ষেত্রে শুধু মাত্র প্রদর্শনীর জন্যই কয়েকটিকে নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল। আসলে দুর্বল রবীন্দ্র-রূপ দর্শনসুখকে চাবুক মারে। তবুও শিল্পীর দু’-একটি রবীন্দ্র-প্রতিকৃতিকে বেশ লেগেছে, বলতেই হবে।
এ ছাড়া সচিত্রকরণের মতো হলেও লাইনধর্মী দু’চারটি কাজ মুনশিয়ানার দাবি রাখে। এ ক্ষেত্রেও ‘ভ্যানগগ মিউজ়িয়াম’, ‘প্যাটার্নস’, ‘ওয়াইল্ড লাইফ’, ‘সিজন্স’, ‘মাস্কস’ অথবা ‘আনটাইটেল্ড’ ইত্যাদি কিছু কাজ প্রদর্শনীতে না রাখলেও কোনও ক্ষতি হত না। প্রায় পঞ্চাশের মতো ছবির আয়োজনে শুধু রবীন্দ্র-প্রতিকৃতিই যে গোটা একটা দেওয়াল জোড়া!
নীল-কালোয় করা ওঁর ভার্টিকাল ল্যান্ডস্কেপটি অবশ্য মন্দ নয়। তিনটি ভাস-এর বিমূর্ততা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। ওঁর কিছু কাজে কিন্তু মিরো’কে দারুণ ভাবে উপলব্ধি করা যায়। পাখি নিয়ে করা অমিতাভের লাইন-ড্রয়িংও চমৎকার। অন্যান্য ছবির ড্রয়িং-দুর্বলতা কাটাতে পারবেন, এই আশা করছি।
আর একটি কথাও বলতেই হবে। ছোট হলেও সুচারু ফোল্ডারে আরও কিছু ছবি ছাপার সুযোগ ছিল। আর ‘কবিকল্প’ নিয়ে বলার প্রয়োজন কী? ছবিতেই তো উত্তর দিয়েছেন শিল্পী। এ ছাড়া বড্ড দৃষ্টিকটু লেগেছে একান্ত যত্নহীন ছবি পরিচিতির লেবেল। কেন অমনটা হবে প্রদর্শনীতে?
অমিতাভের চেষ্টাকে শেষ পর্যন্ত কুর্নিশ করা যায় এ জন্যই যে, নানা ভাবে উনি অন্তত কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু ড্রয়িং ও পেন্টিংয়ের গুণগত দিকগুলি রপ্ত করতে হবে ওঁকে। নামী শিল্পীদের প্রচুর ছবি দেখার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব।
অতনু বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy