Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

পায়ে শিকল, তবু রেলের ডাকে ছুটে যায় সেই মেয়ে

রেলগাড়ি তাকে টানে। রেলের ভোঁ, কু-ঝিকঝিক চলা, ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে পড়া, লোকের ওঠানামা, স্টেশন— সব কিছু তাকে টানে চুম্বকের মতো। ঘরে তার মন টেঁকে না। দূরের স্টেশন তাকে হাতছানি দিয়ে নিয়ে যায়। বছর তেরোর মেয়ে। কখন কী বিপদে পড়ে! ভয়ে পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছে মা। কিন্তু তাতেও আটকানো যায়নি।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০১৫ ০১:১০
Share: Save:

রেলগাড়ি তাকে টানে।

রেলের ভোঁ, কু-ঝিকঝিক চলা, ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে পড়া, লোকের ওঠানামা, স্টেশন— সব কিছু তাকে টানে চুম্বকের মতো। ঘরে তার মন টেঁকে না। দূরের স্টেশন তাকে হাতছানি দিয়ে নিয়ে যায়।

বছর তেরোর মেয়ে। কখন কী বিপদে পড়ে! ভয়ে পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছে মা। কিন্তু তাতেও আটকানো যায়নি। ডাক্তার দেখে বলেছে, মোটেই তার মাথা খারাপ নয়। দিব্যি স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে। শুধু রেলের কথা মনে পড়লেই উচাটন। কিন্তু শুধু এই ‘দোষে’ সপ্তম শ্রেণিতে পড়া মেয়েটির ঠাঁই হয়েছে সরকারি হোমে।

গল্পের শুরুটা এ রকম:

বসিরহাটের চাঁপাপুকুর এলাকার স্বর্ণকারপাড়ায় স্ত্রী ঝুমা আর তিন সন্তানকে নিয়ে সংসার দক্ষিণ দমদম পুরসভার সাফাইকর্মী সুপদ মণ্ডলের। তাঁরই বড় মেয়ে ওই বছর তেরোর সুস্মিতা। তাদের বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে চাঁপাপুকুর স্টেশন। বারবার স্কুল পালিয়ে সেই স্টেশনে চলে যায় সুস্মিতা। দিনভর খেলা করে, কখনও ট্রেনে উঠে জানালায় থুতনি রেখে বসে থাকে। ট্রেন চলতে শুরু করলে সে-ও রওনা হয়ে যায়। এর আগে বারুইপুর, সোনারপুর, নরেন্দ্রপুর, এমনকী শিয়ালদহ স্টেশন থেকে খুঁজে আনতে হয়েছে তাকে।

এই পর্যন্ত তবু ঠিকই ছিল। বিপত্তি ঘটল শুক্রবার। আর পাঁচটা দিনের মতোই সে দিন সকালের ট্রেন ধরে কাজে চলে গিয়েছিলেন সুপদবাবু। তাঁরই পিছু-পিছু স্টেশনে চলে যায় সুস্মিতা। কখন দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে, তার খেয়ালই ছিল না। মেয়েকে খুঁজতে-খুঁজতে তার মা ঝুমা স্টেশনে চলে আসেন। সাত বছরের ছেলে সঞ্জয়ের উপরে দিয়ে আসেন ছ’মাসের সুরজিৎকে দেখার ভার। দিনকাল ভাল নয়।

স্টেশনেও নানা রকম লোকের আনাগোনা। রেল লাইনের আশপাশে ঝুপড়ি। সেখানে যদি কেউ টেনে নিয়ে যায় মেয়েকে! মায়ের তো ভয় পাওয়ারই কথা। স্টেশনে পৌঁছে ঝুমা দেখেন একটা গাছের সামনে বেঞ্চের উপর বসে ঠায় ট্রেন চলাচল দেখছে মেয়ে। মৃদু ধমক দিয়েই তিনি বলেন, ‘দুপুরে স্টেশনে একা থাকতে নেই। বাড়ি চল।’ মেয়ে সে কথা কানে তুললে তো! শেষে এক রকম জোর করে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যান তিনি। একগুঁয়ে মেয়ে জানিয়ে দেয়, এ ভাবে তাকে আটকে রাখা যাবে না মোটেই। শুনে আরও ভয় পেয়ে যান ঝুমা। মেয়ে যাতে পালাতে না পারে, তার জন্য তার পায়ে শিকল বেঁধে দেন ঝুমা। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সুপদবাবু শিকল দেখে অবাক। পরে স্ত্রীর মুখে সব শুনে ‘ওর একটু শাস্তি হওয়া দরকার’ বলে হাত-মুখ ধুয়ে বাজারে বেরিয়ে যান। সন্ধে সাতটা নাগাদ ঝুমা খেয়াল করেন, মেয়ে ঘরে নেই। শিকল-সুদ্ধু উধাও। খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। প্রায় ওই সময়েই বারাসতের দিক থেকে আসা একটি ট্রেনের গার্ড লক্ষ করেন, পায়ে শিকল বাঁধা একটি মেয়ে লাইন ধরে আসছে। সে আত্মহত্যা করতে চাইছে কি না ভাবতে-ভাবতেই লাইন ছেড়ে সরে যায় মেয়েটি। গার্ড কন্টোল রুমে খবর দেন। স্টেশনে হইচই শুরু হয়ে যায়। সুস্মিতা স্টেশনের কাছেই চলে এসেছিল। কিছু লোক গিয়ে তাকে ধরে। খবর পেয়ে পুলিশ যায়। রাত দশটা নাগাদ সুস্মিতাকে বসিরহাট থানায় নিয়ে আসা হয়। পরে চাইল্ড লাইনে পাঠানো হয়।

এ দিন থানায় এসে সুপদবাবু ও তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘‘আগে এমনটা ছিল না। গত বছর পাঁচেক ধরে মেয়ে ট্রেন দেখলে ঘরে থাকতে পারে না। ছুটে চলে যায় স্টেশনে। স্কুলের জন্য ঘর থেকে বেরিয়েও স্টেশনে চলে যায়। যখন তখন ট্রেনে উঠে পড়ে। আগে বসিরহাট থানাতেই নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়েছিল। ভয় লাগে, খারাপ লোকের পাল্লায় না পড়ে!’’

সুস্মিতার কি মাথা খারাপ?

বসিরহাট থানার আইসি গৌতম মিত্র বলেন, ‘‘আমরা চিকিৎসক দিয়ে ওর পরীক্ষা করিয়েছি। তাঁর মতে, মেয়েটি সম্পূর্ণ সুস্থ।’’ তা হলে কেন বারবার রেল দেখতে ছুটে যায় সে? সুস্মিতা বলে, ‘‘রেলগাড়ির সঙ্গেই আমার বন্ধুত্ব। বাড়ি-স্কুল কিচ্ছু ভাল লাগে না। ইচ্ছে করে, রেলগাড়িতে চেপে বহু দূরে কোথাও চলে যাই।’’

কে জানে, সুস্মিতা হয়তো সেই সুদূরের পিয়াসী, ‘পথের পাঁচালি’র অপু বা রবি ঠাকুরের ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ ঠিক যেমনটা ছিল। তাদের কি কেউ পাগল ঠাউরেছিল?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

train rail nirmal basu basirhat southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE