এত দিন পরিবহণ দফতরের অনুমতির প্রয়োজন ছিল না, পুরসভার লাইসেন্সেরও বালাই ছিল না। ছিল না নম্বর প্লেট। চালকদের লাইসেন্সও দরকার পড়ত না।
এই সব বাড়তি সুবিধা নিয়ে উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন পুর এলাকার রাস্তা ছেয়ে ফেলেছিল টোটো। লাইসেন্সহীন টোটো বাতিলের দাবি উঠেছে আগে। একাধিক দুর্ঘটনা ঘটলে ক্ষতিপূরণ নিয়ে নানা আইনি জটিলতা দেখা দিয়েছে রাজ্যের নানা প্রান্তে।
এ বার টোটোয় লাগাম টানতে পরিবহণ দফতরের লাইসেন্স দেওয়ার পথে হাঁটছে রাজ্য সরকার। যে জেলায় টোটোর বাড়বাড়ন্ত সব থেকে বেশি, সেই উত্তর ২৪ পরগনায় টোটোর লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।
উত্তর ২৪ পরগনার আঞ্চলিক পরিবহণ অধিকর্তা জয়ন্ত দাস বলেন, ‘‘টোটোকে লাইসেন্স দেওয়ার জন্য সরকারি নির্দেশ এসেছে। কিছু নিয়ম মেনে আমাদের কাছে লাইসেন্সের আবেদন করতে হবে। কিছু আবেদন ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে। লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হবে।’’
উত্তর ২৪ পরগনার জেলা সদর বারাসত ইতিমধ্যেই ছেয়ে গিয়েছে টোটোতে। জেলা সদর ছাড়াও গোটা জেলার বিভিন্ন প্রান্তে টোটোর সাম্রাজ্য বিস্তার হয়েছে। বনগাঁ, হাবরা, অশোকনগর, বসিরহাট, বাদুড়িয়া, মধ্যমগ্রাম, বিরাটি বা ব্যারাকপুর মহকুমার বিভিন্ন এলাকার রাস্তাঘাটে যত্রতত্র টোটোর দেখা মিলবে।
দূষণহীন টোটো চলুক চাইছেন নাগরিকেরাও। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাক, উঠছিল এই দাবিও। টোটো চালকদের বক্তব্য, বহু বেকার যুবক এক লক্ষের কিছু বেশি টাকায় টোটো কিনে জীবিকার সংস্থান করতে পেরেছেন। বারাসতের টোটো চালক নারায়ণ দাস বলেন, ‘‘উচ্চ মাধ্যমিক পাশ বা স্নাতক ছেলেরা এত দিন রিকশা বা ভ্যান-রিকশা চালাতে লজ্জা পেত। কিন্তু টোটো চালাতে তাঁদের আপত্তি নেই। সৎ পথেই তো সকলে উপার্জন করছে।’’
স্থানীয় মানুষের পাল্টা বক্তব্য, প্রচুর মানুষ টোটো কিনে রাস্তায় নেমে পড়ায় মাত্র এক বছরে মধ্যে গোটা জেলায় টোটোর সংখ্যাটা কয়েক হাজার ছাপিয়ে গিয়েছে। বস্তুত, সংখ্যাটা নিয়ে নির্দিষ্ট তথ্য নেই পরিবহণ দফতরের হাতেও। লাইসেন্স চালু হলে সেই হিসেবও সরকারি খাতায় নথিভুক্ত হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তারা।
কিন্তু ৩৪ বা ৩৫ নম্বর জাতীয় সড়কে টোটো চলতে শুরু করায় যানজট বড়েছে, সেটাও ঠিক। হালকা-পাতলা চেহারার টোটো এই সব রাস্তায় চলায় বেড়েছে দুর্ঘটনার আশঙ্কাও।
টোটোর চাহিদা কতটা বেড়েছে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরাই। তাঁরা জানান, আগে এই টোটো গাড়িটি আসত দিল্লি হয়ে চিন থেকে। এখন চাহিদা বাড়ায় কলকাতা শহরতলির বিভিন্ন জায়গায় তৈরি হচ্ছে যন্ত্রাংশ। বানানো হচ্ছে পুরোদস্তুর দেশীয় টোটো। বারাসত-ব্যারাকপুর রোডে টোটো কারখানার মালিক প্রবীর দেব বলেন, ‘‘আমরা আগে চিন থেকে যন্ত্রাংশ এনে টোটো তৈরি করতাম। দামও পড়ত বেশি। এখন নিজেরাই তৈরি করে কম দামে আরও ভাল টোটো দিতে পারছি।’’ ব্যবসায়ীদের কথায়, আগে টোটোর দাম পড়ত ১ লক্ষ ২৫ হাজার থেকে দেড় লক্ষ টাকা। এখন ৮৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজারের মধ্যে সুন্দর দেশি টোটো মিলছে। টোটো কিনলে ‘ফ্রি-সার্ভিসিং’ এর অফারও দিচ্ছেন অনেকে।
টোটোর এই বাড়বাড়ন্তে নিয়ন্ত্রণ আনতে রাজ্য সরকার লাইসেন্স ব্যবস্থা চালু করলেও তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের বক্তব্য, বাজারে এতটাই ছেয়ে গিয়েছে টোটো, যে লাইসেন্স না দিলে অবৈধ টোটো বাজেয়াপ্ত করে নিয়ন্ত্রণ করাটাও অসম্ভব হয়ে পড়বে। পরিবহণ দফতর সূত্রে অবশ্য জানানো হয়েছে, কিছু দিনের মধ্যেই পরিস্থতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসে যাবে।
তবে বিভিন্ন পুর এলাকার বাসিন্দারা অনেকেই জানালেন, ভ্যান বা রিকশায় খরচ অনেক ক্ষেত্রে বেশি। ভ্যান আবার নির্দিষ্ট রুটেই যাতায়াত করে। কিন্তু সস্তার টোটো যে কোনও রাস্তায়, গলিপথে অনায়াসে ঢুকে পড়ে, সময়ও বাঁচে। চারদিক খোলা, কিন্তু মাথায় ছাউনি থাকায় রোদ-বৃষ্টির হাত থেকেও বাঁচা যায়। দূষণহীন এই যানকে আইনি বৈধতা দিয়ে তার উপর নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরি। তাছাড়া টোটো ইদানীং শহরের জরুরি পরিষেবার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। ফলে এই ব্যবসাকে টিঁকিয়ে রাখা দরকার বলেও দাবি বাসিন্দাদের।