Advertisement
০৪ মে ২০২৪

উত্তমকুমারের সঙ্গে মন কষাকষি হয়ে যায় বাঞ্ছারাম করতে গিয়ে

গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সুপ্রিয়া চৌধুরীর সঙ্গে। এক সন্ধের বিবাদে ভেঙ্গে যায় অপর্ণা সেনের সঙ্গে দীর্ঘ বন্ধুতা। আড্ডায় ক্ষোভ, অভিমান, হতাশার কথায় বিস্ফোরক দীপঙ্কর দে। সামনে শঙ্করলাল ভট্টাচার্যগভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন সুপ্রিয়া চৌধুরীর সঙ্গে। এক সন্ধের বিবাদে ভেঙ্গে যায় অপর্ণা সেনের সঙ্গে দীর্ঘ বন্ধুতা। আড্ডায় ক্ষোভ, অভিমান, হতাশার কথায় বিস্ফোরক দীপঙ্কর দে। সামনে শঙ্করলাল ভট্টাচার্য

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

শহরের ঘ্যাম গল্ফ ক্লাবের অনেক দিনের সদস্য।

অথচ হালফিল মাসে এক-আধবার গিয়ে সকাল-দুপুরে বসা হয়। সামনে বিয়ার, স্যান্ডুইচ আর ঠোঁটে শত চেষ্টাতেও ছাড়তে না-পারা সিগারেট নিয়ে।

বয়-বেয়ারা ছুটে আসতেই থাকে, ‘বলুন স্যার, বলুন স্যার’ করে। তবে তাতে ওঁর একলার মেজাজ ‘ছুট’ হয় না।

দিনের পর দিন টানা শ্যুটিঙের পর এটা ওঁর কষ্টার্জিত একলা-সময়।

নিঃসঙ্গ মানুষেরও কি খুব একলা হওয়ার সময় আছে আজকাল? জীবনটা কী ভাবে উঠল, পড়ল, কাটল, ভাবার? একটু মৃত্যুভাবনা করার?

কিংবা যাকে বলে নিজেকে দেখার?

টিটো, মানে দীপঙ্কর দে-কে একটা মেদুর দুপুরে এমনই এক আনমনে গল্ফ-দেখা মেজাজে পেয়ে প্রশ্নটা এসেই গেল, ‘‘অ্যাদ্দুর এসে কী মনে হয়— সিনেমায় ঢোকাটা ভুল হয়েছিল?’’

কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন, তার পর বললেন, ‘‘একেক সময় মনে হয়, হ্যাঁ।’’

কেন হ্যাঁ, এটা বোঝাতে হলে ওঁকে একটু জীবনের কথাও বলতে হয়। বললেন, ‘‘ভাল ছাত্র ছিলাম কিন্তু। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল আর প্রেসিডেন্সির ছাত্র। অনার্স ছিল ইকনমিক্স-এ। এমএ পড়েও পরীক্ষায় বসতে পারলাম না, রুজির খোঁজে বেরোতে হল বলে।’’

যে-মানুষটা একটু আগেই বলছিলেন, ‘ইস্কুলের জীবনটাই সেরা সময় গেছে আমার’, তিনিই আবার বললেন, ‘‘অভাবের মধ্যে জীবনটা কাটছিল মামাবাড়িতে। বড় হচ্ছিলাম অঢেল আদরে। কিন্তু অভাব তো লেগেই ছিল সংসারে। আরসিপিআই, পাল্লালাল দাশগুপ্ত, এ সব নিয়ে রাজনীতি করা পরিবার, রাজনীতির কোর্টকাছারিতেই বয়ে যাচ্ছে সব টাকা।’’

অতএব ইস্কুলে থাকতে দুটো শার্ট, দুটো প্যান্টেই বছর কেটেছে। বিকেলে জলখাবার জুটেছে দুটো বিস্কুট। তাতেও মুখের হাসি, মনের খুশিতে টান পড়েনি।

কেবল ভেতরে ভেতরে একটাই হাহাকার। বাবার সঙ্গে দেখা নেই; তিনি ইঞ্জিনিয়ার, কর্মরত জামশেদপুরে। আর মা? তিনি তো আরও দূরে, কর্মরতা ইংলন্ডে।

মা দেশে ফিরলেন যখন টিটোর বয়স তখন দশ, আর তার মাত্র আট বছর পর সংসারেরও মায়া ছেড়ে চলে গেলেন।

বহু দিন পর ‘আত্মীয়স্বজন’ ছবিতে পরিণত বয়েসের দীপঙ্কর এই ব্যাখ্যাটাকে তুলে এনেছেন একটা মর্মান্তিক দৃশ্যে। ছবির সেই চরিত্র সদ্য মা’কে দাহ করে এসে ধড়া পরে মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে।

শিল্প তখন নকল করছে জীবনকে!

পড়া ছেড়ে কাজ ধরতে আক্ষরিক অর্থে হিল্লিদিল্লি করতে হয়েছে দীপঙ্করকে। কাজ বলতে রানিগঞ্জ থেকে ট্রাকে চড়িয়ে কয়লা আনার ব্যবসা। বলা বাহুল্য, বেশি দিন পারা যায়নি।

তখন ধরতে হল, লরিওয়ালাদের ‘তেরপল’ বেচার ব্যবসা। সেও টানা যায়নি বেশি দূরে। শেষে সেলসম্যানের চাকরি নিয়ে দিল্লি পাড়ি দিতে হল। প্রথমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিংক, পরে ওভালটিন-এ।

সেখানেই আলাপ বান্টির সঙ্গে, যে-খ্রিস্টান বান্ধবীকে কলকাতায় এনে বিয়েও করা হল, ১৯৬৯-এ। দিল্লিতে চাকরি করতে গিয়ে উপার্জন বলতে ওই বিয়েটাই।

ফের কলকাতা, ফের চাকরির খোঁজ। কিন্তু কোথায় চাকরি?

উগ্র আন্দোলন আর খাড়াখাড়িতে ধুঁকছে শহর, ধুঁকছে গ্রাম। তখন মুশকিল আসান হয়ে দেখা দিলেন এমন এক জন, যিনি সচরাচর ত্রাণকর্তা হতেন পণ্ডিত, গবেষক, লেখককুলের। যার যেখানে তথ্য বা তত্ত্ব নিয়ে আটকাচ্ছে ফোন যাচ্ছে ওই রক্তমাংসের সিধুজ্যাঠার কাছে। দ্য ওয়ান অ্যান্ড ওনলি শাঁটুলবাবু, মানে রাধাপ্রসাদ গুপ্ত।

শাঁটুলবাবুর কথায় আর নিজের হাজিরায় চাকরি হয়ে গেল নামজাদা গ্রান্ট অ্যাডভার্টাইজিং-এ।

আর দেখতে দেখতে সিনেমায় আসার বেগ, নাকি উদ্বেগও তৈরি হল। পড়াশুনো করা ছিমছাম, সুদর্শন ছোকরা সে-সময় শহরজীবন ও শহুরে সমস্যা নিয়ে পর-পর ছবি-করা সত্যজিৎ রায়ের নজরে না পড়ে পারে? পড়লও।

‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে রোল পেলেন দীপঙ্কর। পরে ‘জনঅরণ্য’-য়। আড়ে থেকেই অভিনয়। তবু সত্যজিৎ রায়ের ছবি। কেন্দ্রের কাছাকাছি আসতে সময় লেগেছে লম্বা। মানিকবাবুর জীবনে শেষ ছবি ‘শাখাপ্রশাখা’।

সে অন্য গল্প।

দুপুরে বিয়ার নিয়ে গল্ফের লিংক ঘেঁষে বসা বাহাত্তর বছরের দীপঙ্করকে নিয়ে জেন-এক্স বা জেন ওয়াই পাঠক সম্প্রদায়ের কৌতূহল কি হতে পারে?

এমনিতে তো পেজ থ্রি বা পেজ সিক্স-এ খবর বা ছবি ওঠানোর কোনওই বাসনা নেই ওঁর। অথচ ‘নিয়তিই আমাকে নিয়ে গেছে সিনেমায়’ বলেন যিনি, তিনিই এক কালে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তুখড় ‘লেডিজ ম্যান’ বলে চিহ্নিত ছিলেন।

হুড়ুমদুড়ুম অ্যাফেয়ার চ়ড়ানো নয়। রীতিমতো স্টেডি রিলেশনশিপেই অভ্যস্ত ছিলেন।

বললেন, ‘‘অসম্ভব ভালবাসা পেয়েছি, জানেন। ভালবাসা দিয়েছি বলেই, হয়তো। বলুন, কী জানতে চান বলুন?’’

—বান্টির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল কেন?

—এক কথায় বলি? ইনকম্প্যাটিবিলিটি। মনের মিল ছিল না।

—সেটা কি সিনেমায় খ্যাতি হওয়ার দরুন, নাকি অন্য সম্পর্কে জড়ানো?

—আমরা কিন্তু এখনও অফিসিয়ালি ডিভোর্সড নই। ছাড়াছাড়ি হয়েই আছি। কোনও সম্পর্ক নেই কুড়ি বছর। আজও নিয়ম করে ওর খোরপোশ ফেলে দিই ব্যাঙ্কে।

তা হলে ফিল্ম মহলে মহিলাদের নেকনজরে আসাটাই দাম্পত্যের অবনতির কারণ নয়? এ প্রশ্ন তখনও মনে ঘুরছে, কিন্তু নতুন করে জিজ্ঞেস করা গেল না। এমনিতেই টিটোর ছেলেবেলার নষ্ট হয়ে যাওয়া ডান চোখটায় অনেক কষ্টের ছায়া আছে। তার ওপর হঠাৎ মনে হল, ওঁর দু’চোখেই একটা আহত ভাব ফুটছে। মহিলাদের থেকে সরাব না, কিন্তু ব্যথা এড়াব বলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘উত্তমবাবু চলে যাবার পর বেণুদির (সুপ্রিয়া চৌধুরী) প্রেমে পড়লেন কেন?’’

যা চেয়েছিলাম তাই হল, দীপঙ্কর হেসে আগের মতোই ‘কুল’ হয়ে গেলেন।

বললেন, ‘‘বেণুদি আমার চমৎকার বয়স্কা বান্ধবী হয়ে গেলেন। যদিও এটা হওয়া খুব সহজ ছিল না, কারণ উত্তমদার সঙ্গে আমার একটা ঝগড়াই হয়ে গিয়েছিল। এক দিন তো স্টুডিয়োয় উত্তমদা, বেণুদি বসে আছেন, আমি ওঁকে উইশ-টুইশ না করে হন হন করে সোজা চলে গিয়েছিলাম। উত্তমদা বেণুদিকে বলেছিলেন, দেখলে বেণু, টিটো আমায় দেখেও দেখল না। বেণুদিও বেশ চটেছিলেন আমার ওপর। যা হোক, ব্যাপারটা বুঝে আমি দাদার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছিলাম।’’

—উত্তমবাবুর কথায় পরে আসছি। আপাতত সুপ্রিয়াতেই থাকি। বেণুদির সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে ছিল?

দীপঙ্কর বললেন, ‘‘তা হলে একটা ঘটনা বলি?’’

—বলুন।

—একটা শ্যুটিঙে গেছি দার্জিলিঙে। প্যাক আপের পর উদোম মদ্যপান চলছে। আমরা সবাই বেবাক হাই। বেণুদি তো একেবারে নেশায় এভারেস্টে। কেমন একটা চাড় হল ওঁকে পাওয়ার। এনিথিংস কুড হ্যাভ হ্যাপেন্ড। কিন্তু নিজেকে সামলালাম। বোঝালাম, না এ সম্পর্কটা এই অবধিই থাক। এই থমকে যাওয়ার মধ্যেই তো ভাল লাগাটা থেকে যায়।

—অপর্ণা সেনের সঙ্গে কি ভাল লাগাটা এক জায়গায় থমকে গেল?

—অস্বীকার করব না, ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কাজ করে সুখী হয়েইছি; কারণ ওর সঙ্গে তুলনায় আমার বাকি সব নায়িকাকে গ্রাম্য মনে হয়েছে। সন্ধ্যা রায়, সুমিত্রা… সেখানে ওর অ্যাক্টিঙে একটা শহুরে ছাপ, মেজাজ। কিন্তু সম্পর্কটা একটা বিশ্রী ঝগড়া দিয়ে সুর কেটে গেল। আমরা আমেরিকায় নাটক নিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ এক শহরে নাটক নিয়ে গিয়ে দেখি, অপর্ণা মিসিং। সে তখন অন্য শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে নতুন বন্ধু কল্যাণকে নিয়ে। পরে যাকে বিয়েও করল। শেষ রক্ষা অবশ্য হল, ওরা এসে পৌঁছল শেষে। আমি সে দিন মেজাজ হারিয়ে বেদম চেঁচিয়েছিলাম। বলতে গেলে ওখানেই সম্পর্কের ইতি। এখন অবশ্য একটা পোশাকি সৌজন্য, কেমন আছ-ভাল-আছর সম্পর্ক। ঠিক আছে, যে যার মতো ভাল থাকলেই ভাল।’’

—দোলনের সঙ্গে ঘর করে আপনি অন্তত খুব ভাল আছেন।

সোৎসাহে দীপঙ্কর বলে উঠলেন, ‘‘এক্কেবারে। আদরে-রাগে-অভিমানে আমার জন্য কী যে যত্ন করে যাচ্ছে মেয়েটা! আমার শরীর, আমার স্বাস্থ্য, আমার মন, আমার মেজাজ, আমার ভাল, আমার মন্দের ওপর প্রতিক্ষণের মেজাজ। আমায় তুলোয় করে রেখেছে। সব মিলিয়ে কেমন একটা আবেশের মধ্যে আছি। আর…।’’

—আর?

—একটা ভয় আসে ভেতরে ভেতরে। এত বয়েসের তফাত দু’জনের। কী হবে মেয়েটার আমি চলে গেলে। আমি ছাড়া ওরও তো কেউ নেই। ও আমার সমান স্ত্রী, সমান কন্যা। আর...

—আর?

—সে জন্যই তো নির্মম এই ইন্ডাস্ট্রিতে আজও লেগে আছি। কাজ করে যাচ্ছি। যতটুকু পারি গুছিয়ে রেখে যাই।

—না’হলে?

—মনের সুখে বই পড়ে আর কোনও ব্রাইন্ড স্কুলে শিক্ষকতা করে শেষ জীবনটা কাটিয়ে দিতাম।

দীপঙ্কর কিন্তু বরাবরই মস্ত পড়ুয়া। বলেন, ‘সিনেমাটা নেশা নয়, পেশা।’ আসল নেশা ওঁর বই পড়া, গান শোনা। ওঁর মোবাইলের রিংটোনে বাজে ভীমসেন যোশীর ভজন, ‘যো ভজে হরিকো সদা’।

সিনেমা আর টিভি-র কাজের ফাঁকে সময় বার করে ওঁর বই পড়া চাই হিন্দু ধর্ম এবং পদার্থ বিজ্ঞানের কোয়ান্টাম থিয়োরি নিয়ে। সবে শেষ করেছেন ব্রায়ান গ্রিন-এর ‘ফ্যাব্রিক অফ দ্য ইউনিভার্স’ বইটা। ভাল লাগে মিচিও কাকু-র লেখা। সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী মনে করেন আলবার্ট আইনস্টাইনকে।

তো এই বিজ্ঞানমনস্ক লোকটি এক সময় ফলিত জ্যোতিষ নিয়ে মেতেছিলেন কেন?

—কেন আর কী, কলেজ স্ট্রিটে জ্যোতিষের এক বই পেয়ে ভিড়ে গিয়েছিলাম। কিছু দিন চর্চা, হইহই, লেখালেখি করে কেটে গেল। তার পর মিটেও গেছে, ফলিত জ্যোতিষে আর বিশ্বাস নেই।

জ্যোতিষচর্চা বিদেয় হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ভেতরে একটা ব্যথা চরে অন্য একটা চর্চা ছাড়তে হয়েছে বলে। সেতার।

দুনিয়ার ক’টা লোক জানে ‘বাঞ্ছারামের বাগান’, ‘আবহমান’, ‘শাখাপ্রশাখা’, ‘গণশত্রু’র মতো ছবির অভিনেতা সেতারে গান্ডাবাঁধা শিষ্য উস্তাদ মুস্তাক আলি খানের? বেশ কিছু দিন বাজিয়েও ছাড়তে হল, বলা বাহুল্য সিনেমার কারণে।

কিন্তু সেই সিনেমা থেকেই বা কী পেলেন শেষ অবধি?

বললেন, ‘‘জীবিকা নির্বাহ তো বটেই। কিছু পরিচিতি, খ্যাতি, এবং অনেকখানি মুগ্ধতা— উত্তমদার সঙ্গে কাজ করে। সৌমিত্র, রবি ঘোষ, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে।

—নিজে যতখানি উঠতে চেয়েছেন, যেখানে পৌঁছতে চেয়েছেন তা কি পেরেছেন?

—তা হলে একটা কথা বলি? আই থিংক আই অ্যাম আন্ডাররেটেড।

—সে তো অনেকেই ভাবেন।

—তপন সিংহের ওঁর ‘চলচ্চিত্র আজীবন’ বইয়ে লিখেইছেন, উত্তম, সৌমিত্রর পর সব চেয়ে বড় অ্যাক্টর দীপঙ্কর। অথচ উৎপলদা চলে যাবার পর আমাকে ধরেবেঁধে ভিলেন বানিয়ে দিল। তাই এখন থেকে থেকে মনেও হয়, সিনেমায় এসে ভুল করেছি। অনেক কষ্ট পেলাম। লোক হেয় করেছে। অথচ এ তো পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। ফিরব কী করে? কোথায়ই বা? তাই বইয়ে আশ্রয় নিই।

—বন্ধুবান্ধব নেই?

—ফিল্ম সার্কেলে থাকি যখন দলে ভিড়ে হা হা হু হু করি ঠিকই, কিন্তু ওই! হাসিঠাট্টা করি, অন্যদেরটা শুনি, কিন্তু ওই। সিনিয়র বলে সবাই সমীহটমীহও করে। এরই মধ্যে যখন সৌমিত্রদার সঙ্গে কথাটথা হয়, বড় সুন্দর সময় কাটে, ঋদ্ধ হই। খুব অবাক লাগে ওঁকে দেখে। সব কিছুর মধ্যেও থেকেও যেন নেই। এক বিবিক্ত সন্ন্যাসী।

জিজ্ঞেস করতেই হল, সিনেমায় তা হলে আকাঙ্ক্ষা কী রইল?

—গিরিশচন্দ্রকে নিয়ে কোনও ছবিতে ওঁর চরিত্রে অভিনয়। অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা বলতে সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয়ের সুযোগ না পাওয়া। আর ঋত্বিকবাবুর ‘সুবর্ণরেখা’য় অভি ভট্টাচার্যর মতো একটা রোল করে উঠতে না পারা।

—তবুও তো ‘বাঞ্ছারামের বাগান’-এর রোলটা পেয়েছিলেন।

—আরে, তাই নিয়েই তো উত্তমদার সঙ্গে মন কষাকষি, দূরত্ব।

—আপনার রোলটা তো ওঁর করার কথা ছিল!

—ঠিক।

—তার পর?

—উনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। অথচ ছবির সব প্রস্তুতি শেষ। শুধু ওঁর জন্য কাজ অনির্দিষ্ট কালের জন্য পিছোনোয় প্রশ্ন উঠল।

—তো?

—সেটাই করতে চাইলেন না তপনদা (সিংহ)। সবাই যখন ভেবে অস্থির উত্তম ছা়ড়া কে করবে ওই রোল, উনি বললেন, একটা ছেলে আমার মাথায় আছে। কে? না, দীপঙ্কর। সব্বাই তাজ্জব। উত্তমের জায়গায় দীপঙ্কর! যাই হোক, সে কাজটা তো করলাম। সব্বাই নিলও সেই আমাকে। আমার কাজের জীবনের একটা মাইলফলক হয়ে রইল।

—আর উত্তমবাবুর সঙ্গে বিবাদে জড়ালেন?

—তাই-ই তো! উনি ধরেই নিলেন আমি কলকাঠি নেড়েছি। অথচ আমি জানিও না তপনদা আমাকে কাজটার জন্য ভেবেছেন।

—উত্তমবাবু ছবিটা দেখেছিলেন?

—অনেক পরে।

—কিছু বলেছিলেন?

—না।

—তা হলে ওঁর প্রশংসা আপনার শোনা হয়নি?

—সেটা হয়েছে। এক বার ওঁর সঙ্গে একটা অভিনয়ের পর আমার কাঁধটা জোরে চেপে ধরেছিলেন। খুব জোর ছিল গায়ে। আর বলেছিলেন, আমি ব্রাহ্মণ-সন্তান হয়ে বলছি, সিনেমাটা ছাড়িস না।

কে জানে, দীপঙ্কর দে’র সিনেমা না-ছাড়ার সব চেয়ে জোরালো কারণই হয়তো উত্তমকুমারের এই সংরক্ত উপদেশ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

উত্তম কুমার Uttam Kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE