Advertisement
১১ মে ২০২৪

যুদ্ধদীর্ণ জীবনকে সেরা সম্মান

বুকার প্রাইজের ৫০ বছর পূর্তিতে মানুষের ভোটে বিশেষ ‘গোল্ডেন বুকার’ পুরস্কার পেল মাইকেল ওনদাতশি-র উপন্যাস ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ভালবাসার, জীবনের সার সত্যের সন্ধান দেয় এই বই।বুকার প্রাইজের ৫০ বছর পূর্তিতে মানুষের ভোটে বিশেষ ‘গোল্ডেন বুকার’ পুরস্কার পেল মাইকেল ওনদাতশি-র উপন্যাস ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে ভালবাসার, জীবনের সার সত্যের সন্ধান দেয় এই বই।

স্রষ্টা: ‘গোল্ডেন ম্যান বুকার প্রাইজ’-এর মঞ্চে বক্তৃতারত মাইকেল ওনদাতশি। ছবি: গেটি ইমেজেস।

স্রষ্টা: ‘গোল্ডেন ম্যান বুকার প্রাইজ’-এর মঞ্চে বক্তৃতারত মাইকেল ওনদাতশি। ছবি: গেটি ইমেজেস।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৮ ০৮:০০
Share: Save:

এত বড় বাড়িতে দুটি মাত্র প্রাণী। কিছু দিন আগেও যখন যুদ্ধ, মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, ইতালির এই ছোট্ট শহরের সব ভিলা, এমনকি সন্ন্যাসিনীদের মঠেও ঘাঁটি গেড়েছিল জার্মান সেনা। মিত্রশক্তির সৈন্যরা এসে কুকুরতাড়া করে খেদানোর আগে ওরা আগুন জ্বালিয়ে, বোমা মেরে ধসিয়ে দিয়ে গিয়েছে নিজেদেরই একদা-আশ্রয়। শুধু কি তাই? বিরাট বাড়ির নানান ঘরে মাইন পুঁতে, পিয়ানোর মধ্যেও বোমা বসিয়েছে ওরা। সেই বাড়িই পরে হাসপাতাল— কত আহত সেনা, ডাক্তার-নার্সের ছুটোছুটি, প্রাণরক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা। নিরাপত্তার কারণে এক দিন সবাই চলে গেল যখন, যায়নি শুধু নার্স ‘হানা’। এখনও এক রোগী যে পড়ে আছে এই হাসপাতালের বেডে! সারা গা পোড়া, বিছানার সঙ্গে লেপ্টে-থাকা একটা পুরুষশরীর। প্রতি চার দিন অন্তর তার গা মুছিয়ে দেয় সে, ফুঁ দিয়ে জুড়োয় পুড়ে ঝামা চামড়ার ক্ষত। দাঁত দিয়ে প্লামের খোসা ছাড়িয়ে, বীজটা ফেলে দিয়ে, মাংসল ফলটুকু পুরে দেয় রোগীর মুখে। পেশেন্ট হাসে। খায়। ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে বই পড়েও শোনায় হানা। যখন যা-খুশি বই, ইচ্ছেমতো পাতা থেকে— ৯৬ বা ১১১। এই পেশেন্টের সঙ্গেও একটা বই ছিল, হেরোডোটাস-এর ‘দ্য হিস্ট্রিজ়’। অদ্ভুত বই, তার সব পাতা নেই, কোথাও অন্য বইয়ের পাতা কেটে বা আঠা দিয়ে জোড়া, কোথাও লোকটারই হাতে লেখা নোট। সেই লেখা থেকে, আর মানুষটার মুখের ছেঁড়া-ছেঁড়া, অগোছালো স্মৃতিকাহন শুনেই না তার ‘পেশেন্ট’কে এই ক’মাস একটু একটু করে বোঝার চেষ্টা করছে সে!

মাইকেল ওনদাতশি-র বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’-এর শুরুটা এ ভাবেই। ১৯৯২-এ প্রকাশিত যে বই চলতি সপ্তাহেই জিতে নিল বুকার প্রাইজ়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে আয়োজিত ‘গোল্ডেন বুকার’ সম্মাননা। ১৯৬৮-তে যাত্রা শুরু বুকারের, ২০১৭ অবধি মোট ৫১ জন পুরস্কারজয়ীর ৫১টি বই ফিরে পড়েছিলেন পাঁচ বিচারক। তার পর বেছে নিয়েছিলেন পাঁচ দশকের ‘সেরা পাঁচ’ বই: ভি এস নইপলের ‘ইন আ ফ্রি স্টেট’, পেনিলোপি লাইভলি-র ‘মুন টাইগার’, ওনদাতশি-র ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’, হিলারি ম্যান্টেল-এর ‘উল্ফ হল’ আর জর্জ সন্ডার্স-এর ‘লিঙ্কন ইন দ্য বার্ডো’। সলমন রুশদির ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ ১৯৮১ সাল ছাড়াও বুকারের ২৫ ও ৪০ বছর পূর্তিতে দু’বার সেরার সম্মান পাওয়ায় এই বইকে রাখা হয়েছিল ‘বিবেচনার বাইরে’। বিচারকদের বাছাই পাঁচটি বই তুলে দেওয়া হয়েছিল জনতার দরবারে, সেখানেই সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়ে, নইপলকেও ডিঙিয়ে, সেরার স্বীকৃতি পেয়েছে ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’।

৩৮টা ভাষায় অনূদিত, হলিউডে চলচ্চিত্রায়িত (এবং ১৯৯৬ সালে ন’টা অস্কার জিতে নেওয়া) ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’ খুব জনপ্রিয়। বিশ্বযুদ্ধ শেষের আবহে, যখন আর এক বার পাল্টে যেতে চলেছে পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্র, সেই সময়ে ইতালির এক খন্ডহরে চারটি মানুষের খণ্ডিত জীবনকাহিনি চমকে দিয়েছিল পাঠকদের। শীর্ষচরিত্র এক অচিন মানুষ, নানান ঘটনা-দুর্ঘটনা পেরিয়ে, স্মৃতি-বিস্মৃতি খুঁড়ে যে বুনে চলেছে নিজেরই অতীত-ইতিহাস। সে আদৌ ইংরেজ নয়, তার কণ্ঠস্বর শুনে বাকি চরিত্রেরা দেয় তাকে নতুন পরিচিতি: ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’। বাকি চরিত্রেরা— কানাডিয়ান আর্মি নার্স ‘হানা’, জার্মান বোমা নিষ্ক্রিয় করার কাজে সিদ্ধহস্ত ভারতীয় শিখ ‘কিপ’, আর অক্ষশক্তির কাগজপত্র চুরিতে দড় কানাডিয়ান চোর কারাভাজিয়ো। এদের জীবন আলাদা, জীবনকে দেখার চোখও। কিন্তু যুদ্ধ-পরিস্থিতি চার জনকে এনে ফেলেছে চার দেওয়ালের মধ্যে। এদেরই স্মৃতি, সংলাপ, সন্দেহ, সংশয় বুকে নিয়ে এগোয় জটিল এই উপন্যাসের দ্রুতি। তারই মধ্যে উঁকি দিয়ে যায় ভালবাসাও।

জটিল উপন্যাস? নিজের বইকে ‘কমপ্লিকেটেড’ বিশেষণ দিয়েছেন খোদ ওনদাতশি-ই। যে বইয়ের সৌজন্যে তাঁর আবিশ্ব খ্যাতি, তার জন্মকথাপ্রসঙ্গে বলেছেন নিজের জীবনের গল্পও। সারা জীবন পাল্টে পাল্টে গিয়েছে তাঁর নিজের ঠিকানাও। শ্রীলঙ্কায় (তখন সিংহল) জন্ম, ডাচ-সিংহলি-তামিল রক্ত তাঁর ধমনীতে। শৈশবেই মা-বাবার বিচ্ছেদ, মা চলে যান ইংল্যান্ডে। এগারো বছর বয়সে কিশোর মাইকেলও পাড়ি দেন বিলেত, একা! লন্ডনে খানিক পড়াশোনা, তার পর ঠাঁই বদলে কানাডা। কলেজে সাহিত্য পড়াচ্ছিলেন, তত দিনে মাথায় এসে গিয়েছে ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’, কিন্তু ছাত্র-পড়ানোর পাশাপাশি উপন্যাস লেখার কাজ এগোচ্ছে না কিছুতেই। দুটোকে একসঙ্গে সামলানো কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। যে দিন মন বলল, এ ভাবে চললে কিন্তু বইটাকে ছাড়তে হবে, সে দিন চাকরি ছাড়লেন। কাজের শেকল থেকে মুক্তি এনে দিল বহুকাঙ্ক্ষিত লেখনী। বাকিটা তো ইতিহাস!

তাঁর লেখায় ইতিহাসের স্রোতে মিলেমিশে যায় সমসময়ের শাখানদী। ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’ লেখার সময় যেমন মাথায় ছিল জাতীয়তাবাদ, দেশাত্মবোধ আর এই সব নিয়ে মানুষের মনে-মাথায় বিজবিজ করা বদ্ধমূল সংস্কারগুলো। নব্বইয়ের দশকের সেই সময়ে কানাডায় একটা বিতর্ক উঠেছিল দেশের সেনাবাহিনীতে যোগদানকারী শিখদের পাগড়ি পরা নিয়ে। লোকে বলছিল, ওদের ধর্মে যা-ই থাকুক, আর্মিতে এলে ও সব উৎকট-বিকট সাজপোশাক চলবে না। ওনদাতশি-র উপন্যাসের ‘কিপ’ (পুরো নাম কিরপাল সিং) সেই বিতর্ক থেকেই উঠে আসা চরিত্র। সে ব্রিটিশ সেনার হয়ে যোগ দিয়েছে বিশ্বযুদ্ধে, বোমা-মাইন নিষ্ক্রিয় করে সহ-সেনার পথ সে সুগম করে অনায়াস দক্ষতায়। কোথায় তার স্বদেশ ভারত, আর কোথায় এই যুদ্ধান্তের বোমা-বিধ্বস্ত ইতালি! কিপ-এর কিন্তু গোঁড়া স্বদেশপ্রিয়তা নেই কোনও। স্বজনবান্ধব থেকে বহু দূরে, এই অনিশ্চিত সঙ্কটকালেও সে হানাকে ভালবাসে। আবার বইয়ের শেষে যখন খবর আসে, আমেরিকা জাপানের উপরে বোমা ফেলেছে, হতাশ কিপ-এর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ‘‘(জাপান) দেশটা সাদাচামড়ার হলে কিন্তু ওরা বোমা ফেলত না!’’

‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’ (১৯৯৬) ছবির দৃশ্য

যার নামে উপন্যাস, সেই পেশেন্টও তো আসলে ‘ইংলিশ’ নয়। কাউন্ট আলমাসি জন্মসূত্রে হাঙ্গেরিয়ান, কিন্তু সারা জীবন সে থেকেছে রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন, গিয়েছে স্থান থেকে স্থানান্তরে। সে মরু-পর্যটক, আফ্রিকার মরুভূমিতে কাজ করছিল, সেখানেই সহকর্মী জিয়োফ্রের বউ ক্যাথরিনের সঙ্গে প্রেম। প্রেম, বিশ্বাসভঙ্গ, প্রতিশোধস্পৃহা গড়ায় বিমান-দুর্ঘটনায়, বদলে দেয় আলমাসির জীবনটাই। এক কালে ব্রিটিশদের হয়ে আফ্রিকার ম্যাপ তৈরি-করা লোক পরে সেই ম্যাপ কাজে লাগিয়েই পার করে দেয় জার্মান গুপ্তচরকে। জীবন তাকে শেষমেশ এনে ফেলে ইতালির এই বাড়িতে হানা, কিপ আর কারাভাজিয়ো-র কাছে। যুদ্ধের বাজারে সে যেন একটা সাদা পাতা, তার নিজের কোনও আঁকড়ে ধরা দেশ নেই, দেশের বোধ নেই, ধারণা নেই। বাকি চরিত্রেরা সেই পাতায় নিজেদের কথা লিখে যায়। চেতন-অচেতনের পারে চলে-যাওয়া একটা মানুষ শুধু অন্তিম মরফিনটুকু চায়— যুদ্ধ, দেশ, জাতির মতো শব্দগুলো তাকে স্পর্শ করে না, তাকে ছুঁয়ে থাকে শুধু ভালবাসা।

‘এভরি নাইট আই কাট আউট মাই হার্ট। বাট ইন দ্য মর্নিং ইট ওয়াজ় ফুল এগেন।’—এর মতো অমোঘ ভালবাসার কথা আর ক’জন লিখতে পেরেছেন? এমন লাইন লেখার জন্যই বুঝি চাকরি ছাড়তে হয়; শব্দের, অনুভবের সাধনা করতে হয়। তাঁর উপন্যাস লেখার প্রক্রিয়াটা কী?— ‘‘হাতে-লেখা অন্তত চারখানা খসড়া তো হয়ই গোড়ায়। তার পর সেগুলো কম্পিউটার বা টাইপরাইটারে টাইপের প্রশ্ন। তার পরেও অদলবদল, ফের হাতে লেখা— এই চলে।’’ আর এক-একটা চরিত্র, দৃশ্য বা ইমেজের ‘ইন্সপিরেশন’? সেও ঘটে। লিখতে লিখতেই হয়তো কোনও ছবি, বা কারও কবিতার টুকরোয় ঢুকে পড়ল মন। তারাই উপন্যাসের ভাব, ভাষা জোগায়। তাঁর ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’-এর খসড়া নোটবুকের পাতায় সাঁটা আছে একটা ছবি। কোনও ম্যাগাজিনে বেরিয়েছিল। অক্সফোর্ডে একটা পার্টিতে মদের বোতল, প্লেটে খাবার, ফল। এই ছবিটাই পরে বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাসের একটা দৃশ্য হয়ে ফিরে এসেছিল! যেমন ফিরে এসেছিল লেখকেরই লন্ডনের কলেজে বন্ধুদের দেওয়া ডাকনাম ‘কিপ’, চরিত্র হয়ে! ওনদাতশি তাঁর যাবতীয় নোটবুক, লেখালেখির খসড়া কিছু দিন হল দিয়েছেন আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের ‘হ্যারি র‌্যানসম সেন্টার’কে। সেখানে রবার্ট ব্রাউনিংয়ের ঠিকানা-লেখা খাতা, ওয়াল্ট হুইটম্যানকে লেখা টেনিসনের চিঠির সঙ্গে রাখা থাকবে মাইকেল ওনদাতশি-র ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’ নোটবুকও!

পাঁচ বিচারকের এক জন, কামিলা শামসি— যিনি নব্বইয়ের দশকের সেরা হিসেবে ওনদাতশি-র বইটা বেছেছিলেন— বলেছেন, ‘‘ওঁর চরিত্রেরা তো ঠিকানাহীন, ওরা থিতু ঘর খুঁজে পায় ওঁর ভাষাতেই।’’ ‘দি ইংলিশ পেশেন্ট’ পড়তে পড়তে সেই অনুভূতিটাই হয়। ‘আ নভেল ইজ় আ মিরর ওয়াকিং ডাউন আ রোড’, মাইকেল ওনদাতশি-র বইয়ে একটা উপন্যাস হাতে নিয়ে হানা ভাবে। আমরা পাঠকেরাও কি লেখকের সঙ্গে চলতে চলতে সেই পথ-হাঁটা আয়নায় মুখ দেখি না?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE