Advertisement
E-Paper

বেহাল ঘাট, অনভিজ্ঞ মাঝির হাতে জীবন সঁপেই চলছে নদী পারাপার

শ্যাওলা ধরা ঘাট, পাড়ের কোনও গাছের সঙ্গে বা খুঁটিতে বাঁধা পানসি, নৌকো। তার উপরে কাঠের পাটাতন। এটাই পারাপারের জেটি। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলে আসছে। গঙ্গার দু’ধারে ব্যারাকপুর আর হুগলি শিল্পাঞ্চল।

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৪ ০১:৫২
এই নৌকো আর টুলই হল পারাপারের ‘জেটি’। ব্যারাকপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

এই নৌকো আর টুলই হল পারাপারের ‘জেটি’। ব্যারাকপুরে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শ্যাওলা ধরা ঘাট, পাড়ের কোনও গাছের সঙ্গে বা খুঁটিতে বাঁধা পানসি, নৌকো। তার উপরে কাঠের পাটাতন। এটাই পারাপারের জেটি। বছরের পর বছর এ ভাবেই চলে আসছে।

গঙ্গার দু’ধারে ব্যারাকপুর আর হুগলি শিল্পাঞ্চল। অথচ দুই শিল্পাঞ্চলের হাতে গোনা মাত্র কয়েকটি ঘাটে লোহার জেটি ও লঞ্চে পারাপারের ব্যবস্থা রয়েছে। বেশিরভাগ ঘাটেই ফেরি পারাপার করে যন্ত্রচালিত পানসি। যার বাজারি নাম ভুটভুটি। নড়বড়ে ছাউনি, বাঁশের মাচায় ছেঁড়া প্লাস্টিকের ফাঁক দিয়ে অল্প বৃষ্টিতেই জল পড়ে। মেরেকেটে দশজনের মাথাও ঠাঁই পাবে না সেখানে। তবু তার মধ্যেই ঠাঁই পেতে চলে অন্তত ৫০ জনের গুঁতোগুঁতি। এ তো গেল ভুটভুটির কথা। ঘাটের অবস্থাও তথৈবচ। ছাউনির বালাই নেই। অধিকাংশ ঘাটে যাত্রীদের বসার জায়গা দূরঅস্ত, নেই শৌচাগার বা পানীয় জলের ব্যবস্থাও। দুই পারের বেশিরভাগ ঘাটে নেই-এর পাল্লাই ভারী। যা আছে, তা হল চাপা উৎকন্ঠা। ভদ্রেশ্বরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা স্বাতী ভট্টাচার্য। রোজ স্কুলে যেতে এই ভাবেই গঙ্গা পারাপার করেন। তাঁর কথায়, “ঘাটের করুণ দশা নিয়ে অভিযোগের তো অন্ত নেই। কিন্তু সবচেয়ে বড় বিপদ, বছর ১৪-১৫ বছরের ছেলেরাই নৌকোয় যাত্রীদের নিয়ে পারাপার করাচ্ছে। সকালে-বিকেলে ভিড়েঠাসা নৌকা মাঝগঙ্গায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে ওই সব ছেলেদের হাতে। তাদের না আছে অভিজ্ঞতা, না আছে কোনও বৈধতা।’’

বিপদ যে ঘটছে না তা নয়। গত ১১ জুলাই, শুক্রবার ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়া ঘাটে গুরু পূর্ণিমার ভরা কোটালের মধ্যেই নৌকো চালানোর চেষ্টা হয়েছিল বলে যাত্রীদের অভিযোগ। নৌকো থেকে পড়ে গঙ্গায় তলিয়ে যান তিন জন। শ্যামনগরের বাসিন্দা তেজস্বিনী নামে এক স্কুলছাত্রীকে উদ্ধার করেন স্থানীয় যুবক। কিন্তু বাকি দু’জনের হারিয়ে যান। এ দিনও ভুটভুটির চালক ছিল বছর পনেরোর একটি ছেলে। ঘটনার পর শ্যামনগর ও তেলেনিপাড়া দুই ঘাটেই ভাঙচুর চালিয়ে ঘাটকর্মীদের মারধর করা হয়। মঙ্গলবার পর্যন্ত বন্ধ ছিল ফেরি পারাপার। ঘাট এলাকার দোকানদার, বাসিন্দাদের বক্তব্য, যাত্রী পারাপারের কাজে যুক্তরা নেহাতই কিশোর। তাদের হাতে এই গুরু দায়িত্ব ছাড়া সব সময়েই ঝুঁকিপূর্ণ। তার উপর ঘাটগুলির যা দশা তা তো সকলেই জানেন। ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়া ঘাটে যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভুটভুটিতে ওঠেন পারাপারের জন্য। ঘাট থেকে নৌকায় উঠতে বেশ খানিকটা যেতে হয়। রেলিং ছাড়া কাঠের পাটাতনে হেঁটে একরকম ব্যালান্সের খেলা দেখাতে দেখাতে নৌকা বা ভুটভুটিতে উঠতে হয় যাত্রীদের। বলাবাহুল্য এ সব নিয়ে মাথা ঘামান না ঘাট কর্তৃপক্ষ। যাত্রীরা অভিযোগ জানালেও তা গুরুত্ব পায় না। যাত্রী নিরাপত্তা নিয়ে হেলদোল নেই জেলা প্রশাসনেরও। ফলে পাল্টায় না পরিস্থিতিও।

অভিযোগ, দুই শিল্পাঞ্চলে কলকাতার পর থেকে একদিকে নদিয়া অন্য দিকে হুগলির বলাগড় পর্যন্ত অধিকাংশ ফেরিঘাটেই (যেখানে ভুটভুটিতে পারাপার হয়) নৌকো চালায় কিশোর শিক্ষানবিশেরা। পূর্ণিমা, অমাবস্যায় কোটালের জলোচ্ছ্বাসের সময় তো দূর, প্রতিদিনকার জোয়ার-ভাটার খবরও তারা রাখে না। অথচ জলপথ পরিবহণের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি ফেরিঘাটে যাত্রী ভাড়ার পাশাপাশি জোয়ার-ভাটার সময়-সারণী অবশ্যই থাকার কথা। ভদ্রেশ্বরের এক ঘাটকর্মীর কথায়, ‘‘ইজারা নেওয়ার পরে সরকারি দফতরের টাকা মিটিয়ে, রাজনৈতিক দাদাদের তুষ্ট করে লাভের মুখ দেখতে গেলে কম টাকায় এই সব ছেলেদের মাঝি হিসাবে রাখা ছাড়া উপায় নেই। নিয়ম মানতে গেলে ফতুর হয়ে যাব।’’

তা হলে যাত্রী নিরাপত্তা?

হুগলি জেলাপরিষদের সভাধিপতি মেহেবুব রহমান বলেন,‘‘ঘাটগুলোর দূরবস্থার কথা জানি। এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। জেলাপরিষদের মাধ্যমে ঘাটগুলো লিজ দেওয়া হয়। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের। দুর্ঘটনা এড়াতে জেলাপ্রশাসনের পক্ষ থেকে আলোচনা করে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজনে রাজ্য প্রশাসনের সাহায্যও নেওয়া হবে।”

শিল্পাঞ্চলগুলোর ফেরিঘাটগুলির বেশিরভাগই যে বেহাল তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ছেন পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রও। তিনি বলেন, “যাত্রী স্বার্থে জলপথ পরিবহণে সুরক্ষার বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত বা পুরসভাগুলিকে বলছি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। যাঁরা পারাপার করাচ্ছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার বিষয়টিতেও জোর দেওয়া হবে।’’ পরিবহণ মন্ত্রীর আশ্বাস, ‘‘স্থলপথের মতোই জলপথ পরিবহণেও সুরক্ষার বিষয়ে এ বার জোর দিচ্ছি আমরা। প্রয়োজনে মাঝিদের চিহ্নিত করে পরিচয়পত্র দেওয়ার ব্যবস্থা হবে।’’

চন্দননগর বা জগদ্দলের ফেরিঘাটের কর্মীদের বক্তব্য, “নিয়ম মেনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে গেলে ফেরি চালাতে পারব না। ভাড়া কোথাও আড়াই টাকা কোথাও চার টাকা। অফিসটাইম ছাড়া অন্য সময়ে হাতেগোনা যাত্রী। একমাত্র দুর্গাপুজো আর জগদ্ধাত্রী পুজোর সময় এখানকার ঘাটগুলো ভাল ব্যবসা করে। তা দিয়ে কি আর সব নিরাপত্তা দেওয়া যায়? টাকার অভাবে নৌকোগুলিরও যথাযথ মেরামত হয় না।’’

জগদ্দলের বিধায়ক তথা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের তৃণমূল নেতা অর্জুন সিংহ বলেন, ‘‘বেশিরভাগ ঘাটেরই ইজারা নিয়েছেন হুগলির লোকেরা। ওখানকার জেলা পরিষদ টাকা পাচ্ছে। কিন্তু সুরক্ষা বা সংস্কারের বিষয়ে হেলদোল নেই। একদিনের একটা দুর্ঘটনায় ক’দিন ফেরি বন্ধ রাখলেই সমস্যার সুরাহা হবে না। এটা শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে হবে।’’

সহ প্রতিবেদন: তাপস ঘোষ।

ferry ghat bad condition inexperienced boatman bitan bhattacharya barrackpur southbengal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy