Advertisement
০২ মে ২০২৪

লক্ষ্মী গড়ে লক্ষ্মীলাভ, অধরা সরকারি ঋণ

গ্রামের নাম নারায়ণপুর। গত বছর দশেকে মুখে মুখে সে নাম বদলে গিয়েছে। এখন সবাই বলে — ‘‘লক্ষ্মী-গণেশের গ্রাম’’। মথুরাপুর ২ ব্লকের নন্দকুমারপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নাম বদলেই লুকিয়ে আছে জীবনের মান বদলের রহস্যও।

তৈরি হচ্ছে লক্ষ্মী গণেশ। —নিজস্ব চিত্র।

তৈরি হচ্ছে লক্ষ্মী গণেশ। —নিজস্ব চিত্র।

অমিত কর মহাপাত্র
রায়দিঘি শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৫ ০১:৪৭
Share: Save:

গ্রামের নাম নারায়ণপুর। গত বছর দশেকে মুখে মুখে সে নাম বদলে গিয়েছে। এখন সবাই বলে — ‘‘লক্ষ্মী-গণেশের গ্রাম’’।

মথুরাপুর ২ ব্লকের নন্দকুমারপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার নাম বদলেই লুকিয়ে আছে জীবনের মান বদলের রহস্যও। বহু বছর গ্রামবাসীদের জীবিকা ছিল মাছ, মীন, কাঁকড়া ধরা, আর চাষবাস। কাজের অভাবে যুবকরা পাড়ি দিতেন ভিন জেলায় ইট ভাটা, আলু স্টোর ও ছোটখাটো কারখানায় কাজ করতে। এঁদেরই কয়েকজন গিয়েছিলেন কালীঘাট, কুমোরটুলিতে মাটির পুতুল তৈরির কাজ করতে।

রঞ্জিত নাইয়া, সুশান্ত পাত্ররা বলেন, “মূর্তি তৈরির সামান্য মজুরি মিলতো। কিন্তু দেখতাম, সেই মূর্তি বেচে ওরা লক্ষ লক্ষ টাকা মুনাফা করতো। পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝি, আমরা আলাদা করে মূর্তি গড়লে তারা আমাদের থেকেও তা কিনবে।’’

যে কথা সেই কাজ। সুশান্তদের দেখাদেখি অনেকেই গ্রামে ফিরে নেমে পড়লেন ছাঁচের মূর্তি তৈরির কাজে। বছর ছাব্বিশের যুবক দশরথ দাস আট বছর কাজ শিখে চার বছর ধরে এই ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, “এক সময় গ্রামে কাজের সুযোগ না পেয়ে বাইরে গিয়েছিলাম। এখন আমার কারখানায় সারা বছর চার জনকে কাজ দিয়ে রেখেছি। এটা আমার কাছে তৃপ্তির।” ব্যবসায়ী তথা কারুশিল্পী অনিল পাত্র জানান, তাঁর কারখানায় বছরভর ২০ জন কাজ করেন।

তবে কেবল শিল্পীদের দক্ষতা নয়। নারায়ণপুরের মূলধন তার মাটি। গ্রামের খানিকটা অংশে ছিল ভেড়ি। এখন জল সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভাল মানের মাটি। বিনা পয়সায় সেই মাটি তুলে এনে, তা দিয়ে মূর্তি গড়ছেন গ্রামের মানুষ। বাইরে থেকে মাটি কিনে আনতে হয় না। ফলে লাভের অঙ্ক বেশি থাকে।

এখন নারায়ণপুরে গেলে দেখা যায়, ঘরে ঘরে বসতবাড়ির সঙ্গে লাগোয়া কারখানা। প্রবীণ শ্রীকান্ত পাত্র বলেন, “বয়স হয়েছে। বাইরে গিয়ে কাজ করার সামর্থ্য নেই। কারখানায় পাকা ছাদ আর ফ্যানের তলায় বসে দিব্যি কাজ করে এই বয়সেও আয় করছি।” সরমা, নমিতা, সুষমা দাসরা বলেন, “সংসারের কাজ সামলে যেটুকু বাড়তি সময় পাই, কাজ করে বাড়তি আয় করি।” আবার নবম শ্রেণির জয়দেব দাস, দশম শ্রেণির সত্যরঞ্জন সর্দার এমনকী ষষ্ঠ শ্রেণির নন্দন দাসরা স্কুল থেকে ফিরে কয়েক ঘন্টা করে মূর্তি তৈরির কাজ করে। তারা জানাল, এর থেকে টিউশান,বই খাতা কেনার খরচ উঠে আসে। সংসারে কিছু সাহায্য করা যায়।

পরিবারের সকলেই মূর্তি গড়ার কাজে জড়িত, তাই বাড়িগুলিতেও পা ফেলার জায়গা নেই। মাটি তৈরি করে ছাঁচে মূর্তি তৈরি করা, রোদে শুকনো করে বাড়ির গায়েই তৈরি করা ভাটায় তা পোড়ানো হয়। এর পরেই স্প্রে মেশিনে প্রাথমিক রং করে কাপড়, জরি, চুমকি, রঙিন পাথর দিয়ে বিপণনের যোগ্য করা হয়।

এই ভাবেই গত দশ বছরে গ্রামে গড়ে উঠছে একের পর পাকা বাড়ি। জমি কিনছেন অনেকে। বাড়াচ্ছেন ব্যবসার বহর। ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করা, দু’চাকার বাহন কেনা থেকে শুরু করে ব্যাঙ্কে পুঁজি জমানো, সবই ব্যবসায় লক্ষ্মীলাভের সূত্রেই। স্থানীয় ও পঞ্চায়েত সূত্রে জানা গিয়েছে, গ্রামে ছোটো-বড় মিলিয়ে প্রায় ৬০টি কারখানা রয়েছে। বছরে গড়ে তাদের ব্যবসায়িক লেনদেন হয় আট থেকে ২০ লক্ষ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে লাভ থাকে ৪০ শতাংশ। মূর্তি তৈরি হয় ছ’ইঞ্চি থেকে দেড় ফুট উচ্চতার। দাম ১০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা জোড়া। ব্যবসায়ীরা জানান, ব্যবসায় টিকে থাকার জন্য ও মূর্তিতে বৈচিত্র আনতে প্রতি কারখানায় পৃথক মডেল, রং, সাজসজ্জা করা হয়।

কিন্তু আলোর নিচেই যেমন অন্ধকার, তেমনই নারায়ণপুরের লক্ষ্মীলাভের পিছনেই রয়েছে অপ্রাপ্তি, বঞ্চনার কাহিনী। রাজ্য সরকারের শিল্পনীতিতে যেখানে কুটিরশিল্পকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে সেখানে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় মৃৎশিল্পের জন্য ব্যবসায়ীদের যেখানে সহজ সুদে ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে সরকার, সেখানে নারায়ণপুর বঞ্চিত। শিল্পীদের নিজস্ব পুঁজি না থাকায় স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে মাসিক আট শতাংশ হারে চড়া সুদে টাকা ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। পুঁজি কম থাকায় উৎপাদনের হারও বাড়ানো যাচ্ছে না। কলকাতার দুই পাইকারি ব্যবসায়ী জনার্দন পাল, সত্যরঞ্জন পাল বলেন, “ভিন রাজ্যে এখানকার মূর্তির কদর আছে। চাহিদা সত্ত্বেও এখানে উৎপাদন কম হচ্ছে। আমরা কখনও কখনও আগাম টাকা দিয়ে এদের উৎপাদনে সহায়তা করি, কিন্তু তা সামান্যই।”

স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান মুজিবর রহমান খান বলেন, “ এই মূর্তি ব্যবসাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গ্রামের হাল বদলে দিচ্ছে। আমরা বহু চেষ্টা করেও এঁদের জন্য ব্যাঙ্ক ঋণের বন্দোবস্ত করতে পারিনি। প্রশাসনের ভূমিকাও সদর্থক নয়।” বিডিও মোনালিসা তিরকে বলেন, “ ওঁরা কেন ঋণ পাননি তা খোঁজ নিয়ে দেখছি।” এদিকে ব্যবসায়ীরা নিজেদের সংগঠন গড়ে তুলে আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করচ্ছেন।

ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার রায়দিঘি শাখার ম্যানেজার পবিত্র রায় বলেন, “কারুশিল্পী হিসাবে সরকারি পরিচয়পত্র ও ঋণের জন্য প্রকল্প তৈরি করে আমাদের কাছে জমা দিলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ঋণ দিতে আমাদের কোনোও আপত্তি নেই।” কিন্তু সরকারি পরিচয়পত্রই তো নেই নারায়ণপুরের শিল্পীদের। কেন নেই? স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান মুজিবর রহমান খান বলেন, “জেলা ও ব্লক প্রশাসনের তরফে একাধিকবার এ বিষয়ে এলাকায় এসে এই শিল্পকর্মের বিষয়গুলির খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। শিল্পীরা তাঁদের শিল্প সামগ্রী প্রশাসনিক প্রতিনিধিদের হাতে তুলে দিয়ে তাঁদের সমস্যা ও দাবির কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের তরফে কোনও সহায়তা নেওয়া হয়নি।” তাঁর দাবি, পঞ্চায়েত উদ্যোগী হয়ে ট্রেড লাইসেন্স করে দিচ্ছে গ্রামের শিল্পীদের। কারুশিল্পী অনিল পাত্রও বলেন, “ বছর দুয়েক আমরা কয়েকজন পরিচয়পত্র পেতে ব্লক প্রশাসনের কাছে আবেদন করেছিলাম। কিন্তু তা দেওয়া হয়নি।”

কেন মেলেনি পরিচয়পত্র? বিডিও বলেন, “ আমরাই ব্লক থেকে ওই পরিচয়পত্র দিই। কিন্তু এতদিন তাঁরা কেন পরিচয়পত্র পাননি তা খতিয়ে দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেব।”

নন্দকুমারপুরে মহিলা পরিচালিত ‘সুন্দরবন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী সমবায় সমিতি’-র সভাপতি দেবী জানা বলেন, “মূর্তি তৈরি করেন, এমন পরিবারের কয়েকজন আমাদের সমিতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা অন্য বিষয়ে ঋণ নিলেও এই ব্যবসার জন্য ঋণের আবেদন করেননি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE