কনসেপচুয়াল স্কেপ: চিত্রকূট আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শিত অনিন্দ্য রায়ের একক প্রদর্শনী
ইতিহাসাশ্রিত কিছু দৃশ্যকল্প, প্রায় গল্পপ্রধান। বিশেষ করে নানা আখ্যান বা কাহিনির ছেঁড়া ছেঁড়া সময় থেকে তুলে নিয়ে আসা ঘটনার কল্পনাপ্রবণ নির্মাণের মধ্যে তৈরি হয়ে যাচ্ছে আরও এক গল্পনির্ভরতা, যাকে কেন্দ্র করেই সমগ্র বিন্যাসকে সাজিয়েছেন ‘কনসেপচুয়াল স্কেপ’ নামে। চিত্রকূট গ্যালারিতে শেষ হল অনিন্দ্য রায়ের একক প্রদর্শনী। আয়োজক চিত্রকূট।
তাঁর কাজ দেখতে দেখতে মনে হয় নানা ধরনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট যেমন বিভিন্ন সময়ের আশ্চর্য প্রতীক ও বাস্তবের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন করে রাখে পটকে—তেমনই ওই বাস্তবতার মধ্যেও তৈরি হয়ে যায় আরও এক ধরনের সদ্বাস্তবতার দৃশ্যকল্প! এই টুকরো সুররিয়ালিজ়ম কিন্তু খুব বুদ্ধি করেই তাঁর কম্পোজ়িশনের মধ্যে অন্য এক নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করেছে। তাঁর প্রায় অধিকাংশ কাজেই একটা কৌতূহলের উদ্দীপনা তৈরি হয়ে যায়। খুঁটিয়ে দেখার বা জানার চেষ্টা দর্শককে ছবির গভীরে নিয়ে যায়। এখানেই অনিন্দ্যর সার্থকতা।
পটের রূপবন্ধ, বিষয়, রং, রেখা ও অন্যান্য মাধ্যমের সাহায্যে কী ভাবে কম্পোজ়িশনকে নির্দিষ্ট করতে হয়, যেখানে স্পেস একটা বড় সমস্যা হয় অনেকের কাছেই। অ্যারেঞ্জমেন্টের এই সামগ্রিক চেহারাটা কতখানি আকর্ষক হতে পারে, সেই ভাবনা কাজ করেছে শিল্পীর পেন্টিংগুলিতে। অনেক কাজেই অনিন্দ্য চারটি প্রধান দিককে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন।
প্রথমত স্পেস। এখানে এক উল্লম্ব, আনুভূমিক, শূন্য পরিসর তৈরি করেছেন ঘটনার সান্নিধ্যে এক দিক থেকে অন্য দিকের সম্পর্ককে অটুট রাখার ক্ষেত্রে।
দ্বিতীয়ত জমাট রচনার মধ্যে প্রতীকায়িত ঐতিহাসিক কিছু মুহূর্তের রূপবন্ধ ও বিষয়কে এমন ভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যে, ড্রয়িং ও বর্ণ একে অন্যের পরিপূরক হয়ে, অন্য এক আলো বা অন্ধকারের দিকনির্দেশ করছে! যেখানে ঘটছে আর একটি ক্ষুদ্র হলেও ব্যাপক কাহিনির কোনও মুহূর্তের দৃশ্যকল্প। এখানে ডিটেলকে গুরুত্ব দিয়েছেন নিজস্ব স্টাইল ও টেকনিকের মাধ্যমে।
তৃতীয়ত উজ্জ্বলতা ও অনুজ্জ্বলতার ঘেরাটোপে অতি নিরীহ, প্রায় স্তিমিত হয়ে আসা রঙের ফ্যাকাশে অবস্থানের মধ্যে তৈরি হচ্ছে আর এক ধরনের বর্ণসংশ্লেষ, যা তিনি ইচ্ছাকৃত ভাবেই করেছেন, অ্যাক্সিডেন্টাল নয়। তার মধ্যেই একটি ফর্মেশনে গোটা ঘটনার বিন্যাস সূচিত হচ্ছে।
চতুর্থত, ঘটনা পরম্পরার ইতিহাস ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্য দিকে মোড় নিয়ে প্রায় পুরাণমুহূর্ত থেকে অনতি অতীতের দিকে চলে যাচ্ছে। অথচ কোনও ভাবেই তাকে লিংকলেস বলা যাবে না! কারণ রচনার স্টাইলোত্তীর্ণ শৈল্পিক চেতনার অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যার কিছু শিল্পগুণকে কাজে লাগিয়ে অতীত-আধুনিকের মেলবন্ধনে একটা সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এর ফলে অনিন্দ্যর কম্পোজ়িশনের মধ্যে একটি বিজ্ঞানসম্মত ভারসাম্য ও দর্শকের চোখকে খেলিয়ে নেওয়ার প্রবণতা গোটা পটের মধ্যে কাজ করেছে। আংশিক স্থাপত্যও নজর কাড়ে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষার পাঠহীন শিল্পী। কিন্তু নিষ্ঠা নিয়ে মাধ্যমটিকে রপ্ত করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। যা আজও অব্যাহত। ভারতীয় মন্দির ভাস্কর্য, তাঞ্জোর খাজুরাহো, মূর্তিতত্ত্বের ঐতিহাসিক প্রভাব তাঁর কাজে লক্ষণীয়। কোথাও মনে পড়ে আদিত্য বসাকের কিছু কাজের স্মৃতি। সমস্ত সোর্স থেকেই গ্রহণ করেছেন উপাদান। নিজের মতো করে তা ব্যবহার করার মধ্যেই তৈরি হয়েছে এক ধরনের ফ্যান্টাসি। আধুনিকতা ও ঐতিহ্যের মেলবন্ধনের মধ্যে ড্রয়িং ও স্টাইলের নাটকীয় বিন্যাস কিন্তু মার খায়নি। মানুষ এবং পশু, ঐতিহাসিক মুহূর্ত বা চিরাচরিত প্রতীক, বরাবর রক্ষা করা ব্যালান্সের একটা ফিজিক্স। রূপবন্ধ ও ঘটনা-বিন্যাসের শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্যকে যা গভীর পর্যবেক্ষণের মধ্যে রেখে—তবেই প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। এক সময়ে রণবীর সিংহ কালেকা-র ছবিতেও আশ্চর্য সব অনুষঙ্গকে এক সূত্রে গ্রন্থিত হতে দেখা গিয়েছে।
অনিন্দ্যর কাজে দুর্বলতা নেই, তা নয়। ব্রাশিংয়ে মেলানো মেশানো চরিত্রের শরীর কোথাও ব্যানারধর্মী। গল্পের প্রবণতার রাশ একটু টানার দরকার ছিল। এ ছাড়া ছবি কোথাও কোথাও অসম্পূর্ণতার ধারণাকে উসকে দেয়, যা কাটানো দরকার। ফিনিশিং আরও যত্ন নিয়ে করা প্রয়োজন। তবুও বলতেই হবে—ক্যানভাস জুড়ে অ্যাক্রিলিক ও মিশ্র মাধ্যমের কাজে লোকশিল্প থেকে রাজনীতি ও ভারতীয় অণুচিত্র তাঁকে আচ্ছন্ন করে। অনিন্দ্যর ছবিতে ব্যঙ্গ রয়েছে যেমন, আছে আধ্যাত্মিকতারও পূর্ণ প্রকাশ।
অতনু বসু
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy