Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জনজীবনের ভাষ্যকার হেমেন্দ্রকুমার

মূলত গোয়েন্দা গল্পের লেখক হিসেবেই তাঁর জনপ্রিয়তা। কিন্তু এই পরিসরে আটকে না থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায় জীবনভর ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন বাঙালির বৌদ্ধিক সমাজ এবং প্রবাহিত নগরজীবনকে। কেমন সেই মানুষটির পথ চলা, সন্ধানের চেষ্টা করলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায় মূলত গোয়েন্দা গল্পের লেখক হিসেবেই তাঁর জনপ্রিয়তা। কিন্তু এই পরিসরে আটকে না থেকে হেমেন্দ্রকুমার রায় জীবনভর ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছেন বাঙালির বৌদ্ধিক সমাজ এবং প্রবাহিত নগরজীবনকে। কেমন সেই মানুষটির পথ চলা, সন্ধানের চেষ্টা করলেন অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:২৯
Share: Save:

তর্কের বিষয় ‘প্রাচ্য চিত্রকলা’। যুযুধান, সেই চিত্রধারার ‘গোঁড়া সমর্থক’ এক যুবক এবং এক ভদ্রলোক। খানিক বাদেই যুবকটি উৎসাহের বশে ‘বাড়াবাড়ি’ করে ফেললেন। আর উল্টো দিকের ‘মধুর মৃদুহাস্য-রঞ্জিত মুখ’ থেকে ভেসে আসতে থাকল ‘কৌতুকের ইঙ্গিত’। ইঙ্গিতে প্রিয় চিত্রধারার ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরিয়ে দেওয়া চলছে! ধারণা হল, ভদ্রলোক এই চিত্রধারার ‘সমর্থক’ নন, বরং ‘এক জন বিশিষ্ট শত্রু’।

ওই যুবক সম্পর্কে ভদ্রলোকের মূল্যায়ন— ‘তিনি কবি, গল্পলিখিয়ে, সাহিত্যিক এবং বাঙালী’। শেষের শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ, অন্তত এই যুবকের জন্য। সে দিনের যুবকটির পিতৃদত্ত পরিচয় প্রসাদ রায়। পরে ‘ভারতী’তে তিনিই প্রসাদদাস। তিনিই আমাদের হেমেন্দ্রকুমার, আবার কখনও বা মেঘনাদ গুপ্ত।

তর্কের উল্টো দিকের ভদ্রলোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তর্কের আসরের এমন ‘সংলাপী রবীন্দ্রনাথ’কে হেমেন্দ্র চিনতে পারলেন। কারণ, তিনি রবীন্দ্র-কথিত ‘বাঙালী’। আরও বেশি করে, কলকাতার নগরজীবনের নিবিষ্ট কথক।

বাঙালি সত্তার কারণেই এই মহানগরের বৌদ্ধিক জগৎ, ‘ভদ্রলোক’-এর দেখতে না চাওয়া জনজীবন, ধুলো-কাদা-জলের অধ্যায় দিয়ে সাজানো একটিই মাত্র বই লিখতে চেয়েছেন হেমেন্দ্র। কেমন সেই বইয়ের অধ্যায়গুলি?

শিল্পরসিক হেমেন্দ্রকুমার রায়

সুরে-ছন্দে

সিনেমা তৈরি হচ্ছে। নাম ‘তরুণী’। সংলাপ রচনা, কাহিনি, গীতরচনায় হেমেন্দ্রকুমার। কয়েকটি গানের সুর-সংযোজনে ‘আকারে ছোটখাটো, শান্তশিষ্ট, মৃদুভাষী, সুদর্শন’ এক শিল্পী। কিছু দিন বাদে হেমেন্দ্রের পরামর্শেই ‘ইস্ট ইন্ডিয়া ফিল্ম কোম্পানি’তে সিনেমার সুরকারটি ‘স্থায়ী’ পদে যোগ দিলেন। কিন্তু ক’দিন বাদেই চাকরিতে ইতি।

‘কেন? কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বনিবনা হল না?’ সুরকার জানালেন, তা নয়। আসলে রাশি রাশি গানে তাড়াতাড়ি সুর দেওয়ায় আনন্দ নেই। বয়সে ছোট শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানালেন হেমেন্দ্র। বললেন, ‘খাঁটি শিল্পীর উক্তি— সচরাচর যা শোনা যায় না। আর্টের মস্ত শত্রু হচ্ছে, ব্যস্ততা।’ সুরকারটি হিমাংশু দত্ত।

শুধু হিমাংশু দত্তই নন, সঙ্গীত জগতের বহু কিংবদন্তির সঙ্গেই জড়িয়ে হেমেন্দ্র-জীবন। তেমনই এক জনের কথা—

কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রায়ই আসেন বাড়িতে। হেমেন্দ্রের লেখা টপ্পা গেয়েছেন ‘গায়কপ্রবর’ কৃষ্ণচন্দ্র। সেই কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গেই এলেন এক তরুণ। সেই তরুণের জন্যও হেমেন্দ্র লিখলেন, ‘ডাকলে কোকিল রোজ বিহানে...’ বা পরে ‘ও কালো মেঘ, বলতে পারো...’ ইত্যাদি। ১৯৩২ সালে ‘হিন্দুস্তান রেকর্ড’ থেকে সেই তরুণের আত্মপ্রকাশ। হেমেন্দ্রের মনে হল, এই শিল্পী ‘অতি-আধুনিক যুগের গায়কদের মধ্যে সর্বপ্রথম’।

কিন্তু সেই তরুণ সিনেমার প্রেমে পড়লেন। হেমেন্দ্রেরও সোজা কথা, ‘সিনেমার কবলে পড়লে দুর্গত হয় চারুকলা’। যাঁর সম্পর্কে এই কথা, তিনি শচীন দেববর্মণ।

হেমেন্দ্রের সঙ্গীত সম্পর্কে ‘বিশুদ্ধ’ রুচিটি আসলে তৈরি করেছিল তাঁর পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের পৈতৃক বাড়ির পরিবেশ। যে পরিবেশে সুর নিয়ে নাড়াচাড়া করেন ফ্লুট ও এস্রাজ-বাদনে পারদর্শী বাবা রাধিকানাথ। বছর পনেরোর কিশোর হেমেন্দ্র বাবাকে দেখে ভাবলেন, লালচাঁদ বড়ালের কাছে গান শিখবেন। কিন্তু বড়াল সাহেব জানালেন, ‘গুরুগিরি করেন না।’ শেষমেশ নাড়া বাঁধা রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর শিষ্য মহিম মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কিন্তু তত দিনে মনের মধ্যে তিরতির করে বেড়ে উঠেছে সাহিত্যপ্রেম।

প্রথাগত তালিমের সেই শেষ।

আড্ডার আসর

তালিমের শেষ হলেও সঙ্গীতপ্রীতি বা গান রচনা, তাতে খামতি নেই।

এক কবি-বন্ধুর শ্বশুরবাড়ি শান্তিপুরে চলেছেন হেমেন্দ্র। পূর্ণিমা রাত, দু’পাশে বন। চলেছেন চূর্ণি নদীর ঘাটে। এমন সময়ে কে যেন বাঁশের বাঁশী বাজায়। মুগ্ধ হয়ে গেলেন হেমেন্দ্র।

এমন সঙ্গীতপ্রীতি যাঁর, তাঁর বাড়ির মজলিসে উস্তাদ জমীরুদ্দিন খাঁ সাহেব, কৃষ্ণচন্দ্র দে, দিলীপকুমার রায়ের মতো দিকপালদের নিত্য আসা স্বাভাবিকই। হেমেন্দ্রকুমার মুগ্ধ শ্রোতা। কিন্তু সে মুগ্ধতায় বিপত্তিও ঘটে। অন্তত ‘তিনি’ থাকলে তো বটেই। এক বার গভীর রাত পর্যন্ত মজলিস চলেছে। সেই ‘তিনি’ বললেন, ‘হেমেনদা, রাত হয়েছে, আজ এখানেই আমার আহার আর শয়ন। জ্ঞানও থাকবে।’ জ্ঞান অর্থাৎ সুরকার জ্ঞান দত্ত।

তেতলার ঘর ছেড়ে হেমেন্দ্র এলেন দোতলায়। আচমকা গভীর রাতে ঘুম ভাঙল। তেতলা থেকে দুড়ুম দুড়ুম শব্দ আসছে। ‘কী ব্যাপার? তোমরা দু’জনে কি মারামারি করছ?’

মারামারি নয়, ধাক্কাধাক্কি! কারণ, খাটে দু’জনেই অন্য জনকে জায়গা দিতে নারাজ। এমন আমোদই স্বাভাবিক। যখন ‘তিনি’টির নাম কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কিন্তু সঙ্গীতের সূত্রেই। মন্মথ রায়ের ‘কারাগার’ নাটকের গান সংযোজনের সময়ে সম্ভবত

এই ‘আড্ডাপ্রিয়’ দুই বাঙালির ভাব জমে ওঠে।

আখড়ায়-ময়দানে

এ ভাবেই আলাপ বিপুলবপু যতীন্দ্রচরণ ওরফে গোবর গুহের সঙ্গেও। আলাপের স্থান মসজিদবাড়ি স্ট্রিটে নরেন্দ্রনাথ বসুর বাড়ি। শনিবাসরীয় এক আড্ডায় উদয় হলেন সেই ভদ্রলোক। কিন্তু, আলাপের পরে হেমেন্দ্র জানলেন, ওই ভদ্রলোক শুধু কুস্তিতেই দড় নন, সঙ্গীতশিল্পীও বটে। ব্যাঞ্জো শিখেছেন ককুভ খাঁয়ের কাছে। ‘ভারতবর্ষ যে অধৃষ্য মল্লের দেশ, এ-সত্য য়ুরোপের চোখে আঙুল দিয়ে সর্বাগ্রে দেখিয়েছিলেন গোবরবাবু ও শ্রীশরৎকুমার মিত্র,’ মনে করেন হেমেন্দ্র।

আখড়া-ময়দান সম্পর্কে এমন স্বদেশি ভাবনাকে আসলে লালন করেছেন হেমেন্দ্র। আর তাই গাছে উঠে ধুতির সাহায্যে নিজেকে পেঁচিয়ে মহা-খেলা দেখতে পৌঁছে যান হেমেন্দ্র। খেলাটা দেখতেই হত। কারণ, তাতেই ১৯১১ সালে মোহনবাগানের শিল্ড জয় হয়! সেই জয় শুধু জয় নয়। ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে ময়দানি জবাব, মনে হয় হেমেন্দ্রের। এই স্বদেশি টানেই সাহিত্য-আসর ফেলে তিনি ছুটে যান গড়ের মাঠের তাঁবুতে। দেখেন ভীম ভবানী, গামা পালোয়ান, হাসান বক্সদের কুস্তি।

আবার পরক্ষণেই সাহিত্যে তৈরি করেন বিদেশি ভিলেন। ‘রত্নপুরের যাত্রী’, ‘সুলু সাগরের ভুতুড়ে দেশ’, ‘সোনার পাহাড়ের যাত্রী’ প্রভৃতি বইতে বারবার ফিরে আসে বিদেশি দস্যুর দল। স্বদেশি ভাবনায় সেই দস্যুরা কখনও ইংল্যান্ড, মিশর বা অস্ট্রেলিয়ার।

কিন্তু শুধু ভাবনা নয়, নিজেও ক্রিকেট, হকি, ফুটবল খেলা, সাঁতার দিয়ে গঙ্গার এ পার-ও পার, সর্বত্রই অবাধ বিচরণ হেমেন্দ্রের।

রঙে-রেখায়

আখড়ায় গিয়ে পালোয়ানদের রদ্দা দেখার পাশাপাশি হেমেন্দ্র ঢুঁ দেন আরও এক জায়গায়। ঠাকুরবাড়িতে। দেখেন, বিলিতি পত্রিকার পাতা ওল্টাচ্ছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মগ্ন ‘পটের উপরে তুলিকা চালনায়’।

অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ-পর্বগুলি চমৎকার।

কলকাতায় ‘সরকারি চিত্র-বিদ্যালয়ে’র আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনী চলছে। সেখানে ভিড়, পাশ্চাত্যের ছবিরই। ভিড়েরই এক কোণে আচমকা দেখা যায় ‘জলীয় রঙে আঁকা’ কয়েকটি ছবি। স্তম্ভিত হয়ে গেলেন শিল্পরসিক হেমেন্দ্রকুমার। খুলে গেল যেন ‘এক অজানা সৌন্দর্যলোকের বন্ধ দরজা’। ছবিটির স্রষ্টা যে অবনীন্দ্রনাথ!

এই অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ সম্ভবত লেখার সূত্রেই। ‘ভারতী’ পত্রিকায় হেমেন্দ্রকুমার লিখেছেন প্রাচীন ভারতীয় চিত্রকলা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ। স্বর্ণকুমারী দেবী জানালেন, লেখার সঙ্গে অজন্তার দু’-একটি ছবি দরকার। তার জন্য অবনীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হতে হবে।

হেমেন্দ্রকুমার গেলেন পূর্ব পরিচিত সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। পেরিয়ে এলেন রক্ষী-সজ্জিত দরজা। তার পরে একটি ঘর। ঘরের দেওয়ালে হাতে আঁকা ছবি। সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে বৈঠকখানা। অত্যন্ত পরিপাটি। সব শুনে অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আপনার ঠিকানাটা রেখে যান।’ দু’দিন পরেই হেমেন্দ্রকুমারের বাড়িতে সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত দু’খানি ছবির প্রতিলিপি পৌঁছে দেন।

হেমেন্দ্র ঠিক করলেন, অবনীন্দ্রনাথের কাছে ছবি আঁকা শিখবেন। এক প্রদর্শনীতে সোজা অবনীন্দ্রনাথের কাছে গিয়ে আবদার, ‘প্রাচ্য চিত্রকলার শিক্ষার্থী হতে চাই।’ অবনীন্দ্রনাথও খুশি। বললেন, ‘এখন আপনার মত ছাত্রই আমার দরকার— যাঁরা এক সঙ্গে তুলি আর কলম চালাতে পারেন। আঁকুন দেখি একটি পদ্মফুল।’ হেমেন্দ্রকুমার আঁকলেন, ‘কিম্ভূতকিমাকার’ পদ্মফুল। তা দেখে সহাস্য অবনীন্দ্র-উক্তি, ‘আপনার চেয়েও যাঁরা খারাপ আঁকতেন, তাঁরাও আমার হাতে এসে উৎরে গিয়েছেন। আপনারও হবে।’

শিল্পীজীবন খুব একটা গড়ায়নি হেমেন্দ্রের। যদিও শিল্পরুচির পাঠটা মিলেছে। সেই পাঠেই চিনতে পারা শিল্পী-বন্ধু যামিনী রায়কে। ‘কলালক্ষ্মীর আশীর্বাদ’ পাওয়া যামিনী অর্থকষ্ট সত্ত্বেও ‘লোকপ্রিয় পদ্ধতি’তে আঁকেন না। এই সততা তৃপ্তি দেয় হেমেন্দ্রকে।

গঙ্গার পাড়ে এই বাড়িতেই দীর্ঘ দিন কাটিয়েছেন লেখক

শুধু আঁকা নয়, একটুখানি লেখার আবদার নিয়ে অবনীন্দ্রনাথের কাছে বারবার গিয়েছেন ‘রংমশাল’ পত্রিকার সম্পাদক হেমেন্দ্রকুমার। আর অবনীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কাগজ-কলম নিয়ে বসো। আমি বলি, তুমি লিখে নাও।’ সঙ্গে দিয়েছেন লেখা নিয়ে পরামর্শও, ‘হেমেন্দ্র, প্রথমে যা মনে আসবে, তাই লিখো। তবেই লেখা হবে স্বাভাবিক।’

হাতে কলম

স্বাভাবিকই লিখেছেন হেমেন্দ্রকুমার। তবে অস্বাভাবিক গতিতে। পনেরো বছর বয়সে ‘আমার কাহিনী’ বুনে হেমেন্দ্রকুমারের আত্মপ্রকাশ। তার পরে অজস্র গোয়েন্দা গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিলেখ, গান, প্রবন্ধ রচনা করলেন বা করতে হল।

জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠল ‘মৌচাক’-এ ‘যকের ধন’ প্রকাশের পরে। ‘আবার যকের ধন’, ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’, ‘কিংকং’, ‘পদ্মকাঁটা’... লিখেই চলেন হেমেন্দ্রকুমার। আর বিমল-কুমার, জয়ন্ত-মাণিক, বিনয়বাবু-কমল, ইনস্পেক্টর সুন্দরবাবুতে বুঁদ হয়ে থাকে কয়েক যুগের বাঙালি। এত লেখার কারণ, মিলিটারি অ্যাকাউন্টসের স্থায়ী চাকরি ছেড়ে দেওয়া সাহিত্যিক হেমেন্দ্রের ওই লিখেই যে চলে।

লেখার সূত্রেই নানা অভিজ্ঞতা হেমেন্দ্রকুমারের। তিনি ঠিক কল্লোলীয় নন। কিন্তু অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্রের রচনা যখন স্রেফ অশ্লীলতার দোহাই দিয়ে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে, তখন কলম ধরে আগুন ঝরান হেমেন্দ্রকুমার। আবার নিজেও পড়েন ওই ‘শ্লীল-অশ্লীল’-এর ফাঁদে।

হেমেন্দ্রকুমারের ‘পোড়ারমুখী’ গল্পটি ‘কল্লোল’ পত্রিকা বাতিল করে। কারণ তাতে যথেষ্ট ‘অশ্লীলতার উপাদান’ নেই! আবার তা ‘অশ্লীল’ বলেই ছাপল না ‘ভারতবর্ষ’! পরে অবশ্য ওই গল্পই দিব্যি প্রকাশিত হয় ‘উত্তরা’ পত্রিকায়।

‘উত্তরা’, ‘কল্লোল’ বা ‘ভারতী’ শুধু নয়, ‘জাহ্নবী’, ‘যমুনা’, ‘বৈকালী’ প্রভৃতি অজস্র পত্রিকার সঙ্গেও কখনও লেখক হিসেবে, কখনও বা সম্পাদকীয় কাজের সূত্রে যোগাযোগ হেমেন্দ্রের। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সঙ্গে যৌথ ভাবে এবং আরও পরে একক ভাবে ‘নাচঘর’ পত্রিকার সম্পাদনা করতেও দেখা যায় হেমেন্দ্রকুমার রায়কে। ‘নাচঘর’ পত্রিকাটি ঘোষিত ভাবে শিল্পপত্রিকা। এবং সেই সঙ্গে ‘রাজনৈতিক আলোচনা থাকিবে না’, তা-ও ঘোষণা করে।

এই পত্রিকাটি শিশিরকুমার ভাদুড়ীর নাট্যপ্রতিভা সম্পর্কে ধারাবাহিক গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন করল। এমনকি, ‘চিরকুমার সভা’য় শিশিরকুমারের অভিনয়ের বিরূপ সমলোচনা প্রকাশিত হওয়ায় তার পাল্টা দেয় ‘নাচঘর’। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে লিখতে হয়, ‘নাচঘরের সঙ্গে শিশিরবাবুর কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই।’

কিন্তু পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্ক না থাক, আত্মিক সম্পর্ক তো ছিলই হেমেন্দ্র-শিশিরের।

সেই সম্পর্কের সূত্রপাত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে শিশির ভাদুড়ীর ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ নাটক দিয়ে। ভীম ও বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের চরিত্রে শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে হেমেন্দ্রের ‘অবস্থা হলো আকাশ থেকে সদ্য-পতিতের মতো’। অনুরোধে কাটা টিকিট সার্থক হল। এই নাটকের সমালোচনাও লিখলেন হেমেন্দ্র। সমালোচনাটি তাঁকেও ছুঁয়ে গিয়েছে, এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং শিশিরকুমার। এ ছাড়া দু’জনের সখ্যের সাক্ষ্য দেয় হেমেন্দ্রের ‘বাংলা রঙ্গালয় ও শিশিরকুমার’ বইটিও।

জীবনরসিক

সখ্য ছিল অনুজদের সঙ্গেও। তেমনই এক অনুজের জীবনের সঙ্গে জড়ানো এক গল্প।

গঙ্গাপাড়ে আপার চিৎপুর রোডের কাছে ভাস্কর্যশোভিত তেতলা বাড়ি। এই বাড়ি থেকে ‘সমুদ্রের ভ্রান্তি’ জাগা স্বাভাবিক, জানিয়েছেন পরিমল গোস্বামী। বাড়িটির মালিক হেমেন্দ্র। সেখানেই সপরিবার আড্ডা চলছে। আচমকা গঙ্গাপাড়ে ‘ক্রীড়াচঞ্চলা’ দুই তরুণীর উদয়। হেমেন্দ্রবাবু ছেলে প্রদ্যোৎকে বললেন, ‘ওঁদের ডাকো দেখি’। তা শুনে হেমেন্দ্রবাবুর স্ত্রী রেণুকাদেবী বললেন, ‘অচেনা বাড়িতে ওঁরা আসবেন কেন?’

সটান জবাব হেমেন্দ্রের, ‘গৃহিণী, ওঁরা হচ্ছেন নতুন বাঙলার মেয়ে।’ খানিক বাদেই দরজায় টোকা। সেই দুই তরুণীই। এক জন বললেন, ‘শুনেছি, এইখানে কোথায় হেমেন রায়ের বাড়ি আছে।’ এই ঘটনার ক’দিন পরে হেমেন্দ্র অনুজ সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে বললেন, ‘তোমার স্ত্রী হরণ করেছিলুম!’

এমনই রসবোধের সাক্ষী হয়েছিলেন কালিদাস রায়ও। এক বার কালিদাসের জিজ্ঞাসা, ‘হেমেন্দ্রকুমার প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেও প্রেমের কবিতা লেখেন কেন।’ হেমেন্দ্রকুমারের সটান জবাব, ‘পঞ্চাশোর্ধেও মনে বনে যাবার ইচ্ছা জাগেনি, তাই।’

কলকাতার ওঁরা

জীবনরসের সন্ধান হেমেন্দ্রকুমার পেয়েছেন কলকাতার সেই সব মানুষের কাছ থেকে, যাঁদের প্রতি ছুৎমার্গ মধ্যবিত্তের অভ্যেস। সেই অভ্যেসের পর্দা সরিয়েই গোটা কলকাতার ‘নক্সা’ খোঁজেন ‘নিশাচর’ হেমেন্দ্রকুমার। হাঁটা দেন চিনে-পাড়া, সোনাগাছি, হাড়কাটা গলি, ফুলবাগান, বেনেটোলা-সহ নানা স্থলে। এই নিশাচর দুমড়ে-মুচড়ে দেখেন বারবণিতা, গুন্ডা, শ্মশানচারী, শ্রমিক, ভিক্ষাজীবীদের প্রত্যেক রাতের যাপন। দেখেন, সেই যাপনের আবডালে নিয়ত লুকিয়ে পড়া মধ্যবিত্তকেও।

আর এ সব দেখতে গিয়ে বিপদ, তা-ও এসেছে পায়ে পায়ে।

সাহিত্যজগতের পরিচিত এক ‘ভদ্রলোক’ তাঁর দুই বন্ধুকে নিয়ে ঢুকেছেন এক পরমাসুন্দরীর ঘরে। ‘একটু আসছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন সেই সুন্দরী। বহুক্ষণ কেটে যায়। দেখা যায়, ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। বিছানায় কী যেন ঢাকা দেওয়া। খানিক ঠাহর করতেই বোঝা গেল, তা ‘মড়া! গলা কাটা!’

আরও এক বার। এক অপরিচিত বৃদ্ধের অনুরোধে অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়ি থেকে দেহ কাঁধে সৎকার করতে চলেছেন হেমেন্দ্র। গ্যাস-আলোর সীমানার মধ্যে যেতেই দেখা যায়, মড়ার চাদর বেয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্ত। কী ঘটেছে বুঝতে বাকি রইল না।

বৃদ্ধ পগারপার। দেহ ফেলে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে কোনও রকমে রক্ষা পেলেন লেখক! এ সব অভিজ্ঞতা নিয়েই মেঘনাদ গুপ্ত ছদ্মনামে লেখা ‘রাতের কলকাতা’।

এবং একা

রাত-দিনের যে কলকাতার সঙ্গে যাপন, সেই শহরেই ১৮৮৮

সালে জন্ম হেমেন্দ্রের। কিন্তু এই শহরের রামধনুতে যে যন্ত্রণার রং, তা-ও যেন মর্মে লাগে হেমেন্দ্রের। সেই রং, যা ক্রমে মানুষকে একলা করে।

স্ত্রী মারা যান মাত্র ৪২ বছর বয়সে। ক্যানসারে আক্রান্ত স্ত্রী মৃত্যুর কিছু দিন আগে যত্ন করে মশারি টাঙিয়ে বিছানা করেছিলেন। স্ত্রীর হাতে করা বিছানাটি আগলে রাখলেন হেমেন্দ্রকুমার, ১৯৬৩-র ১৮ এপ্রিল, মৃত্যুর দিন পর্যন্ত। এই আগলে রাখার সময়কালটা দীর্ঘ ২৪ বছর। হয়তো ওটুকুই স্ত্রীর সঙ্গে থাকা! আবার বড় ছেলে অলকের সাফল্যে খুশি হয়েছেন হেমেন্দ্র। এই দম্পতির তিন মেয়ের ছোটটিও মারা যান অল্প বয়সে।

শুধু পরিবারের শোক-তাপে দগ্ধ হওয়া নয়, যা হেমেন্দ্র ভালবাসেন, সেই সব কিছুর সঙ্গেই বিচ্ছেদের চালচিত্র ফুটে উঠল ধীরে ধীরে...

যে দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কেটেছে, সেই মানুষটিই যখন ‘উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল’ লিখলেন, মতান্তর ঘটল। বইয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রসঙ্গে ‘যথেষ্ট অন্যায্য মতামত’-এর বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া দিলেন হেমেন্দ্র। ফল, সম্পর্কে চিড় ধরা। যদিও শ্রদ্ধায় চিড় ধরেনি কোনও দিন।

আসলে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ মাত্রেই খুব সংবেদনশীল হেমেন্দ্রকুমার। তার সাক্ষী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও। শরৎচন্দ্র যদি জানতে পারেন কেউ তাঁর ‘শিষ্যস্থানীয়’, তা হলে ভালবেসে তাঁকে একটি ফাউন্টেন পেন দিতেন। সে কথা হেমেন্দ্রকুমারকে মজা করে বললেনও শরৎচন্দ্র। কিন্তু হেমেন্দ্রের জবাব, ‘আপনি আমার শ্রদ্ধাভাজন। কিন্তু আমার গুরু রবীন্দ্রনাথ। আর কাউকে তো গুরু বলে মানতে পারব না।’

তবে ব্যক্তি ও মানুষ শরৎচন্দ্রের প্রতি তিনি যে ঋণী, তা-ও মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন হেমেন্দ্রকুমার। জানিয়েছেন, শরৎচন্দ্র এক দিন একটা ভূতের গল্প বললেন। সেই গল্প এমনই যে, রাতে একলা বাড়ি ফেরাটাও নাকি কঠিন হয়ে পড়ে। ‘সেই গল্পটি আমি আমার ‘যকের ধন’ উপন্যাসে নিজের ভাষায় প্রকাশ করেছিলুম’, জানান হেমেন্দ্রকুমার। সঙ্গে এ-ও স্বীকার করেন, শরৎবাবুর মুখের ভাষার অভাবে গল্পের অর্ধেক সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়।

আসলে এই সৌন্দর্য-নষ্ট বারবার ব্যথা দিয়েছে হেমেন্দ্রকে। যে বাড়ির অলিন্দ হেমেন্দ্রকে বৌদ্ধিক তৃপ্তি দিয়েছে, সেই ঠাকুরবাড়ির ‘আনন্দের হাট’-ও ক্রমে ম্লান হয়ে এল। আর ও পথ মাড়ালেন না লেখক। ‘ঠাকুরবাড়ি আজ নিরালা, নিস্তব্ধ’, আক্ষেপ হেমেন্দ্রকুমারের গলায়।

যে লেখালেখি আনন্দের উপকরণ, সেই লেখাটাই হয়ে উঠল যন্ত্রণার। কঁকিয়ে ওঠে হেমেন্দ্রের কণ্ঠস্বর, ‘আমার কাছে পত্রিকার পক্ষ থেকে অনেকেই আসে। এই তো সেদিন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে গেল। লিখতে আমার কষ্ট হয়। শরীর বড় খারাপ।’ সঙ্গে সম্পাদকের বার্তা, ‘ডিটেকটিভ গল্প হওয়া চাই। এমন ফরমায়েস মত কি লেখা চলে! আমার ভালো লাগে না।’

ভাল লাগেনি। কিন্তু লিখতে হয়েছে। পেটের প্রয়োজনে, নাটকের প্রয়োজনে, সিনেমার প্রয়োজনে... আর এই সূত্রেই দেখলেন, নিজের লেখা প্রায় চারশো গানের অনেকই কী ভাবে অন্যের নামে বাজারে প্রচলিত হয়ে গেল!

আসলে এ ভাবেই অনেকে ঠকিয়ে গিয়েছেন ব্যক্তি হেমেন্দ্রকুমারকে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অনেক বিখ্যাত, অখ্যাতরা। নাতনি মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় জানান, এক পাতানো নাতনি হেমেন্দ্রকে ‘গ্যারেন্টার’ রেখে দামি সেলাইকল কিনে চম্পট দেন। টাকাটা দিতে হয়েছিল ‘গ্যারেন্টার’ হেমেন্দ্রকুমারকেই। বইপত্রের সংগ্রহ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়ের আঁকা ছবি, যা হেমেন্দ্রের আদরের সম্পদ, তা-ও তো ‘একটু নিচ্ছি’ বলে ফেরত দিলেন না অনেকেই!

অন্যের এমনই নানা প্রয়োজনের জন্য বারবার নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন হেমেন্দ্র। সেই ‘অন্যে’র তালিকায় শেষ নাম এই কলকাতাও ছিল কি না, তা বলেননি তিনি। কিন্তু অভিমান... তা তো রয়েইছে।

আর তাই গঙ্গার পাড়ে বিখ্যাত বাড়ির চৌহদ্দিতে মন টেকে না প্রবীণ হেমেন্দ্রকুমারের। প্রবীণ লেখক গঙ্গা নয়, বরং বাড়ির কাছেই গলিপথের মধ্যে চিৎপুর রোডে অন্যের বাড়ির রকে বসে থাকেন। তাকিয়ে থাকেন ‘গঙ্গার স্রোতের বদলে ধুলো ওড়ানো লরি, ট্রাক, মোটরসাইকেল, বাস...’ ইত্যাদির স্রোতের দিকে। কারণ, সেই স্রোতেই যে ‘কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে।’

এই কলকাতার আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রবীণ হেমেন্দ্রকুমার বলতে পারেন নিজের কথা, ‘না কোন ভবিষ্যৎ নেই আমার... শুধু অতীতের কথা ভাবি... এত কথা আছে যা ফুরোবার নয়—’’

ফুরোবার নন বাঙালির মহা-নাগরিকও।

ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকা আর্কাইভ, পরিমল গোস্বামী

তথ্যঋণ: ‘দেশ’

‘হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী’ (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি), ‘নাচঘর’

‘বৈশাখী’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE