Advertisement
০৩ মে ২০২৪

পোলিওর বিরুদ্ধে লড়ে কমনওয়েলথে ব্রোঞ্জ সাকিনার

সাঁতারটা কাটছিলেন মন দিয়ে। পারিবারিক অসচ্ছ্বলতা আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করেও দিব্যি মেডেল আসছিল। লোকে বাহবা দিচ্ছিল। বাংলা দলের হয়ে নানা রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ মিলছিল। কিন্তু হলে কী হবে? মেয়ের চোখে স্বপ্ন যে আকাশ ছোঁয়ার।

পদক জয়ী মেয়ে।

পদক জয়ী মেয়ে।

নির্মল বসু
বসিরহাট শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৪ ০২:২৮
Share: Save:

সাঁতারটা কাটছিলেন মন দিয়ে। পারিবারিক অসচ্ছ্বলতা আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে লড়াই করেও দিব্যি মেডেল আসছিল। লোকে বাহবা দিচ্ছিল। বাংলা দলের হয়ে নানা রাজ্যে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ মিলছিল। কিন্তু হলে কী হবে? মেয়ের চোখে স্বপ্ন যে আকাশ ছোঁয়ার। আরও বড় মাপের মঞ্চে নিজেকে তুলে ধরার। পরামর্শ দিয়েছিলেন এক ক্রীড়াবিদ। বলেছিলেন, পায়ের সমস্যা নিয়ে আর যাই হোক সাঁতার কেটে বিশ্বমানে পৌঁছনো মুশকিল। যদি আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে চাও, তবে লাইন বদলে ফেলো।

বেশ কয়েকটা দিন-রাত তা নিয়ে ভাবতে থাকেন সাকিনা খাতুন। বয়স তখন কুড়ি ছুঁয়েছে। এই বয়সে নতুন কোনও খেলার অনুশীলনে নেমে বিশ্বমানের প্রতিযোগিতা পর্যন্ত পৌঁছনো কী আদৌ যাবে? ভাবতে অনেকটা সময় গিয়েছিল। কিন্তু গরিব ঘরের তরুণীটি ভেবেছিলেন, এত কষ্ট করে যখন এত দূর লড়াই চালিয়েছেন, তা হলে আরও বড় লড়াইয়ে নামবেনই বা না কেন!

সেই মতো কুড়ি বছর বয়সে ভারোত্তোলন শুরু করে পঁচিশে পৌঁছে এ বার গ্লাসগোয় কমনওয়েলথ গেমসে লাইটওয়েট পাওয়ার লিফ্টিংয়ে ব্রোঞ্জ জিতেছেন বসিরহাটের সাকিনা।

বসিরহাট ২ ব্লকের ঘোড়ারাস কুলিনগ্রাম পঞ্চায়েতের কোড়াপাড়ায় ঢোকার পথটা কাদায় একাক্কার। কোথাও ইটের পাঁজর বের করা রাস্তা। চারপাশে গাছগাছালি। এখানেই বাড়ি সাকিনাদের। বাড়ি বলতে ছোট থেকে কাটিয়েছেন কুঁড়ে ঘরে। ২০১১ সালে গীতাঞ্জলি প্রকল্পের টাকায় ছোট্ট একটা পাকাপোক্ত মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি হয়েছে। সেখানে থাকেন সাকিনার বাবা সিরাজুল গাজি আর মা নুরজাহান বিবি। অন্যের জমিতে কাজ করে সামান্য ক’টা টাকা আয় করেন নুরজাহান। সিরাজুল আগে যদি বা দিনমজুরি করে কিছু টাকা পেতেন, কয়েক বছর আগে পিঠের হাড় ভাঙার পর থেকে সে সবও কার্যত বন্ধ। কয়েকটা ছাগল, মুরগি আছে। না চলার মতো করেই চলে সিরাজুলের সংসার। আরও দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে এরই মধ্যে। ছেলের সংসার আলাদা। সেজো মেয়ের সাকিনার সাফল্যের খবর পেয়ে বাবা-মা ভাসছেন চোখের জলে। ঠিক কত বড় কাজ করেছে মেয়ে, তা ঠাহর করতে পারেন না তাঁরা। কিন্তু খুব খুশি কর্তা-গিন্নি। কত লোকজন আসছে বাড়িতে। মেয়ের সম্পর্কে ভাল ভাল কথা বলছে। সাকিনাও টেলিফোনে জানিয়েছেন, নিজের যাবতীয় সাফল্য তিনি উত্‌সর্গ করছেন বাবা-মাকেই। তাঁরা বড্ডো কষ্ট করে বড় করেছেন মেয়েকে। নুরজাহান বলেন, “মেয়েটা আধপেটা খেয়ে লড়াই চালিয়েছে দিনের পর দিন। হয় তো ওর যোগ্য মর্যাদা পেল এ বার।” গাঁয়ের মেয়ের সাফল্যে উচ্ছ্বসিত জেসমিন খাতুন, কোহিনুর বিবি, মঞ্জিরা বিবিরাও। বৌদি সাহিদা বলেন, “অতশত বুঝি না বাপু, মেয়েটা দেশের হয়ে বড় একটা কাজ করেছে, এটুকু জেনেই আমরা খুশি।”

কিন্তু কেমন ছিল সাকিনার শুরুর দিকের লড়াইটা?

দু’বছর বয়সে পোলিও হয় মেয়েটির। সেই থেকে ডান পা-টা টেনে টেনে হাঁটেন। কলকাতার হাসপাতালে চিকিত্‌সা হয়েছে। কিন্তু চলাফেরা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি কখনওই। সেই অবস্থাতেই কাদেরিয়া হাইমাদ্রাসায় পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে মেয়েটি। ছোট থেকে খেলাধূলায় তার বেজায় শখ। দিন জেগে রাত জেগে ফুটবল টুর্নামেন্ট দেখতে চলে যেত, জানালেন মা। নিজের ছিল সাঁতারের নেশা। গ্রামের পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাপাদাপি করত মেয়েটা। হয় তো হাঁটাচলা স্বাভাবিক ছিল না বলেই জলের মধ্যে ভাসতে আরও ভালবাসত।

কিন্তু এ ভাবে পায়ের সমস্যা তো কমছিল না। মাধ্যমিকের আগে আগে সাকিনাকে নিয়ে ফের কলকাতার হাসপাতালে যান বাবা-মা। সে বার ডাক্তারবাবুরা জানিয়ে দেন, পড়াশোনা-খেলাধূলা সব পরে হবে। আগে বাঁচতে তো হবে। পর পর চার বার অস্ত্রোপচার হয় সাকিনার ডান পায়ে। তারপর অবশ্য খানিকটা স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে শুরু করে কিশোরী সাকিনা। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেয়। সাঁতারটা তখন সে কাটে আরও যত্নে।

এ ভাবেই বারাসতে একবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় নাম দেয় সাকিনা। মেডেলও পায়। নজরে পড়ে প্রশিক্ষকদের। তাঁদের পরামর্শে সাকিনা এ বার যায় যাদবপুরে সাঁতার প্রতিযোগিতায়। সেখানেও আসে সাফল্য। এর পরে আর মেয়েটিকে দমানো যায়নি। যখনই সুযোগ এসেছে, কলকাতার নানা জায়গায় সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সাকিনা। সেই সঙ্গে গ্রামের পুকুরে সাঁতারটা চালিয়ে গিয়েছেন। বাংলা দলের হয়ে দেশের নানা প্রান্তে বহু পুরস্কার এসেছে তাঁর ঝুলিতে।

এই পরিবেশেই থাকেন সাকিনার বাবা-মা।—নিজস্ব চিত্র।

এই ভাবেই এক সময়ে সাঁতারের জন্য অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সুযোগ আসে সাকিনার। সময়টা ২০০৯ সাল। আয়লার তাণ্ডবে তখন গ্রামের অবস্থা খুবই খারাপ। ঘরদোরের অবস্থাও তথৈবচ। অস্ট্রেলিয়া যাওয়া আর হয়নি সাকিনার। কিন্তু সে সময়ে যোগাযোগ হয় আর এক প্রতিবন্ধী সাঁতারু প্রশান্ত কর্মকারের সঙ্গে। তিনি সাকিনাকে পরামর্শ দেন, আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতায় পায়ের গোলমাল নিয়ে ভাল ফল করা মুশকিল। যদি দেশ-বিদেশ থেকে ডাক পেতে চাও, তা হলে অন্য কিছু ভাব। পারলে ভারোত্তোলন। তাতে পায়ের সমস্যা কোনও বাধা হবে না।

পরামর্শটা মনে ধরেছিল সাকিনার। কিন্তু তখন বয়স কুড়ি বছর। অনেক ভেবেচিন্তে ঝুঁকিটা নিয়েই ফেলেন। প্রশান্তবাবুর সূত্রেই জানতে পারেন বেঙ্গালুরুর ভারোত্তোলন প্রশিক্ষক ফরমান বাসার কথা। কিন্তু যেখানে যাতায়াত খরচ কোথা থেকে আসবে? কোথা থেকেই বা আসবে মাসে মাসে প্রশিক্ষণ, থাকা-খাওয়ার টাকা?

বসিরহাটের কিছু মানুষের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবেন তিনি, গ্লাসগো থেকে নিজেই জানান সাকিনা। পুলিশ-প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের তরফে বসিরহাট থেকেই ৭০ হাজার টাকা চাঁদা ওঠে। সেই টাকাটা দেওয়া হয় সাকিনার হাতে। ব্যবসায়ী দিলীপ মজুমদার আবার প্রশিক্ষণ চলাকালীন সাকিনাকে মাসে মাসে ১০ হাজার টাকা করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। বসিরহাটের মেয়ে পাড়ি দেয় বেঙ্গালুরু।

দিলীপবাবু বলেন, “মেয়েটার মধ্যে অদম্য জেদ দেখেছি। পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। নিজেও শারীরিক সমস্যায় ভোগে। তার পরেও এত মনের জোর কোথা থেকে আসে কে জানে। আমি ভেবেছিলাম, সামান্য কিছু টাকার জন্য মেয়েটার এই স্বপ্নের উড়ানটা কিছুতেই বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না।” গ্লাসগো থেকে টেলিফোনে সাকিনা বলেন, “দিলীপবাবু না থাকলে আমার এত দূর পৌঁছনো কখনও সম্ভব ছিল না। ওঁকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। বসিরহাটের মানুষও যে ভাবে আমার কথা মনে রেখেছেন, তাতে আমি গর্বিত।”

আজ, বুধবার বিকেলে দমদম বিমানবন্দরে নামছেন সাকিনা। সেখান থেকে শোভাযাত্রা করে তাঁকে দেশের বাড়িতে আনা হবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বিধায়ক এটিএম আবদুল্লা রনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের সঙ্গে তাঁর ইতিমধ্যেই সাকিনাকে নিয়ে কথা হয়েছে বলেও জানান। শুক্রবার মদন মিত্রের সঙ্গে সাকিনার দেখা করানোর ব্যবস্থা করবেন, বলেন রনি।

মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছেটা গোপন রাখেননি সাকিনা। বলেন, “এত দূর লড়াই চালিয়ে এসে সরকার যদি একটু পাশে থাকে, তা হলে বড় ভাল হয়।” পরের উড়ান কোন দিকে? টেলিফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসে সাহসী গলার হাসি। সাকিনা বলেন, “এ বার তো সামনে এশিয়াড। বাকি লড়াইটা চলবে সে দিকে তাকিয়েই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE