Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সমুদ্রে পথ ভুলে বনকর্মীদের রাঙা চোখের সামনে মৎস্যজীবী

বাঘ-কুমিরের সঙ্গে তাদের লড়াইটা একরকম নিত্য-গোলযোগের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। নদী-নালা-বন্যপ্রাণের সঙ্গে যুঝে রুটি-রুজির জীবন যাপনের চেষ্টাই ‘সোঁদরবনের’ দ্বীপবাসী মানুষের সহজাত জীবন যাপন।

শান্তশ্রী মজুমদার
ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০১৪ ০১:২০
Share: Save:

বাঘ-কুমিরের সঙ্গে তাদের লড়াইটা একরকম নিত্য-গোলযোগের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। নদী-নালা-বন্যপ্রাণের সঙ্গে যুঝে রুটি-রুজির জীবন যাপনের চেষ্টাই ‘সোঁদরবনের’ দ্বীপবাসী মানুষের সহজাত জীবন যাপন।

সেই তালিকায় নয়া সংযোজন বন দফতরের ‘চোখ রাঙানো।’ এমনটাই অভিযোগ করেছেন স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনগুলি। মাছ ধরতে খাল-বিল উজিয়ে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এলাকায় ‘ভুল বশত’ পা রাখলেও তাদের বড় মাপের খেসারত গুনতে হচ্ছে বলে অবিযোগ করেছেন রাজ্য ‘ইউনাইটেড ফিশারমেন ইউনিয়ন’-এর কর্তা চন্দন মাইতি। কেমনতরো খেসারত?

সপ্তাহখানেক আগে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরে ফেরার পথে নামখানার প্রান্তে লুথিয়ান দ্বীপের কাছে ট্রলারে আচমকাই জল ঢুকতে শুরু করেছিল কাকদ্বীপের মৎস্যজীবী বাবলু দাসের। তাঁদের দাবি, প্রাণের তাগিদেই ট্রালারে তাপ্পি মারার জন্য নামতে হয়েছিল দ্বীপে। কিন্তু সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়ায় তাঁর ট্রলারের লাইসেন্সই কেড়ে নিয়েছেন বনকর্মীরা। বাবলুর সঙ্গে ছিল আরও সাতটি ট্রলার। তাদেরও জিপিএস সেট, ওয়্যারলেস সেট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ।

কিন্তু সমুদ্রে ওই নিত্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া চলবে কী করে?

বন দফতরের উত্তরটা খুব সোজা: সংরক্ষিত এলাকা বলেই নয় সুন্দরবনের মোহনায় সংলগ্ন ওই এলাকা বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা। কাজেই অনুমতি ছাড়া ওই এলাকায় ‘মেছো-ট্রলারের’ চলাচল বেআইনি। বনকর্তারা পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেনএ অবস্থায় কোন আইনে ওঁদের ছাড় দেওয়া যায়?

স্থানীয় বনাধিকারিক লিপিকা রায় বলেন, “বিনা কারণে মৎস্যজীবীদের নৌকো আটকানো হয় না। এলাকার মানুষ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করবেন, তাতে আমাদের কোনও আ‌পত্তি নেই। কিন্তু লুথিয়ানে বেশি ক্ষণ ট্রলার না থামানোর জন্য দ্বীপের চারদিকে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া রয়েছে। সন্দেহজনক কিছু হলেই আমরা খতিয়ে দেখি। হয়তো সে জন্যই ওঁদের আটক করা হয়েছে।’’

কতাটা মিথ্যে নয়। বন দফতরের যুক্তি, পরিবেশ ও বনজ সম্পদের প্রহরায় থাকা বনকর্মীদের কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে এলাকায় কোনও ভাবেই যেন মৎস্যজীবীরা অনুপ্রবেশ করতে না পারেন। সে যে দেশেরই হোক না কেন। তা ছাড়া উপকূলরক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, দেশের সীমানা লঙ্ঘনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে ওই এলাকায়। ফলে মৎস্যজীবীদের ওই এলাকায় মাছ ধরার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা মেনে চলা দরকার। তাঁদেরই এক কর্তার প্রশ্ন, “আইন ভাঙলে তার শাস্তি হবে না?”

আর তারই মাসুল দিচ্ছেন সুন্দরবনের অভাবী মৎস্যজীবী পরিবারগুলি।

তবে, পাল্টা যুক্তিও কী নেই? আছে। মৎযস্যজীবীদের সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভিতর দিয়ে গভীর সমুদ্রে যাতায়াতের জন্য বন দফতরের কাছে একটি মানচিত্র চাওয়া হয়েছিল। মেলেনি। ফলে বিভিন্ন খাল-খাঁড়ি বেয়ে বঙ্গোপাসাগরে যাতায়াতের রাস্তায় প্রায়ই তাঁরা ঢুকে ‘অনিচ্ছাকৃত’ ভাবে ভেঙে ফেলছেন বন দফতরের দেখানো নির্দিষ্ট পথ। চলতি মরসুমে এই সমস্যা আরও বেড়েছে। এ ব্যাপারে ওই মৎস্যজীবীরা অবশ্য পাশে পেয়ে গিয়েছেন, রাজ্যের মৎস্য দফতরকে। অতিরিক্ত মৎস্য অধিকর্তা (সামুদ্রিক) কিরণ দাসের কথায়, ‘‘প্রতি বছর মাছের মরসুমের আগে বন দফতরের কর্তাদের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়। কোন কোন এলাকা দিয়ে মৎস্যজীবীরা যেতে পারবেন না তার একটি তালিকা দেওয়া হয়। এ বার অনেকেই তা পাননি বলে অভিযোগ। বিষয়টি নিয়ে আমরা ফের বন দফতরের সঙ্গে বৈঠকে বসব।” লিপিকা বলছেন, “মৎস্যজীবীদের মানচিত্র দেওয়ার প্রশ্ন নেই। কেন্দ্রীয় বনমন্ত্রকের নির্দেশ রয়েছে বনের রেখাচিত্র কারও হাতে দেওয়া যােবে না। তা ওঁদের হাতে তুলে দেব কী করে!”

নামখানা, পাথরপ্রতিমা এবং রায়দিঘি মিলিয়ে গভীর সমুদ্রে প্রায় চার হাজার ট্রলার যাতায়াত করে। রয়েছে প্রায় ২২০০ দাঁড়-টানা নৌকাও। রায়দিঘি থেকে ঠাকুরানি নদী বেয়ে পাথরপ্রতিমার পূর্ব দিক হয়ে গভীর সমুদ্রে যায় ওই নৌকা-ট্রলারগুলি। তার আগে এই অঞ্চলে লুথিয়ান দ্বীপই শেষ ভূখণ্ড। এখান থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যেই গভীর সমুদ্রে যাওয়া যায়।

অনেক সময়েই সমুদ্রে ভেসে পড়ার আগে ট্রলারের ছোটখাটো মেরামতির জন্য ওই দ্বীপই মৎস্যজীবীদের ভরসা। মিষ্টি জলের জন্যও অনেক সময়ে তাঁরা ওই দ্বীপের শরণ নেন। আর তা নিতে গিয়েই অনেক সময়ে বন দফতরের রাঙা চোখের সামনে পড়তে হচ্ছে তাঁদের।

অভিযোগ, বন দফতরের রায়দিঘি রেঞ্জের কলস দ্বীপ, সপ্তমুখী নদীর মোহনায় ভাগবৎপুর, রাক্ষসখালি-সহ লুথিয়ান দ্বীপ এলাকায় সেগুলি আটক করা হচ্ছে। চেকিংয়ের নাম করে বন কর্মীরা তাঁদের জাল, মাছ কেড়ে নিচ্ছেন, কখনওবা ন্যূনতম ১১০০ টাকা জরিমানাও করা হচ্ছে। মৎস্যজীবীদের দাবি, “কয়েক পুরুষ ধরে যারা জল-জঙ্গলে নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাঁদের ওই এলাকার অধিকার নেই? ২০০৬ সালের বনাধিকার আইন অনুযায়ী তা তো আমাদের প্রাপ্য।” মৎস্যজীবী সংগঠনের নেতা বিজন মাইতি বলেন, ‘‘ব্যাঘ্র প্রকল্প এলাকায় মাঝিদের ঢোকা যে নিষেধ, তা আমরা জানি। কিন্তু কী করব পথ হারিয়ে অনেক সময়েই ওই পথে ঢুকে পড়তে হচ্ছে যে।” কিন্তু আইনের চোখে তা ঘোর নিয়মবিরুদ্ধ।

নিরন্তর এই লড়াইয়ের শেষ কোথায়--গভীর মোহনার মতোই অনিশ্চিত সে উত্তর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE