বাঁ দিক থেকে, অতনু পাল, সৌরভ কৈবর্ত, পূজা চৌধুরী ও ফিরোজা খাতুন।
পরীক্ষাটা ছিল ছেলের। মায়েরও। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছেলে হঠাৎ কখন যে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করবে, বাইরের কারও পক্ষে তা আন্দাজ করা কঠিন। বিরক্ত হলেই দু’হাত মুঠো করে থুতনির সামনে এনে সজোরে মাথা নাড়তে থাকে সে। কিন্তু মাধ্যমিক দিতে বসে এমন হলে তো চলবে না। পরীক্ষার হলের বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে সারা ক্ষণই ছেলের মতিগতির উপরে নজর রাখতে হয়েছে কাবেরী পালকে। সিঁদুরে মেঘ দেখলে আকারে-ইঙ্গিতে তাকে শান্ত করাই ছিল তাঁর পরীক্ষা।
ফলও মিলেছে। আলিপুরদুয়ার কলেজিয়েট স্কুলের ওই পরীক্ষার্থী, অতনু পাল ৫৪ শতাংশ নম্বর পেয়ে এ বার মাধ্যমিক পাশ করেছে। জীবনবিজ্ঞানে ৮৩। অতনু ‘অটিজম’ বা ‘বাস্তববধির’ রোগে আক্রান্ত। বাস করে নিজের জগতে। বাড়ি থেকে বেরোয় না। বন্ধুবান্ধবও নেই। ছ’সাত বছর পর্যন্ত মগ্ন থাকত ছবি আঁকায়। এতটাই যে, তাকে ছবির জগৎ থেকে বার করে আনতে অন্য দিকে মন ঘোরানোর পরামর্শ দেন চিকিৎসক। ছেলেকে তখন গান, তবলা, সাঁতার শেখাতে শুরু করেন অতনুর বাবা, উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার কর্মী রিন্টু পাল। ছেলেকে আরও সঙ্গ দিতে আর তার পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে স্বেচ্ছাবসর চেয়ে আবেদনও জানিয়ে রেখেছেন রিন্টুবাবু।
মাধ্যমিকে অতনুর লড়াইটা মোটেই অন্যদের সঙ্গে ছিল না। ছিল তার নিজের সঙ্গেই। নিজের বেয়াড়া আবেগকে লাগাম পরিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই লড়াই জিতেই ছেড়েছে অতনু। জিতেছেন তার মা কাবেরীদেবীও।
মাধ্যমিকে বসার জন্য বড় পরীক্ষা দিতে হয়েছে বাঁকুড়ার কোতুলপুরের লেগো রামব্রহ্ম রামকুমার বিদ্যাপীঠের ছাত্র সৌরভ কৈবর্তকেও। অনটনের বাধা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার পরীক্ষা। সেই পরীক্ষায় নিছক উতরে যাওয়াই নয়, নজিরও গড়েছে সৌরভ। বৃহস্পতিবার মাধ্যমিকের মেধা-তালিকা প্রকাশের সময় মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রশাসক কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায় জানান, সৌরভ অষ্টম স্থান দখল করেছে। পেয়েছে ৭০০-র মধ্যে ৬৭৫। বাবা অশোক কৈবর্ত গেঞ্জি কারখানার শ্রমিক। জমিজিরেত নেই, খুবই টানাটানির সংসার। মেধাবী, মনোযোগী সৌরভ সাহায্য পেয়েছে স্কুলের শিক্ষকদের। আর তার সুবাদেই সুরভিত হয়েছে তার স্কুল, তার গ্রাম এবং অবশ্যই গেঞ্জি কারখানার এক শ্রমিকের গরিবখানা!
নবদ্বীপে এপিসি ব্লাইন্ড স্কুলকে যেমন গর্বিত করেছে তাদের দুই ছাত্রী পূজা চৌধুরী আর ফিরোজা খাতুন। দু’জনেই ১০০ শতাংশ দৃষ্টিহীন। মাধ্যমিকে পূজা পেয়েছে ৫৯৯, ফিরোজা ৫৫৮। স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের স্কুলের ২৫ বছরের ইতিহাসে এমন ফল এই প্রথম।” পূজার বাবা, শান্তিপুরের বাসিন্দা পিন্টু চৌধুরী তাঁত-শ্রমিক। দিন-আনি-দিন-খাই সংসারে চরম অভাব সত্ত্বেও একমাত্র মেয়ে পূজার লেখাপড়ার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তিনি। জাতীয় স্তরের দাবা প্রতিযোগিতাতেও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে পূজা। অভিনয় এবং আবৃত্তিতেও রাজ্য স্তরে পুরস্কৃত হয়েছে। এ বার সে কলকাতা ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি হতে চায়। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে রবীন্দ্রভারতীতে সঙ্গীত নিয়ে পড়ার ইচ্ছে আছে তার।
পূজার সহপাঠী ফিরোজার বাবা দুখু শেখ বর্ধমানের পূর্বস্থলীর কাষ্ঠশালি গ্রামের বাসিন্দা। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতমজুরের সংসার। ফিরোজাই বড়। ঠিকমতো অন্নের সংস্থানও নেই। গ্রামের মানুষ এবং সরকারি সহায়তায় ফিরোজা নবদ্বীপের এপিসি ব্লাইন্ড স্কুলে পড়ছে। মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেয়েছে, নাচেও সুনাম আছে তার।
মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র অয়ন দাস এ বার মাধ্যমিকে ৬১৮ নম্বর পেয়েছে, ভৌতবিজ্ঞানে ৯৪। মেদিনীপুর শহরের হাতারমাঠ এলাকার বাসিন্দা অয়নের বাবা তরুণকান্তিবাবু সেলাইয়ের কাজ করেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত অনটনের খোঁচায় নিজের সংসারটাই ছেঁড়াফাটা। মাসে আয় মাত্র আড়াই-তিন হাজার টাকা। দুই ছেলের মধ্যে অয়ন ছোট। বড় ছেলে অঙ্কন এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছেন। অয়ন উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হতে চায় ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্নপূরণে প্রধান বাধা যে অভাব, তা জেনেই এখন থেকে চোয়াল শক্ত করছে ওই কিশোর পড়ুয়া।
মেদিনীপুর টাউন স্কুলের ছাত্র বুদ্ধদেব তোরইয়ের বৃত্তান্ত অনেকটাই এক। মাধ্যমিকে সে পেয়েছে ৬০৯, জীবনবিজ্ঞানে ৯৮। বুদ্ধদেবও চিকিৎসক হতে চায়। কিন্তু কাঁটা সেই অনটন। দুই ছেলে, এক মেয়ে নিয়ে সংসার বুদ্ধদেবের বাবা, বেসরকারি বাসের চালক উজ্জ্বলবাবুর। আয় টেনেটুনে চার-পাঁচ হাজার টাকা। তাতে সংসার চালিয়ে ছেলের উচ্চশিক্ষা সম্ভব? উত্তর পান না উজ্জ্বলবাবু। টাউন স্কুলেরই ছাত্র গণেশ ঘোড়ইয়ের বাবা সুকুমারবাবু সব্জি বিক্রেতা। হাজার তিনেক টাকা রোজগার করেন মাসে। ছেলে এ বার ৮০ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে, জীবনবিজ্ঞানে ১০০-য় ১০০। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে গণেশ। কিন্তু ছেলের স্বপ্ন কী করে পূরণ হবে, জানেন না সুকুমারবাবু।
বছর চারেক আগে পার্ক স্ট্রিটের স্টিফেন কোর্টের অগ্নিকাণ্ডে মারা যান সত্যজিৎ সেনগুপ্ত। স্বামীর মৃত্যুতে একমাত্র সন্তান সায়রকে নিয়ে কার্যত পথে বসেন সাধনাদেবী। সায়রের তখন সবে সপ্তম শ্রেণি। আপাতত নিজের বেসরকারি সংস্থার চাকরির আয় দিয়ে সাধনাদেবী কোনও রকমে টানছেন সংসারটাকে। কলকাতার হার্টলেজ স্কুলের ছাত্র সায়র ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক পাশ করেছে। পড়তে চায় বিজ্ঞান নিয়ে। সাধনাদেবী বলেন, “বাবা অমন বীভৎস ভাবে মারা যাওয়ায় একটা আতঙ্কের ঘোর গ্রাস করেছিল সায়রকে। কিন্তু সে-সবকে আমল দেয়নি ও। কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। এগোচ্ছে নিজের মতো করে।” সারা দিন বাড়িতে একাই থাকতে হয় বছর ষোলোর সায়রকে। মা ফেরেন রাত সাড়ে ৯টা-১০টায়। আরও একটু নম্বর পেলে ভাল লাগত মা-ছেলে দু’জনেরই। ভবিষ্যতে আরও ভাল করার লক্ষ্যে এগোচ্ছে সায়র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy