তহিরুন খাতুন
চুরি, ছিনতাই, ঝগড়া, মারামারি, ঘরে ঘরে অশান্তি— পরিবেশ বিষিয়ে গিয়েছিল বছর পাঁচেক আগে। যা ইদানীং বদলে দিয়েছেন মহিলারা। এলাকাকে কার্যত নেশামুক্ত করে ছেড়েছেন তাঁরা।
বছর পাঁচেক আগে মাদকের রমরমা কারবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বনগাঁর জয়পুরের মানুষজন। বাইরে থেকে কারবারিরা আসত। স্থানীয় কয়েকটি পরিবারও মাদক ব্যবসায় জড়িয়েছিল। তাদের বাড়িতে বসত নেশার আসর। ছোটখাটো চুরি-ছিনতাই লেগে থাকত। বাড়ির বাইরে সাইকেল রাখলে নিমেষে উধাও। মা-বৌয়ের শাড়ি-গয়না, চাল-আটা-বাসন বেচে নেশার খরচ চালাত আসক্তেরা।
কী ভাবে হেরোইন আসক্তদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা যায়, কী ভাবে শান্তি ফেরানো যায় এলাকায়— তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেন তহিরুন খাতুন, ঝর্না মণ্ডল, শীলা সাহা, রিনা দাস, মনোয়ারা মণ্ডলরা। আরও অনেক মহিলাকে পাশে পেয়ে যান তাঁরা। সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেন, হেরোইনের কারবার বন্ধ করবেনই।
কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। দুষ্কৃতীদের হুমকি, আক্রমণের ভয় ছিল। তবু সাহসে ভর করে শিড়দাঁড়া সোজা করে দাঁড়ান তহিরুনরা। ঠিক হয়, বাইরে থেকে যারা এলাকায় হেরোইন বিক্রি করতে আসবে, তাদের ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
সেই মতো কাজ শুরু হয়। এলাকায় যারা মাদক বিক্রি করত, তাদের বিরুদ্ধেও জোটবদ্ধ হন মহিলারা। পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে মিছিল বেরোয়। থানায় স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
ঘুরে-দাঁড়িয়ে: মাদকাসক্ত ছিলেন এঁরা। ফিরে এসেছেন সমাজের মূল স্রোতে। মঙ্গলবার বনগাঁর রাস্তায় মাদক-বিরোধী দিবসে ট্যাবলোও বের করলেন। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
বছর তিনেক আগে একটি বাড়িতে হেরোইন বিক্রি হচ্ছে খবর পেয়ে মহিলারা সেখানে যান। তাঁদের মারধর করে মাদক কারবারিরা। তহিরুন ও আসুরাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। তহিরুনের কান ছিঁড়ে দেওয়া হয়।
তাতেও দমে যায়নি মহিলা-বাহিনী। ক্রমে ক্রমে যার সুফল মিলেছে। এলাকা থেকে ধীরে ধীরে পিছু হঠেছে মাদক কারবারিরা। কমেছে আসক্তি।
বছর আটচল্লিশের তহিরুন প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়াদের দেখাশোনা করেন। স্বামী মারা গিয়েছেন বহু দিন আগে। পরিবারে কেউ কখনও নেশায় জড়াননি। তা হলে কেন এলেন মাদক নিয়ে প্রতিবাদের সামনের সারিতে? তহিরুনের কথায়, ‘‘এলাকার ছোট ছোট ছেলেরা তো আমারই ছেলে বা ভাইয়ের মতো। চোখের সামনে ওদের এ ভাবে নষ্ট হতে দেখতে কষ্ট হচ্ছিল। একের পর এক পরিবার অশান্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। এ সব আর মেনে নিতে পারছিলাম না।’’
মহিলাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় কিছু পুরুষও। সাহায্য মিলেছিল পুলিশেরও। স্থানীয় সবুজ সঙ্ঘের সদস্যেরাও ছিলেন তহিরুনদের সঙ্গে। এলাকায় যারা হেরোইন বিক্রি করত, তারাও কম প্রভাবশালী ছিল না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে হুমকির মুখেও হাল ছাড়েননি কেউ।
তহিরুন বলেন, ‘‘প্রথম দিকটায় অনেক বাধার মুখে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু একটা সময় নেশায় আসক্তদের বাড়ির লোকজন যখন এসে আমাদের আশীর্বাদ করতেন, তখন মনে হত, যত কষ্টই হোক, প্রতিবাদের পথ থেকে সরব না।’’
অনেক কারবারি এখন জেলে। মহিলাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদে এখন এলাকায় মাদক কারবার ও সেবন বন্ধ। প্রকাশ্যে তো দেখাই যায় না। তহিরুন বলেন, ‘‘পুলিশ আমাদের সব সময়ে সাহায্য করে। যখনই ফোন করি, ওঁরা চলে আসেন।’’ বনগাঁর পুরপ্রধান শঙ্কর আঢ্যের কাছ থেকেও তাঁরা সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানালেন তহিরুন। শঙ্কর বলেন, ‘‘মহিলারা এগিয়ে এসেছিলেন বলেই এলাকায় মাদকের কারবার বন্ধ করা গিয়েছে। তবে অনেক পুরুষও এগিয়ে এসেছেন।’’
স্থানীয় বাসিন্দা শহিদুল মোল্লা, রহমান মোল্লা বলেন, ‘‘এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে যাচ্ছিল। এখন সকলে সুস্থ ভাবে বাঁচতে পারছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy