কলেজে বহিরাগতদের তাণ্ডবের পরে কেটে গিয়েছে দিন কুড়ি। এখনও ডান হাতে আঘাতের ফোলা কমেনি অধ্যক্ষের। অফিস ঘর এলোমেলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে চেয়ার-টেবিল। দেওয়াল, আলমারির গায়ে রক্তের ছিটে শুকিয়ে কালো হয়ে এসেছে।
মন্দিরবাজারের বীরেশ্বরপুর কলেজের ওই ঘটনার পরে অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ হাসান জমাদার নিয়মিত কলেজে আসছেন ঠিকই, কিন্তু চেম্বারে বসছেন না। পাশের ঘরে বসে কাজ চালাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘প্রায় বারো বছর ধরে একটু একটু করে কলেজকে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি সকলে। আমার কলেজের কৃতী ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভাল ফল করছে। কিন্তু হামলা কেন হল এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ওই দিনের স্মৃতি এখন ভুলতে পারছি না। তাই ওই অফিস ঘরে আর ঢুকিনি।’’ ঘটনার পর থেকে ছাত্রছাত্রীদের হাজিরা কমেছে বলেও তাঁর দাবি।
কী চাইছেন অধ্যক্ষ? তাঁর কথায়, ‘‘সুবিচার চাই। এমন ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সেই আশ্বাস চাই।’’
কী হয়েছিল কলেজে? ৩১ জানুয়ারি ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ২৯টি আসনের সব ক’টিতে বিনা লড়াইয়ে জয়ী হয় টিএমসিপি। ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকে পদ-সহ অন্য পদে মনোনয়ন ছিল। অধ্যক্ষের উপস্থিতিতেই সে দিন জনা ২৫-৩০ বহিরাহত যুবক কলেজে ঢুকে তাণ্ডব চালায়। লাঠি রড দিয়ে মারধর করা হয় ছাত্রনেতা, শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীদের। হেনস্থা করা হয় অধ্যক্ষকেও। প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে তছনছ চলে কলেজে। ভাঙচুর হয় সিসিটিভি, চেয়ার-টেবিল। গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রও নষ্ট করে হামলাকারীরা। অভিযোগ ওঠে, সে দিন হামলার নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় তৃণমূলের বিধায়ক তথা কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি জয়দেব হালদারের ভাই তথা কেচাড়কুড় পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বাসুদেব হালদার, বিধায়কের দুই ছেলে সুদীপ ও সন্দীপ এবং এক ভাইপো। বিধায়কের মনপসন্দ কাউকে সাধারণ সম্পাদক পদে না রাখায় হামলা চালানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ হাসান জমাদার।
ঘটনার পরেই কলেজ কর্তৃপক্ষ পুলিশের কাছে ওই চারজন-সহ অনেকের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি নষ্ট, মারধর-সহ একাধিক ধারায় অভিযোগ দায়ের করেন। কয়েক দিন পরেই বিধায়কের দুই ছেলে ও ভাইপো ডায়মন্ড হারবার আদালত থেকে হাজার টাকা বন্ডে আগাম জামিন নেন। এখন কলেজ কর্তৃপক্ষের প্রশ্ন, যারা কলেজে ঢুকে এমন কাণ্ড ঘটাল, তাদের বিরুদ্ধে আখেরে কী পদক্ষেপ করল পুলিশ-প্রশাসন? পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে। কলেজে কোনও সমস্যা আছে বলে কেউ খবর দেয়নি।’’
কী পদক্ষেপ করলেন বিধায়ক?
ঘটনার দিন তিনি বলেছিলেন, ‘‘বিধানসভায় আছি। আমি কিছু জানি না।’’ পর দিন কলেজে এসে জয়দেববাবু বলে যান, ‘‘এখানে এই আমার শেষ আসা।’’ কিন্তু পরিচালন সমিতির সভাপতির পদে এখনও তিনিই আছেন। ফলে কলেজে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি বা কলেজের ভাল-মন্দের দায় তিনি এড়াতে পারেন না বলে মনে করেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
দলীয় সূত্রের খবর, ঘটনার পরে তৃণমূলের জেলা ও রাজ্যে নেতৃত্ব ওই বিধায়ককে ভর্ৎসনা করেছেন। কলেজের ছাত্রনেতা এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসে বিষয়টি মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাতেও অপমানের জ্বালা কমেনি অধ্যক্ষের।
তৃণমূলের জেলা সহ সভাপতি শক্তি মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘শিক্ষামন্ত্রী সকলকে সতর্ক করেছেন, শিক্ষকদের যেন কোনও ভাবে হেনস্থা করা না হয়। তারপরেও যে ঘটনা ঘটেছে, তা দল খতিয়ে দেখছে। তারপরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
তবে জয়দেববাবু মচকাবার পাত্র নন। তিনি বলেন, ‘‘এখন কলেজ শান্তিপূর্ণ ভাবেই চলছে। কোনও সমস্যা নেই। একটা ঘটনা ঘটেছিল ছেলেদের মধ্যে। সেটা তারা নিজেরা মিটিয়েও ফেলেছে। অধ্যক্ষ সাংবাদিকদের ডেকে নাটক করছেন।’’