Advertisement
০৫ মে ২০২৪

বিদেহী আত্মার আকুতি

পদাতিকের নাটক দেখলেন মনসিজ মজুমদারকলকাতায় হিন্দি নাটক চর্চায় পদাতিকের অবদান অনেক দিনের। ইদানীং বিনয় শর্মা পরিচালিত বেশ কয়েকটি প্রযোজনায় পদাতিকের নাট্য নিবেদন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিনয় শর্মার নাটক ভাবনায়, বিষয়ে দার্শনিক, উপস্থাপনায় বা আঙ্গিকে বৌদ্ধিক, ব্যঞ্জনা অনেক সময়ে প্রতীকী এবং নাটকীয় অভিঘাতের লক্ষ্য আলোড়িত আবেগের সঙ্গে উদ্দীপ্ত মনন। বিনয়ের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘ইহাঁ’-তে এই সব লক্ষণ পূর্ণ মাত্রায় দেখা গেল।

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

কলকাতায় হিন্দি নাটক চর্চায় পদাতিকের অবদান অনেক দিনের। ইদানীং বিনয় শর্মা পরিচালিত বেশ কয়েকটি প্রযোজনায় পদাতিকের নাট্য নিবেদন এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। বিনয় শর্মার নাটক ভাবনায়, বিষয়ে দার্শনিক, উপস্থাপনায় বা আঙ্গিকে বৌদ্ধিক, ব্যঞ্জনা অনেক সময়ে প্রতীকী এবং নাটকীয় অভিঘাতের লক্ষ্য আলোড়িত আবেগের সঙ্গে উদ্দীপ্ত মনন। বিনয়ের সাম্প্রতিক প্রযোজনা ‘ইহাঁ’-তে এই সব লক্ষণ পূর্ণ মাত্রায় দেখা গেল।

মহাশূন্যে দুটি বিদেহী আত্মার সংলাপই নাটকের একমাত্র আশ্রয়। আত্মাদের অবশ্য নাটকের প্রয়োজনে শরীরী প্রতিনিধিত্ব করছেন মঞ্চে দুই কুশলী কুশীলব সঞ্চয়িতা ভট্টাচার্য ও অনুভবা ফতেপুরিয়া। তাঁদের নিরন্তর সংলাপে, যা প্রায় সব সময়েই পরস্পরের পুনরাবৃত্তি, ছিল এক গভীর আর্তি ও আকুতি। আর্তি নিঃসঙ্গতার আর আকুতি নতুন দেহধারণের। কিন্তু মঞ্চে দৃশ্যের বা ঘটনার কোনও গতি নেই, নাটকে কোনও বেগ নেই, আছে শুধু আবেগ। আর কবিতার মতো বা গানের মতো একই অভিজ্ঞতার বলয়ে নাটকীয়তার শিথিল বিস্তার। এই দৃশ্যকাব্য উপভোগ করার জন্যে দর্শকের চাই বোধে ও মননে বিশিষ্ট সংবেদনা, সেই সঙ্গে আত্মার দেহাতীত অস্তিত্বে বিশ্বাস। অবশ্য অবিশ্বাসের বিরতি (‘সাসপেনসন অব ডিসবিলিফ’) ঘটানোই নাটকের সাফল্য এবং সেই সাফল্যের কৃতিত্ব পরিচালক ও অভিনেত্রীদের ছাড়াও যাঁদের দায়িত্ব ছিল মঞ্চে মহাশূন্যের সঘন অনুভবের অভিব্যক্তি রচনা করার, বিশেষ করে সঙ্গীত ও শব্দযোজনায় অনন্তের অভিঘাতে। এবং সে কৃতিত্বও বিনয় শর্মার।

একা নন, তিনজন

শিশির মঞ্চে লোপামুদ্রা, সুতপা ও প্রবাল। লিখছেন বারীন মজুমদার

অনুষ্ঠানের শিরোনাম ‘বিকেল একা’। অথচ শিল্পী ছিলেন তিনজন। এ রকম শিরোনামের অর্থ বোঝা গেল না। শিশির মঞ্চে অনুষ্ঠিত এই প্রযোজনায় প্রথম শিল্পী ছিলেন প্রবাল মল্লিক। যিনি শোনালেন পুরনো বাংলা আধুনিক গান। প্রবাল পেশাদার শিল্পী নন। বরং রবীন্দ্রনাথ থেকে আবৃত্তির অনুষ্ঠানের প্রযোজক হিসেবেই খ্যাতিমান। বেশ অনেকগুলি গান শোনালেন তিনি। তাঁর কণ্ঠটি চমৎকার। সুরও অধিকাংশ সময়ইে ঠিক থাকে। তবে মাঝে মধ্যে তারসপ্তকে বা মন্দ্রসপ্তকে সুরের ঘাটতি হয়। গীত গানগুলির মধ্যে ‘কি নামে ডেকে বলব তোমাকে’, ‘মা মাগো মা’, ‘পাগল হাওয়া’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’ গানগুলির মাধ্যমে তিনি শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছেন। পরবর্তী শিল্পী সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চয়নে ছিল নানা কবির আটটি কবিতা। অধিকাংশ কবিতাই বহুশ্রুত। কেবলমাত্র শ্রীজাত’র ‘রক্তকরবী’ কবিতাটি ব্যতিক্রম। যাঁরা আবৃত্তির অনুষ্ঠানে সচরাচর উপস্থিত থাকেন তাঁরা সুতপার বাচনভঙ্গি ও তাঁর পরিবেশনভঙ্গি সম্পর্কে অবহিত। জয় গোস্বামীর ‘বেণীমাধব’ ও শুভ দাশগুপ্তর কবিতাটি তার মধ্যেই অধিক মনোগ্রাহী। সেরা নিবেদন বলা যায়। তবে একটি দিকের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এক কবিতা থেকে অন্য কবিতায় যাওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে আরও একটু বিরতির প্রয়োজন।

শেষ শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের শোনালেন ছ’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত। এদিন তিনি বসে গান শুনিয়েছেন এবং গানগুলিকে অতিরিক্ত অলঙ্কারে ভারাক্রান্ত করেননি। ইদানীং অনেক আসরেই তিনি যা করে থাকেন। তিনি শুরুতে গাইলেন ‘তোমায় গান শোনাব’। শেষ করলেন ‘তাই তোমার আনন্দ’। দুটি গানই গভীর অনুভূতি সমৃদ্ধ। তুলনামূলক ভাবে ‘সেই ভালো’ ও ‘মনে রবে কিনা’ গান দুটি তিনি খারাপ না গাইলেও তেমন ভাবে রেখাপাত করেনি। এদিনের অনুষ্ঠানের বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় ছিল সময়ানুবর্তিতা। তিন শিল্পী। বিরতিহীন অনুষ্ঠান। একজনের পর একজন মঞ্চে আসীন হয়েছেন— কোথাও সময়ের অপচয় হয়নি।

রাজনীতির কানাগলিতে

গদাই রাজার পালা নাটকে

বাগুইআটি নাট্যদর্পণ-এর প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হল ‘গদাই রাজার পালা’ নাটকটি। নির্দেশনায় তৃণা মিত্র ও অংশুমান সেন। কাহিনি তনিমা উপাধ্যায়। সহজ-সরল-অনাড়ম্বর জীবনে অভ্যস্ত গ্রাম্য যুবক গদাই। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শে এসে গ্রাম প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর নিজের অজান্তেই তার মনের আমূল পরিবর্তন হয়। সেই সুযোগে রাজনীতির কারবারিরা গদাইকে ব্যবহার করতে শুরু করে। তাকে বাধ্য করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নানা সিদ্ধান্ত নিতে।

এদিকে ক্ষমতার লোভ ক্রমে পেয়ে বসে গদাইকে। ক্রমে সে রাজনীতি ও প্রশাসনের শীর্ষে ওঠে। তারপর ঘটতে থাকে নানান ঘটনা। শুরু হয় শাসনের নামে শোষণ, অত্যাচার।

কিন্তু সময় তো থেমে থাকে না। এক সময় অত্যাচারিত ও শোষিত মানুষগুলোর সম্মিলিত প্রতিবাদে গদাই রাজার পতন হয়।

নাটকের বিষয়বস্তু খুবই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু অভিনয়ে কিছু ফাঁকফোঁকড় থেকেই যায়। নাটকটি সেই অর্থে জমাটি নয়। কথক-এর ভূমিকায় তৃণা মিত্র, মাস্টার (সঞ্জিত সাহা) যথাযথ। মন্দ লাগে না গদাই-এর (সুরজিৎ দাস) অভিনয়।

পিনাকী চৌধুরী

জীবন যে রকম

রূপান্তর-এর ‘বিভুঁই’ নাটকে

বিভুঁই’ নাটকটিকে কোনও দেশ, কাল বা সময়ের মধ্যে আবদ্ধ রাখা যাবে না। কারণ তা প্রবহমান। দরিদ্র নিতাই থাকত সুবর্ণরেখা নদীর পাড়ে। নদীর কবলে তার ভিটে বাড়ি চলে যাবার পর ছোট্ট মেয়ে কমলিকে নিয়ে বাসা বাধে কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে। রিকশা চালিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায় সে। তার স্বপ্ন মেয়েকে বাবুদের বাড়ির মেয়ের মতো মানুষ করবে। তাই রাজেন বাবুর বাড়িতে কমলিকে কাজে পাঠায়। এদিকে নিতাই-এর জমির উপর নজর পড়ে প্রোমোটারদের। কিন্তু নিতাই তার জমি কোনও মূল্যেই হাত ছাড়া করতে চায় না। রাজেনবাবু এবং তার বৌমা কমলিকে নিজের বাড়ির মেয়ের মতোই মানুষ করতে থাকে। কমলির স্বপ্ন বড় হয়ে দিদিমণি হবে। কিন্তু বাড়ির বড় ছেলে সৌম্য এই সব বিষয়গুলি মেনে নিতে পারে না। শুরু হয় সাংসারিক দ্বন্দ্ব। এই পুরুষ শাষিত সমাজে নারীদের আজও মুক্তি নেই। রাজেনবাবুর পরিবারেও সেই দশা। এই নাটকে রাজেনবাবুর পরিবারের একজন বন্ধু আছেন। সে হল রঞ্জন। সে নাটক করে বেড়ায়। কমলি রঞ্জনকে ভালবাসে। ঘটনাচক্রে কমলির বাবা কমলিকে এক দাতার বাড়িতে নিয়ে আসে, এবং সেই রাতেই কমলি ধর্ষিতা হয়। সৌম্য কমলিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। সেই মুহূর্তে তার স্ত্রী প্রতিবাদ করে বলে ওঠে কমলিকে যদি এই বাড়ি ছাড়তে হয়, সে ও এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। বলে, যদি আমাকে ধর্ষণ করা হত তা হলে আমাকেও কি এই বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতে? নাট্যকার ও নির্দেশক আশীষ পাল চমৎকার ভাবে বিভুঁই নাটকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। নাট্যকর্মী রঞ্জনকে তিনি তার নাটকে রক্তকরবীর রঞ্জন এবং কমলিকে নন্দিনীর সঙ্গে মিলিয়ে একটি চমৎকার দৃশ্য তৈরি করেছেন।

রঞ্জন চরিত্রে জীবন অধিকারী উত্তীর্ণ। তার সুমধুর কণ্ঠে রক্তকরবীর ‘তোমায় গান শোনাবো’ গানটি মনকে নাড়া দেয়। কমলি চরিত্রে অর্পিতা পাল নাটকটিকে অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। আশীষ পাল রাজেনবাবুর ভূমিকায় নাটকটির ছন্দ ধরে রেখেছেন। অতনু পাল, সুদীপ্তা মুখোপাধ্যায়, অভীক দা, স্বরূপ দেবনাথ যথাযথ।

বাংলার মুখ

সম্প্রতি রবীন্দ্রসদনে ‘আস্থায়ী’র অনুষ্ঠানের শুরুতেই কবিতা পরিবেশন করে ছোটরা। তাদের মধ্যে উজান সিংহের ‘ব্যাঙ ও হাতির লড়াই’ এবং জিতমিত্রা চট্টোপাধ্যায়ের ‘নৌকাযাত্রা’ ভাল লাগে। সুবর্ণা দত্তের ‘চেনা বাউলের গান’ উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও ছিলেন শঙ্করী চক্রবর্তী, সুমিতা রায় চৌধুরী প্রমুখ। তবে শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের ‘চরণ’ কবিতাটি উচ্চারণে অস্পষ্টতা থেকে যায়।

এর পরে আবৃত্তি শোনালেন সুদর্শনা ভট্টাচার্য। সমাজের সেই সব প্রান্তিক, অবহেলিত মানুষদের জীবনচর্যাই ছিল কবিতার বিষয়বস্তু। সুদর্শনা তাঁর চর্চিত কণ্ঠে পরিবেশন করেন জীবনানন্দের ‘বাংলার মুখ’। ‘সোনার মেডেল’, ‘লক্ষ্মী’ কবিতাগুলি বেশ মন কাড়ে। তবে এ দিনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’। এর পরেই লোকসঙ্গীতের ডালি নিয়ে মঞ্চে আসেন স্বপন বসু। সাতটি গান শোনালেন তিনি। ‘প্রাণবন্ধু কই গো’, ‘হাওয়ার গাড়ি চইলা গেলো রে’ শ্রোতাদের প্রত্যাশা পূরণ করে। সবশেষে ছিল দুটি শ্রুতি নাটক দুলেন্দ্র ভৌমিকের লেখা ‘কাঠুরিয়া’ ও ‘জলদেবী’। অংশগ্রহণে অমলেন্দু ভট্টাচার্য এবং রণিতা দাস মুখোপাধ্যায়। তবে দ্বিতীয় শ্রুতিনাটক ‘স্মৃতি’ মনে দাগ কাটে। লোভ জয় করা ভালবাসার মাহাত্ম্য নিয়ে এই নাটক। অংশ নিয়েছিলেন অমলেন্দু ভট্টাচার্য এবং পাপিয়া অধিকারী। অনুষ্ঠান সংযোজনায় ছিলেন চন্দ্রমৌলি বন্দ্যোপাধ্যায়।

পিনাকী চৌধুরী

যোগ্য তালিম

মণীন্দ্র সঙ্গীততীর্থ আয়োজন করেছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান। শিল্পী ছিলেন কৌশিক ভট্টাচার্য। গুরুমন্ত্র দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। যেখানে কণ্ঠ মিলিয়েছেন ছোট থেকে বড় শিক্ষার্থীরা। এরা সকলেই কৌশিক ভট্টাচার্যের কাছেই তালিম নিয়েছেন। এছাড়াও শিল্পীরা অসাধারণ দক্ষতা দেখালেন বিভিন্ন রাগ, ঠুমরি এবং ভজনে। দ্বিতীয় পর্বে ছিল কৌশিকের রাগ হংসধ্বনি। এছাড়াও বন্দিশে ‘লাগি লগন পতি’। তার সঙ্গে সঙ্গত করেছেন সমীর চট্টোপাধ্যায়, প্রদীপ পালিত।

এসেছো প্রেম

জ্ঞানমঞ্চে ‘নব-সাহিত্য কমল’ আয়োজিত ‘এসেছো প্রেম’ অনুষ্ঠানের শুরুতেই গাইলেন প্রচেতা চট্টোপাধ্যায়। এদিন শিল্পীরী ছিলেন বিজয়লক্ষ্মী বর্মন, শ্রাবণী সেন, শোভনসুন্দর বসু, মৌমিতা ঘোষ প্রমুখ। শ্রাবণী গাইলেন ‘এসেছো প্রেম এসেছো আজি’, ‘হৃদয় আমার প্রকাশ হোল’, ‘আমার প্রাণের পরে’। তবে শ্রোতাদের প্রত্যাশা পূর্ণ করে ‘জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে’ গানটি। অভিপ্সা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে মৌমিতা ঘোষের কবিতা সাবলীল। অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন ঐশী আহমেদ, সুকন্যা সাহা প্রমুখ।

যে লড়াই চলছে এখনও

অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘অথৈ’ নাটকে। লিখছেন পিয়ালী দাস

সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব, বর্ণ বিদ্বেষ, ক্ষমতা দখলের লড়াই কিংবা সন্দেহের মতো মনের রোগ। যা ছিল এখনওতাই আছে। আজ থেকে প্রায় চারশো বছর আগে উইলিয়াম শেক্সপিয়র-রচিত ট্র্যাজিক নাটকগুলোও যার বড় উদাহরণ। যা আকর্ষণ করছে এ প্রজন্মের তরুণ নাট্য নির্দেশকদেরও। অর্ণ মুখোপাধ্যায়ও সে পথই অবলম্বন করলেন। ‘ওথেলো’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করেছেন ‘অথৈ’। অর্ণ’র নির্দেশনায় এবং নটধা’র প্রযোজনায় সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল নাটকটি। এখানে ‘ওথেলো’ নাটকের চরিত্রদের নির্দিষ্টভাবে খুঁজতে যাওয়া ভুল হবে। কারণ ডেজডিমোনা মিশে যায় দিয়ামোনায়, ওথেলো অথৈ-এ, কিংবা ইয়াগো অনগ্র’য়।

নাটকে প্রতিটি দৃশ্যের নির্মাণ খুব সুচিন্তিত এবং সুপরিকল্পিত। এখানে যেমন উঠে আসে দুর্বলের ওপর সবলের আক্রমণের ভয়াবহ রূপ, গভীর ভালবাসার সম্পর্ক সন্দেহের মতো রোগের বশে এক লহমায় ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনা, তেমনই রয়েছে বিনোদনের রসদও। ছবির মতো একের পর এক ইমেজ তৈরি হয়, সাদা-কালোয়-রোমান্সে। সেট পরিবর্তনেও রয়েছে শৈল্পিক ছোঁয়া। কালো পোশাক পরিহিত মানুষদের আগ্রাসী নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলে যেতে থাকে মঞ্চসজ্জা। ভাল লাগে একটি গাছের প্রতীকী প্রপস-এর ব্যবহার। সম্পর্কের ভিত যত আলগা হতে থাকে, গাছের পাতাগুলো খসে গাছটা ক্রমশ শুকনো ডালে পরিণত হয়। অভিনব দৃশ্যকল্পনা।

অথৈ ভিংসুরা গ্রামেরই ছেলে (লোধা বংশীয়)। সাধারন মানুষের প্রতিনিধি। পেশায় ডাক্তার। স্বপ্ন দেখে গ্রামে বড় স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠবে। মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাবে। দিয়া (তূর্ণা দাশ) রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পাশের গ্রামেরই একটি এনজিওর সঙ্গে যুক্ত। অনগ্র (অনির্বাণ ভট্টাচার্য) বিদেশ থেকে ডাক্তারিতে ইন্টার্নশিপ করে সদ্য গ্রামে ফিরেছে। ৬ মাস পরে আবার বস্টন চলে যাবে। তার মাঝেই মেতে উঠেছে নোংরা ভাঙনের খেলায়। অথৈ এবং অনগ্র এই দুই বন্ধুর বেড়ে ওঠা একই সঙ্গে। কিন্তু অথৈ দলিত শ্রেণির হয়েও মেধায় বুদ্ধিতে বরাবর এগিয়ে থেকেছে কুলীন বংশীয় অনগ্র’র থেকে। অনগ্র তা মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। সামনে বন্ধুত্ব দেখালেও কখনও সে তার ভেতরের প্রকৃত রূপটাকে বুঝতে দেয়নি অথৈকে। এখানেই শুরু হয় মুখ আর মুখোশের খেলা। অথৈ আর দিয়ার সুখী দাম্পত্যে চিড় ধরানোই তার প্রধান উদ্দেশ্য।

অনগ্র চরিত্রটি ভিলেন হয়েও মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়। যার কৃতিত্বের দাবিদার অবশ্যই অনির্বাণ। দিয়ার চরিত্রে তূর্ণা নিজের সেরাটা দিয়েছেন। প্রকাশও জোরালো। অথৈ চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে ওঠে অর্ণ-র দক্ষ অভিনয়ে। তাঁর চরিত্রের যন্ত্রণাগুলো বিদ্ধ করে দর্শক মনকেও। অথৈ এবং দিয়ার মিষ্টি দাম্পত্য রচিত হয় কথায়, কবিতায়, সোহাগে। ডেজডিমোনার চরিত্রটিকে এখানে একটু অন্য রকম ভাবে নির্মাণ করা হয়েছে। দিয়ার সজাগ দৃষ্টিতে আঁচ করতে অসুবিধে হয় না, তাদের সম্পর্কে ভাঙন ধরানোর মূলে দায়ী অনগ্রই। কিন্তু দিয়ার শিক্ষা ও রুচিতে বাধে এ বিষয়ে অথৈকে আগাম সতর্ক করে দিতে। স্বামীর উপর তার সেই মানসিক আস্থার জোরটুকু ছিল যে অথৈ হয়তো নিজেই একদিন সত্যিটা উপলব্ধি করতে পারবে। এটা যেন এই সময়েরও এক চিরন্তন সত্য। নাটকে আবহ এবং সঙ্গীতের ব্যবহারও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। অন্যান্য চরিত্রে উল্লেখের দাবি রাখেন – ব্রতনাথ সুবীর গোস্বামী, মিলি উপাবেল পাল, মুকুল অর্পণ ঘোষাল, রাজু সুমিত পাজা, বিবস্বান জয়দীপ ঘোষ, বিক্রমলাল জ্যোতির্ময় পণ্ডিত প্রমুখ।

ছুঁয়ে যায় মন

ইন্দ্রাণী দত্তের নৃত্যানুষ্ঠানে

ইন্দ্রাণী দত্তের ‘সৃষ্টি’র পঞ্চদশ বার্ষিক অনুষ্ঠান হয়ে গেল কলামন্দিরে। রুতেই ইন্দ্রানী ও তাঁর ট্রুপ মঞ্চস্থ করল ‘শাম এ মেহেফিল’। যেমন- ‘দিল চিজ্ কেয়া’, ‘পিয়া তো সে নয়না লাগে রে’, ‘মোহে পনঘট্ পে নন্দলাল’ ইত্যাদি। প্রতিটি নৃত্যের সঙ্গে মানানসই আলোর ব্যবহার দর্শক মন ছুঁয়ে যায়। অসীম বন্ধুর কোরিওগ্রাফী ও ইন্দ্রানী দত্তের ভাবনায় ছিল নৃত্যানুষ্ঠানটি। এর পরের নিবেদন ছিল দুই নবীন শিল্পী কিঞ্জল ও রাজনন্দিনীর (ইন্দ্রাণী কন্যা) গান। দু’জনের পরিবেশনই ছিল খুব আন্তরিক। এর পর ইন্দ্রাণী ও তাঁর ট্রুপের নিবেদনে ছিল বিগত বছরগুলি থেকে বাছাই করা কিছু নৃত্য।

যার মধ্যে ছিল ‘বেলাশেষে’-র শীর্ষসঙ্গীত এর সঙ্গে নৃত্যটিও। এ দিনের শেষ অনুষ্ঠান ছিল নচিকেতার গান। এ দিন তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে শ্রোতাদের পছন্দের গান শোনালেন একের পর এক। শুরুতে কয়েকটি গজলের পর একে একে নীলাঞ্জনা থেকে বৃদ্ধাশ্রম সব রকম গানই পরিবেশন করলেন।

যমালয়ে পৌঁছলে

মৃত মানুষও বদলে যায়। খাঁটুরা চিত্তপট-এর ‘যমালয় জমজমাট’ নাটকে

মুখোশের আড়ালে চলছে ভন্ডামি। এমনই সময়ে মানুষের প্রকৃত রূপ তুলে ধরা হল খাঁটুরা চিত্তপট-এর ‘যমালয় জমজমাট’ নাটকে। নির্দেশনায় তরুণ নাট্যকার শুভাশিস রায়চৌধুরী। নিছক মজার হাসির আড়ালে রয়েছে অনেক গভীর কথা। মৃত্যুর পরে শোনা যায় মানুষ হয় স্বর্গে যায়, নয় যমালয়ে। এমনই মৃত তিনজন যমালয়ে পৌঁছোন। একজন আধুনিক কবি, একজন নেতা এবং একজন অভিনেতা। যমালয়ে ঢোকার অনুমতি নিতে চিত্রগুপ্তের সঙ্গে আলাপ হয় তাঁদের। প্রথম পরিচয়েই চিত্রগুপ্ত বুঝে যান যমালয়ে অশান্তি অনিবার্য। তাই তিনি সতর্ক করে দেন যমালয়ের অতন্দ্র প্রহরী গজাকে। এরপর থেকেই ক্রমশ প্রকাশ পেতে থাকে আধুনিক কবি সুদর্শনা, অভিনেতা নটসম্রাট ও নেতা সুখবিলাসের যমালয় দখলের সুপ্ত ইচ্ছা। বিভিন্ন প্রলোভনে গজার জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে এঁরা। কেউ স্বপ্ন দেখান অভিনেতা হয়ে নাম করার। আবার কেউ লোভ দেখান রাজনৈতিক নেতা হয়ে স্বর্গ দর্শনের। গজার মনে প্রাথমিক ইচ্ছা জাগলেও পরে সে এঁদের ভন্ডামিগুলো বুঝতে পারে। চিত্রগুপ্ত ও গজার চেষ্টায় এদের বিরুদ্ধে মামলা হয় যমালয়ের ন্যায়ালয়ে। যেখানে এদের প্রত্যেককে গণতন্ত্র এবং সুস্থ সংস্কৃতির পাঠ দেওয়া হয়। আসলে আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিবেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে অজস্র অপ্রীতিকর ঘটনা। কখনও রাজনীতিকে সামনে রেখে স্বৈরতন্ত্র আবার সংস্কৃতির আড়ালে ভন্ডামি। এই নিম্নমুখী মূল্যবোধের শিকার হচ্ছে আগামী প্রজন্ম ও সমাজ। হাসির নাটক। গজার চরিত্রে সুরজিৎ হালদার-এর অভিনয় বেশ ভাল। অমৃতা মুখোপাধ্যায়ের সুদর্শনা দক্ষ অভিনয়ের পরিচয় দেয়। সুখবিলাস চরিত্রে সুজিত মজুমদার বেশ দাপুটে অভিনেতা।

শঙ্খদীপের নটসম্রাট-এর ভূমিকায় শুভাশিস। তপন রায়চৌধুরী এবং সোমনাথ সিংহের অভিনয় ভাল লাগল। বিচারকের ভূমিকায় শুভাশিসের স্বল্প সময়ের অভিনয়ে বোঝা যায় তিনি বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয়ে কতখানি দক্ষ। আবহে স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় সুর ও নৈঃশব্দকে চমৎকার মিশিয়েছেন।

রাধার আকুতি

উদয়শঙ্কর ডান্স ফেস্টিভ্যালে অনেকের মতোই নজর কাড়লেন চন্দ্রা ঘোষ ও সহ-শিল্পীরা। তাঁর পরিবেশিত প্রথম নৃত্যানুষ্ঠানে ছিল রাধা ও কৃষ্ণের চিরাচরিত গভীর প্রেম-আধারের কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতি। যা নৃত্যের সঙ্গে আরও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ ও রস বোধ সৃষ্টি করে। কৃষ্ণের বাঁশির টানে রাধার আকুতি, চন্দ্রার নৃত্য অন্য মাত্রা যোগ করে। ‘গতিভেদ পল্লবী’ পরিবেশিত হয় সঙ্গীতের নানা ছন্দে। বোল, পাখোয়াজে আরও মোহময় হয়ে ওঠে কখনও কখনও। বাগেশ্রী, তাল-একতাল এর সমন্বয়ে তা আরও সমৃদ্ধ করেছেন ঐশী গুপ্ত, রূপলেখা মুখোপাধ্যায়, কৃতি চৌধুরী ও রেশমি মুখোপাধ্যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

song dance drama
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE