Advertisement
০৫ মে ২০২৪

৩১ ছিল আগের বার, এ বার ৩২

চার বছরে চার লাফ। কিন্তু পিছনের দিকে! আর তাতেই ২৬ থেকে নেমে ৩২-এ। স্কুলশিক্ষা পরিকাঠামোর বিচারে দেশের ৩৫টি রাজ্যের ক্রম-তালিকায় ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল ২৬। পরের চার বছরে ধাপে ধাপে নীচে নেমে ২০১৩-য় ঠাঁই হয়েছে ৩২ নম্বরে। গোটা দেশে স্কুলশিক্ষার নিরিখে এ রাজ্যের নীচে রয়েছে কেবল ঝাড়খণ্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ।

সাবেরী প্রামাণিক
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৪ ০২:৪৮
Share: Save:

চার বছরে চার লাফ। কিন্তু পিছনের দিকে!

আর তাতেই ২৬ থেকে নেমে ৩২-এ। স্কুলশিক্ষা পরিকাঠামোর বিচারে দেশের ৩৫টি রাজ্যের ক্রম-তালিকায় ২০০৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল ২৬। পরের চার বছরে ধাপে ধাপে নীচে নেমে ২০১৩-য় ঠাঁই হয়েছে ৩২ নম্বরে। গোটা দেশে স্কুলশিক্ষার নিরিখে এ রাজ্যের নীচে রয়েছে কেবল ঝাড়খণ্ড, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ।

কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের ২০১৩-’১৪ সালের বার্ষিক রিপোর্টে প্রকাশিত এই তথ্য আরও একবার পশ্চিমবঙ্গে স্কুলশিক্ষার রুগ্ণতা প্রকট করে দিয়েছে। বিভিন্ন সময়ে কিছু বেসরকারি সংগঠন সমীক্ষা চালিয়ে এই ক্ষেত্রে যে ছবি তুলে ধরেছে, তা সত্যিই করুণ। কেন্দ্রীয় সরকারের রিপোর্টেও তারই সমর্থন মিলল। মানবসম্পদ মন্ত্রক রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর থেকেই এই সব তথ্য সংগ্রহ করে। প্রতি ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ক’টি স্কুল আছে, প্রতি ১০০০ পড়ুয়া পিছু স্কুলের সংখ্যা কত, স্কুলে পানীয় জল, বিদ্যুৎ সংযোগ, শৌচালয়, ছাত্রীদের জন্য পৃথক শৌচালয়, শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা কত, স্কুলছুটের হার ইত্যাদির নিরিখে প্রত্যেক রাজ্যের জন্য এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট ইনডেক্স (ইডিআই) তৈরি করা হয়েছে। রাজ্যগুলির স্থান নির্দিষ্ট হয়েছে সেই সূচকের নিরিখে। তাতেই স্পষ্ট হয়েছে, এ রাজ্যে স্কুলশিক্ষার স্বাস্থ্য নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে।

কিন্তু উদ্বেগ নেই রাজ্যের। এই রিপোর্টকে তারা আমলই দেওয়ার পক্ষপাতী নয়। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “আমি রিপোর্ট দেখিনি। কী বলা হয়েছে, জানিও না। এ সব রিপোর্টকে গুরুত্ব দিই না।” কেন গুরুত্ব দেন না, তা অবশ্য ব্যাখ্যা করেননি শিক্ষামন্ত্রী।

রিপোর্ট বলছে, প্রায় প্রতিটি মাপকাঠিতেই অন্য অনেক রাজ্যের থেকে তো বটেই, দেশের গড়ের তুলনাতেও পিছিয়ে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। পিছিয়ে থাকার এই ট্র্যাডিশন নতুন নয়। ২০০৯-১০-এর ২৬ নম্বরে থাকলেও পরের বছরেই ২৭তম স্থানে নেমে যায় এ রাজ্য। সেই ধারা অব্যাহত রেখে ২০১২-’১৩-তে স্থান হয় ৩১ নম্বরে, আর ২০১৩-’১৪-এ আরও এক ধাপ নেমে স্থান হয়েছে ৩২তম। অর্থাৎ পিছিয়ে পড়ার প্রবণতা যে কেবল তৃণমূল সরকারের আমলেই, তা নয়। এর শুরু বাম আমলেই। তৃণমূল নেতারা তখন বিষয়টির কড়া সমালোচক ছিলেন। কিন্তু এখন তাঁদের সরকার একে আমল দিতে রাজি নয়।

কিন্তু বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, রিপোর্টে থাকা তথ্যগুলিতে যে হেতু সরকারি সিলমোহর রয়েছে, তাই উপেক্ষা করা অনুচিত। তালিকায় একেবারে উপরের দিকে যে সব রাজ্য রয়েছে, তাদের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানো রাতারাতি অসম্ভব। কিন্তু মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার মতো রাজ্য, যারা ১৩-১৪ স্থানে রয়েছে, তাদের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার করে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। না হলে স্কুলশিক্ষার স্বাস্থ্যোদ্ধার দূর অস্ত্।

কী বলছে মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের রিপোর্ট? বলছে, স্কুলছুটের হারে দেশের তুলনায় কয়েক কদম এগিয়ে এ রাজ্য। দেশের হিসেবে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া ছেলেমেয়েদের ১৮% চতুর্থ শ্রেণিতে পৌঁছয় না। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিকের পড়া শেষ না করেই স্কুল ছেড়ে যায় শতকরা ৪০ জন।

প্রবীণ শিক্ষকদের মতে, মাধ্যমিক পর্যন্ত পৌঁছনোর আগে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক হয়। স্কুলশিক্ষা দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এ রাজ্যে ফি বছর প্রথম শ্রেণিতে গড়ে ২০ লক্ষ পড়ুয়া ভর্তি হয়। আর মাধ্যমিকে বসে সাড়ে ১০ লক্ষ মতো। শতকরা ৫০ জনেরই মাধ্যমিকের আগে স্কুলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকে যায়।

রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যের প্রায় ৩৫% স্কুলে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ১:৩৫ এর বেশি। ঠিক কতখানি বেশি, তার উল্লেখ রিপোর্টে না থাকলেও স্কুলশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, প্রাথমিকে কোনও কোনও স্কুলে শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত ১:১০০। মাধ্যমিক স্তরে সেই অনুপাত কোথাও ১:৫০, কোথাও ১:৬০। শিক্ষকদের একাংশের মতে, শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য শিক্ষক পিছু ছাত্রসংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে ফেলা দরকার।

পৃথক শৌচালয় না থাকাটা অনেক ছাত্রীরই স্কুলে যাওয়ায় অনীহার কারণ। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। কিন্তু রাজ্য যে তার থেকে শিক্ষা নেয়নি, তার প্রমাণ মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের এ বারের রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে, দেশের হিসেব অনুযায়ী ১৯% প্রাথমিক স্কুলে ছাত্রীদের পৃথক শৌচালয় নেই। আর এ রাজ্যে নেই ৩১% প্রাথমিক স্কুলে। এ ছাড়া শিক্ষিকার সংখ্যা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, স্কুলে বিদ্যুৎ সংযোগ, পানীয় জলের জোগান ইত্যাদি মাপকাঠিতেই দেশের বিচারে পিছিয়ে পশ্চিমবঙ্গ।

কেন? প্রবীণ শিক্ষা-গবেষক মর্মর মুখোপাধ্যায় বলেন, “দীর্ঘ দিনের দলতন্ত্র, কাজ না করার মানসিকতা, এ সবের জন্যই পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে পড়ে। এ বছরের রিপোর্ট ব্যতিক্রমী নয়। বরাবরই নীচের দিকে ঠাঁই হয় এ রাজ্যের।” শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকারের মতে, এই রিপোর্ট সামনে রেখে রাজ্য সরকারের সচেতন হওয়া উচিত। প্রতীচী ট্রাস্টের প্রকল্প অধিকর্তা কুমার রানা আবার স্থানের বিচারে রাজ্যের এত পিছনে থাকায় তেমন উদ্বিগ্ন নন। তাঁর মতে, রাজ্যে পঠনপাঠনের অবস্থা আশানুরূপ নয় ঠিকই। তবে রিপোর্টে এমন অনেক রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের থেকে এগিয়ে আছে, পরিকাঠামো ভাল হলেও পড়াশোনার মানে তারা এ রাজ্যের থেকে পিছিয়ে।

রিপোর্ট পর্যালোচনা করে স্কুলশিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক বলেন, “স্কুল সার্ভিস কমিশন, প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ মারফত শিক্ষক বাছাই ও নিয়োগে যে জট হয়েছে, তার জেরে কিছু শিক্ষক পদ খালি।” শিক্ষক প্রশিক্ষণ নিয়ে বাম আমলে যে জটিলতা হয়, তার জেরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবও তৈরি হয়েছে।

কেন্দ্রের এই রিপোর্টকে শিক্ষামন্ত্রী আমল দিতে না চাইলেও দফতরের এক প্রবীণ আধিকারিক বলেন “সমীক্ষার ফলাফল নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কোন মাপকাঠিকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত, তা নিয়েও বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু গোটা রিপোর্টটাই উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

schooling infrustructure saberi pramanik
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE