Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ৩...

শ্যাম রাখি না কূল

একই সঙ্গে অফিস বাড়ি সামলাতে নাজেহাল ঘরণিরা। জন্মাচ্ছে অপরাধবোধ। ভুক্তভোগীদের অসহায়তা শুনলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।একই সঙ্গে অফিস বাড়ি সামলাতে নাজেহাল ঘরণিরা। জন্মাচ্ছে অপরাধবোধ। ভুক্তভোগীদের অসহায়তা শুনলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

আজকাল মাঝেমধ্যেই অদ্ভুত অবসাদ গ্রাস করে শ্রাবণীকে। মনে হয় জীবনটাকে ‘ব্যালেন্সড’ করতে পারলেন না। একটা ব্যর্থতা-বোধ ক্রমশ চেপে বসছে। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় নিজের উপর। চাকরি করতে গিয়ে সংসারটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল, আবার সংসার সামাল দিতে গিয়ে কেরিয়ারও তেমন জমল না। এখন মনে হয়, জীবনের সব দিকেই শুধু ফাঁক রয়ে গেল, শুধু ‘কমপ্রোমাইজ’ করে গেলেন।

আত্মনির্ভর হতে চাওয়া অনেক চাকুরিরতা মহিলাই জীবনের একটা পর্যায়ে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলাতে পারেন না। মনোবিশেষজ্ঞ মোহিত রণদীপ ব্যাখ্যা করছিলেন, হয়তো সেই মহিলা দেখেন, আর্থিক দিক থেকে সারা জীবন তিনি পরিবারকে কতটা সাহায্য করেছেন, কত কষ্টে নিজের ক্লান্তির তোয়াক্কা না-করে অফিস সামলে বাড়ির জন্য সময় বার করেছেনসেই সব হিসাব কেউ রাখেনি। উল্টে প্রিয়জনের কাছেই ‘দায়িত্বহীন’ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। তখনই হতাশা, অপরাধবোধ জমতে থাকে মনে।

দু’দিক থেকে অপরাধবোধ আসতে পারে। অনেকের মনে হতে পারে, এর থেকে বরং কেরিয়ারকে প্রায়োরিটি দিলেই বুদ্ধিমানের কাজ হত। আবার অনেকে ভাবতে থাকেন, চাকরি ছেড়ে বাড়িতে থাকলেই হত। অফিসের পিছনে ছুটতে গিয়েই কাছের লোকেরা দূরে সরে গেল। অবসরের পর এখন আঁকড়ে ধরার কোনও জায়গা পাচ্ছেন না।

যদিও বাগুইআটির কলেজ শিক্ষিকা মনীষা বা যাদবপুরের বেসরকারি সংস্থার জনসংযোগ আধিকারিক অঙ্কণার মতো অনেকের ‘চাকুরিরতাদের অপরাধবোধ’ বিষয়টাতেই ঘোরতর আপত্তি। একটা মেয়ে চাকরি করে বলেই তাঁকে মানসিক টানাপোড়েনে ছারখার হবে? তাঁর অপরাধবোধ হবে? কেন? এখনকার দিনে ছেলে বা মেয়ে সকলেরই স্বনির্ভর হওয়া, চাকরি করা স্বাভাবিক। সেটা করতে গিয়ে দু’জনের ক্ষেত্রেই কখনও সংসার ও কেরিয়ারের মধ্যে ভারসাম্য থাকবে, কখনও ভারসাম্য টলবে। এর জন্য আলাদা করে মেয়েরা আত্মগ্লানিতে ভুগতে যাবে কেন?

যুক্তি অকাট্য। কিন্তু বিদিশা, অনামিকা, রেশমী, অর্চিতাদের অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতায় হাড়েহাড়ে বুঝছেন ‘সমানাধিকার’ তত্ত্ব আত্মস্থ করতে সমাজের এখনও সময় লাগবে। নারীবাদী আন্দোলনে যে বিষয় নিয়ে সহজে গলাফাটানো যায় তা প্রাত্যহিক জীবনচর্চায় আনতে গেলে এখনও ধাক্কা খেতে হয়। এখনও ছেলেরা শুধু চাকরি করেই উল্টে দেবে। আর মেয়েরা যত ভাল চাকরিই করুক না কেন, বাড়ির লোক ধরেই নেবে সমানতালে সংসারের যাবতীয় কর্তব্য পালন এবং বাচ্চা মানুষ করা তাঁর বাধ্যতামূলক দায়িত্ব। সেই প্রত্যাশিত পরিষেবা তাঁর কাছ থেকে না-পেলেই সেই মেয়ে সৃষ্টিছাড়া, আত্মসুখী, স্বার্থপর। এই সামাজিক ধারণার কাঠামোতেই নিহিত থাকে চাকুরিরতার অপরাধবোধের বীজ।

খড়দহের বিদিশা মজুমদার এখন ৪৬। বেসরকারি সংস্থার ম্যানেজার। বাড়িতে শাশুড়ি আর আয়া-র কাছে মেয়েকে রেখে অফিস যেতেন। বদখত কাজের সময়, অফিস পলিটিক্স, অনবরত টার্গেট ছোঁয়ার চাপ সহ্য করে যতটুকু সময় বার করা যায় পুরোটাই মেয়ের জন্য, বাড়ির জন্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এতগুলো বছর পেরিয়ে জীবনের মধ্যাহ্নে পৌঁছে বিষণ্ণ বিদিশা বলেন, “যে মেয়ের জন্য নিজের ছুটির দিন, নিজের শখ, নিজের ভাললাগা, বন্ধুবান্ধব, সিনেমা, পদোন্নতি, ভিনরাজ্যে লোভনীয় পোস্টিং বিসর্জন দিয়েছি সে-ই এখন অনুযোগ করে, আমি নাকি চাকরির জন্য ওর প্রতি এবং বাড়ির প্রতি মনোযোগ দিইনি। অথচ ওর বাবা-র প্রতি কিন্তু সেই অভিযোগ নেই। বাবা কোনও দিন বাড়িতে সময় না দিলেও নেই।” কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় শ্রীরামপুরের তপতী বর্মনের মেয়ে এক সহপাঠীর সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। বাড়ির অনেকেই অম্লান বদনে তপতীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, বাড়িতে মন না দিয়ে মায়েরা রাত-দিন চাকরি-চাকরি করে বাইরে থাকলে এমনই হয়।

অর্চিতা মুখোপাধ্যায়ের শাশুড়ি এক দিন সরাসরি ‘ফতোয়া’ জারি করেছিলেন, “তুমি যখন চাকরি করছ তখন বাড়ির কোনও ব্যাপারে এমনকী কী রান্না হবে সে ব্যাপারেও কখনও কোনও মতামত দেবে না। আমার মত অনুযায়ী সব হবে। চাকরি ছাড়লে তবে সংসারের ব্যাপারে কথা বলার অধিকার থাকবে তোমার।”

সংযুক্তার সমস্যাটা অন্য। স্বামী-স্ত্রী-র সংসার। দু’জনেই চাকরি করেন। বিয়ের চার বছর পরেও বাচ্চার কথা ভাবতে পারছেন না। বাচ্চা হলে বাড়িতে দেখবে কে? শুধু আয়ার কাছে ফেলে রাখতে ভয় করে। আত্মীয়দের অনেকেই তাঁকে ক্রমাগত চাকরি ছাড়ার পরামর্শ দিয়ে চলেছেন।

বহুজাতিক সংস্থার সেলস ম্যানেজার রেশমীর অনুভব, প্রচুর মেয়ে এখন চাকরি করলেও এখনও সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হল, মেয়েরা চাকরি করে ভাল মাইনে বাড়ি আনবে আবার কোমরে আঁচল জড়িয়ে পাকা গৃহিণী হয়ে থাকবে। যখনই সেই মেয়ে সকাল ১০টায় অফিসে বেরিয়ে রাত ন’টায় বাড়ি ঢুকবে, শনি-রবি বা অন্য ঘোষিত ছুটির দিন ছুটি পাবে না, অমনি সবার কপাল কুঁচকে যাবে।

একটা ছেলে সেটা করলে কিন্তু তা হবে না। সবাই তখন বলবে, আহা! সংসার চালানোর জন্য কত বাড়তি পরিশ্রম করছে! আরও কুড়ি-পঁচিশ বছর লাগবে এই মনোভাব বদলানোর জন্য।

তাতেও হবে কিনা সন্দেহ। রেশমীর কথায়, “একমাত্র দশটা-পাঁচটার চাকরি করলে তবে মেয়েদের পক্ষে সংসারে পুরোদমে নজর দেওয়া সম্ভব। আমার অনেক বন্ধু ঘর-বাইরের এই টানাপড়েন সহ্য করতে না-পেরে, টাইম ম্যানেজমেন্টের কাছে হেরে গিয়ে চাকরি ছেড়েছেন এবং তার জন্য পরবর্তীকালে আরও বেশি অবসাদে, আত্মগ্লানিতে তলিয়ে গিয়েছেন।”

ছেলে ঋদ্ধিমানের রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করার পরেই অপরাধবোধটা চেপে বসেছিল পারমিতার মনে। পেরেন্টস-টিচার মিটিংয়ে ঋদ্ধিমানের ক্লাসটিচার বার-বার বলছিলেন, ‘মা-কে আরও বেশি দেখতে হবে।” যেন বাচ্চার প্রতি নজর রাখা একা মায়ের কাজ। কী করে দেখবে পারমিতা? অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই তো রাত দশটা বেজে যায়। ক্লান্তিতে তখন শরীর-মন ভেঙে যাচ্ছে। ঋদ্ধিমানেরও তখন ঘুমনোর সময় হয়ে এসেছে ঘুমোতে যাচ্ছে।

তা হলে কি পারমিতা চাকরি ছাড়বে? সারাজীবন নিজের মা-কে দেখেছেন অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছিল না বলে পরিবারে কুঁকড়ে থাকতে। মায়ের কোনও মতামতই গ্রাহ্য করা হত না। সংসারে তিনি যে যত্ন দেন তার কোনও দামই ছিল না, বাবা টাকা রোজগার করছেন বলে শুধু তাঁরই খাতির। দেখে-দেখে জেদ চেপে গিয়েছিল। কিছুতেই এ ভাবে নুয়ে থাকবে না সে। চাকরি করতেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পরেই চাকরি পেয়েছেন। সেই স্বনির্ভরতা কি এ বার বিসর্জন দিতে হবে? গভীর দোলাচলে এলোমেলো হতে থাকে পারমিতার সত্তা।

মনোবিদ প্রশান্ত রায় বলছিলেন, শুধু ছেলেমেয়ের রেজাল্ট খারাপ হওয়া নয়, অফিসের জন্য বাচ্চার স্কুলের ফাংশানে বা পরীক্ষার খাতা দেখতে যেতে না পারা, নিজের হাতে টিফিন করে দিতে না-পারা, স্কুলে পৌঁছে দিতে বা স্কুল থেকে আনতে না-পারার মতো অনেক কারণেই অপরাধবোধে ভুগতে থাকেন মূলত মায়েরা। কারণ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ তাঁদের মনে করিয়ে দিতে থাকে যে এ সব একান্ত ভাবে মায়েদের দায়িত্ব।

বাচ্চাকে সময় দিতে পারছেন না এই অপরাধবোধ থেকে অনেক চাকুরিরতার ‘কমপেনসেটারি বিহেভিয়ার’ দেখা যায় বলে জানিয়েছেন মনোবিদেরা। তাঁরা তখন ছেলেমেয়েকে যা চাইছে তাই কিনে দেন, সব আব্দার মেনে নেন। এমনকী স্বামী বা বাড়ির অন্য সদস্যদের জন্য প্রাণপাত করে কাজ করতে চান, বেশি-বেশি খেয়াল রাখতে চান। নিজের পছন্দ, ভালমন্দের প্রতি কেয়ার করেন না। এতে অন্যরা অনেক সময় তাঁকে ‘টেকন ফর গ্রান্টেড’ করে ফেলতে পারে, তাঁর প্রতি বিরক্ত বোধ করতে পারে। তেমনি তিনি নিজেও এই ভূমিকায় থেকে এক সময় ক্লান্ত হয়ে যেতে পারেন।

যাদবপুরের সর্বানী মিত্র মুস্তাফি নামী সংস্থার অ্যাকাউন্টেন্ট। বেয়াল্লিশ পেরিয়েছেন। ছুটির দিন তাঁর বর সারাদিন শুয়ে কাটাতে পারেন কিন্তু তিনি রান্নাঘরে না-ঢুকলে সবার মুখ হাঁড়ি হয়। সারা সপ্তাহ অফিসের জোয়াল টেনে তাঁরও যে ছুটির দিন একটু আরাম করতে ইচ্ছা করে, সেটা কারও মনে হয় না। উল্টে ছেলেমেয়েদের সে দিন মায়ের হাতের রান্না খেতে ইচ্ছা করে আর শাশুড়ি মায়ের মনে হয়, বৌমা একটু ঘরদোর সাফসুতরো করে দিক। অন্য দিন তো সময় পায় না। সর্বানীর কথায়, “এখন আমার মনে হয়, মেয়েরা চাকরি করবে ঠিক করলে বিয়ে করা উচিত নয়, আর বিয়ে করলে চাকরি নয়। তাতে অন্তত প্রত্যাশার চাপে আমার ‘আমি’টা হারিয়ে যায় না।”

নিজের ফ্ল্যাটটাকে অনেকটা সরাইখানার মতো মনে হয় বাঁশদ্রোণীর মনামি-র। সে আর রণদীপ সকালে উঠছে, হুড়মুড় করে তৈরি হচ্ছে, খাচ্ছে কী খাচ্ছে না, অফিসে দৌড়চ্ছে। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে রাত দশটা-সাড়ে দশটা। বাড়ির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে ওঠে না। ঘরে ঢুকলে আরাম হয় না। তাঁর মায়ের বাড়ি এমনকী শ্বশুরবাড়িতেও কেমন একটা বাড়ি-বাড়ি গন্ধ আছে। শান্তি আছে। আজকাল এর জন্য মনে-মনে নিজেকেই দোষী ঠাওরায় মনামি। হয়তো চাকরি না-করলে বাড়িতে আরও যত্ন দিতে পারত।

কিন্তু পরক্ষণেই আবেগ হঠিয়ে তাঁর মস্তিষ্ক যুক্তি দেয়, দু’দিন বাড়িতে বসে থাকলেই অবসাদ ঘিরে আসবে। আফশোস খেয়ে ফেলবে। নিজের আলাদা পরিচয় অর্জন করতেই এত কষ্ট করে উচ্চশিক্ষা নেওয়া, চাকরি পাওয়া। সব ছেড়ে দেবে? ইদানিং যুক্তির সঙ্গে আবেগের, কেরিয়ারের উচ্চাশার সঙ্গে মধ্যবিত্ত মেয়ের স্বত্ত্বার নিরন্তর সংঘাত হয়। তবু দাঁতে-দাঁত চেপে থাকে সে। ভরসা থাক। জীবনে ভারসাম্য খুঁজে নেওয়ার লড়াইয়ে এত তাড়াতাড়ি হার মানা বোকামি।

নিজেকে ভাল রাখবেন কী ভাবে

অফিস বা বাড়ি কোনওটির জন্যই নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে সময় দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করবেন না

‘না’ বলতে শিখতে হবে। বাড়িতে কতটা সময় দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব তা প্রথম থেকে পরিবারের সদস্যদের কাছে স্পষ্ট করে দিন

বাড়িতে থাকার সময় অফিসের কাজ এবং অফিসে থাকার সময় বাড়ির কাজ না-করার চেষ্টা করুন

টাইম ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি। অযথা কোনও জায়গায় সময় নষ্ট করবেন না। তাতে দু’ জায়গায় সময় ম্যানেজ করা সহজ হবে

বাড়ির কাজ নিজের স্বামী-র সঙ্গে ভাগ করে নিন। স্বামী আগ্রহ না দেখালে পরিবারের অন্য কোনও সদস্যের বা মাইনে করা কাজের লোকের সাহায্য নিন। অপরাধবোধে ভুগে সব নিজে করতে যাবেন না

ঘর-বার সামলাতে নিজের স্বাস্থ্যকে অবহেলা করলে চলবে না। নিজেকে ভালবাসতে হবে, যত্ন করতে হবে। দিনে অন্তত ৬-৭ ঘণ্টা ঘুমোতে হবে

অফিস ও পরিবারকে সময় দেওয়ার মাঝখানে সপ্তাহে কিছুটা সময় শুধু নিজের জন্য রাখতে হবে। নিজের যা ভাল লাগে তাই করতে হবে

পরামর্শ: মনোচিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম,

মনোবিদ প্রশান্ত রায় ও মনোবিদ মোহিত রণদীপ
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
মডেল: পায়েল সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

parijat bondhopadhyay service woman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE