Advertisement
১৪ মে ২০২৪

উত্তম থেকে দেব, হিট সন্দেশখালি

মশার ভনভনানিতে রাতভর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি শক্তি সামন্ত। ভোরের দিকে চোখ বুজে ভাবছিলেন, এমন প্রত্যন্ত গ্রামে আর যাই হোক উত্তমকুমার, শর্মিলা ঠাকুর, উৎপল দত্তদের মতো অভিনেতাকে এনে শ্যুটিং করা সম্ভব নয়। এ দিকে, সবেমাত্র আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়েছেন লেখক শক্তিপদ রাজগুরু। হন্তদন্ত হয়ে আধোঘুম থেকে ডেকে তুললেন শক্তিবাবুকে। বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন।’’

সন্দেশখালিতে উত্তমকুমার। (ডান দিকে) ‘চাঁদের পাহাড়’ শুটিংয়ের ফাঁকে হালকা মেজাজে দেব, পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

সন্দেশখালিতে উত্তমকুমার। (ডান দিকে) ‘চাঁদের পাহাড়’ শুটিংয়ের ফাঁকে হালকা মেজাজে দেব, পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।

নির্মল বসু
সন্দেশখালি শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০১:১৪
Share: Save:

মশার ভনভনানিতে রাতভর দু’চোখের পাতা এক করতে পারেননি শক্তি সামন্ত। ভোরের দিকে চোখ বুজে ভাবছিলেন, এমন প্রত্যন্ত গ্রামে আর যাই হোক উত্তমকুমার, শর্মিলা ঠাকুর, উৎপল দত্তদের মতো অভিনেতাকে এনে শ্যুটিং করা সম্ভব নয়। এ দিকে, সবেমাত্র আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়েছেন লেখক শক্তিপদ রাজগুরু। হন্তদন্ত হয়ে আধোঘুম থেকে ডেকে তুললেন শক্তিবাবুকে। বললেন, ‘‘তাড়াতাড়ি বাইরে আসুন।’’
দু’জনে এলেন বারান্দায়। রামপুরা নদীকে সামনে রেখে তখন ভোরের আকাশ সবে লাল হচ্ছে। সেই লাল রঙ গলে পড়েছে নদীর জলে। দূর থেকে নৌকোয় মাঝিদের গান ভেসে আসছে, ‘‘আমায় ডুবাইলি রে, আমায় ভাসাইলি রে...।’’ নিজের অজান্তেই শক্তিবাবু বলে উঠলেন, ‘‘এ কী দেখছি আমি, প্রকৃতির এমন শোভা!’’ মত পরিবর্তন করেন শক্তিবাবু। ঠিক করেন, ছবির শ্যুটিং করবেন এই গ্রামেই। বাকিটা মনে রেখেছে চলচ্চিত্রের ইতিহাস।
সন্দেশখালি ২ ব্লকের ভাঙাতুষখালি গ্রামে শক্তিপদ রাজগুরুর লেখা ‘নয়া বসত’ উপন্যাস অবলম্বনে ‘অমানুষ’ ছবির শ্যুটিংয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। কলকাতার বেলেঘাটার এক ব্যবসায়ী মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাংলো ছিল ভাঙাতুষখালি গ্রামে। সেই সূত্রেই তাঁর লেখক বন্ধু শক্তিপদ মাঝে মধ্যে আসতেন ওই গ্রামে। সেই সূত্রেই চিনেছিলেন সন্দেশখালিকে। পরে যাকে চিনবে গোটা দেশ।
কথা হচ্ছিল সন্দেশখালির রাধারানি হাইস্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক বছর সত্তরের আবুবকর লস্করের সঙ্গে। স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, ‘‘১৯৭৪-৭৫ সালের কথা হবে। শ্যুটিং শুরু হয়েছিল। আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে কত মান্যিগণ্যি মানুষের আনাগোনা। সকাল হলেই উত্তমকুমারকে সামনে থেকে দেখতাম। তরুণ বয়সে সে যে কী রোমাঞ্চ, ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’’ ভাঙাতুষখালি-সহ আশপাশের গ্রামগুলিতে শ্যুটিং হয়েছিল গোটা ছবির। বড় কলাগাছিয়া, রায়মঙ্গল, রামপুরা-সহ কয়েকটি নদীর ধারে ধারে মানুষ ভিড় করতেন রূপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকাদের দেখতে। গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এখনও ফেরে মহানায়কের নানা গল্প। কী ভাবে তিনি গ্রামের সকলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। কী ভাবে শ্যুটিং শেষে গরিব মানুষের মধ্যে মুঠো মুঠো টাকা বিলাতেন। শীতলিয়ার চরে উত্তমবাবু গান ধরেছিলেন, ‘‘কী আসায় বাঁধি খেলা ঘর।’’ এখনও এলাকার লোকের মুখে মুখে ফেরে সেই গান। উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনে গ্রামের মানুষ এখনও তাঁর ছবিতে মালা দেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ছবির প্রয়োজনে প্রায় ছ’মাস ধরে ভাঙাতুষখালি গ্রামে তৈরি করা হয়েছিল ৪০টির মতো কাঠের ঘর। বাজার, রাধাগোবিন্দের মন্দির, স্কুল, থানা, জমিদার বাড়ি তৈরি হয়। দু’মাসের বেশি সময় ধরে শ্যুটিং চলেছিল। রামপুরা নদীর ধারে শালবল্লা, গোলপাতার ছাউনি দেওয়া কাঠের বাংলোয় থাকতেন উত্তমকুমার। রাধাগোবিন্দের মন্দির এবং মহানায়কের থাকার ভগ্নপ্রায় সেই ঘর এখনও আছে। এলাকার অনেকে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছিলেন ‘অমানুষ’ ছবিতে। সে-ও এক অভিজ্ঞতা! ৩০ টাকা রোজ এবং দু’বেলা খাওয়ার বিনিময়ে অভিনয় করেছিলেন ভাঙাতুষখালির কাছারিপাড়ার ফজলুল হক। এখনও সে কথা বলতে গেলে শিহরিত হন। তাঁর কথায়,, ‘‘উত্তমবাবু বরাবর সকলের সঙ্গে মিশতেন, কথা বলতেন। অত বড় মানুষ কিন্তু কত নরম ব্যবহার। একবার বলেছিলাম, ছেলেকে একটু ধরবেন, ছবি তুলব। কোনও রকম কুণ্ঠাবোধ না করে ছেলেকে কোলেই তুলে নিলেন উনি।’’ ফজলুল জানান, সকালে অনেক সময়ে নদীর ধার দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতেন উত্তমবাবু। কখনও চেয়ার পেতে বই মুখে নদীর ধারে বসে থাকতে দেখা যেত তাঁকে। শ্যুটিং শেষে দুপুরে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া সারতেন। অবসর সময়ে অনিল চট্টোপাধ্যায় আবার গ্রামবাসীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে গল্প করতেন।

‘অমানুষ’ ছবির দৌলতে পরিচালক-প্রযোজকদের অনেকেই সন্দেশখালিকে ছবির কাজে বেছে নেন পরবর্তী সময়ে। ‘জাল সন্ন্যাসী’, ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবির শ্যুটিং হয়েছে এখানে। ধামাখালিতে ‘বান্ধবী’ ছবির শুটিংয়ে এসেছিলেন মুনমুন সেন, সন্তু মুখোপাধ্যায়। আর এই ক’দিন আগে সন্দেশখালির দক্ষিণ আখড়াতলায় ‘চাঁদের পাহাড়’ ছবির কাজে ঘুরে গেলেন অভিনেতা দেব।

হাল আমলে দেবকে ঘিরে যতই হইচই হোক, সন্দেশখালির মন পড়ে থাকে সত্তর-আশির দশকের গ্ল্যামার দুনিয়াতেই। আবু সঈদ লস্কর, সুজিত সিংহরা বলেন, ‘‘স্কুল ছুটির পরে ছুটতাম ধামাখালিতে। সেখানে পুলিশের পোশাকে মুনমুন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ক্যামেরার সামনে শট দিতেন। সে সব কথা কী ভুলতে পারি!’’

নাটকের চর্চাও দিব্যি দানা বেঁধেছে সন্দেশখালিতে। ন্যাজাটের বাসিন্দা একদল তরুণ-তরুণী তৈরি করেছেন ‘সুন্দরবন নাট্য উৎসব কমিটি।’ বাংলার বহু নাট্যকর্মী সন্দেশখালিতে ঘুরে গিয়েছেন। এসেছেন বাংলাদেশের নাট্যব্যক্তিত্বরাও। ন্যাজাটে নিজেদের প্রযোজনা নিয়ে এসেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রজতাভ দত্ত, মেঘনাথ ভট্টাচার্য, বিভাস চক্রবর্তী, রমাপ্রসাদ বণিক-সহ অনেকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE