ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এই ডাম্পারে। নিজস্ব চিত্র।
দুর্ঘটনায় একটি মৃত্যু আর তার প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ তুলে ধরল এক বৃহত্তর সমস্যা। ডাম্পারের (যে ট্রাকে মাটি, মালপত্র বহন হয়) ধাক্কায় মৃত্যু হল এক যুবকের। সেই ঘটনায় আহত হলেন আরও দু’জন। এরপরে ডাম্পার চলাচলের প্রতিবাদে ঘণ্টাখানেক রাস্তা অবরোধ করে প্রতিবাদ করলেন জনতা। সোমবার সকালে উত্তর ২৪ পরগনার শাসনের ঘটনা। পরে অবশ্য ওই ডাম্পারের চালককে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
কিন্তু কেন এমন জনরোষ?
প্রতিবাদী জনতার বক্তব্য, কৃষিজমি, ভেড়ি থেকে অবৈধ ভাবে কেটে নেওয়া হচ্ছে মাটি। সেই মাটি ডাম্পারে করে নিয়ে বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়। কখনও পুলিশকে টাকা দিয়ে, কখনও বা নজর এড়িয়ে দ্রুতগতিতে সেই ডাম্পার চলাচল করতে গিয়েই একের এক দুর্ঘটনা ঘটছে। কখনও ডাম্পার ধাক্কা মারছে পথচারীকে, কখনও বা রাস্তার পাশের দোকানে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যাচ্ছে ডাম্পার। যেমন ঘটেছে এ দিন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সোমবার সকাল ৭টা নাগাদ বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়ার কাটিয়াহাটের বাড়ি থেকে বোন রীতা বিশ্বাস ও বছর দশেকের এক বালককে সঙ্গে নিয়ে মোটরবাইকে বেরিয়েছিলেন উত্তম বিশ্বাস (২৪) নামে এক যুবক। উত্তমবাবুদের কলকাতায় হোটেল ব্যবসা আছে। সেখানেই যাচ্ছিলেন।
শাসনের ছোটপোলের কাছে মোবাইলে একটি ফোন আসে উত্তমবাবুর। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, তখন সকাল ৮টা। ফোন আসায় মোটরবাইকটি রাস্তার পাশে দাঁড় করিয়ে মোবাইলে কথা বলছিলেন উত্তম। সে সময়ে একটি ডাম্পার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসে ধাক্কা মারে রীতাকে। রাস্তার মধ্যে ছিটকে পড়েন তিনি। পালাতে গিয়ে ডাম্পার চালক উত্তমবাবুকে ধাক্কা মেরে তাঁর শরীরের উপর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়।
এই ঘটনার পরেই ডাম্পারটির দিকে ধেয়ে যায় পথচলতি জনতা ও দোকানিরা। বেগতিক বুঝে ডাম্পারটি ফেলে চালক এবং খালাসি চম্পট দেয়। উত্তমবাবুর মৃত্যু হয়েছে বুঝতে পেরে জনতারই একাংশ জখম রীতাদেবীকে নিয়ে নিয়ে যায় বারাসত হাসপাতালে। তত ক্ষণে জনতার রোষ আছড়ে পড়েছে ডাম্পারটির উপরে। তাতে ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে আর একটি মাটি-বোঝাই ডাম্পার এসে পড়ে সেখানে। ক্ষুব্ধ জনতা তাতেও ভাঙচুর চালায়। আমিনপুর মোড়ে শুরু হয় অবরোধ।
ঘটনাস্থলে পুলিশ এসেও দ্রুত অবরোধ তুলতে পারেনি। কলকাতা থেকে খড়িবাড়ি এবং বারাসত-গোলবাড়ি থেকে শাসন যাওয়ার সমস্ত রাস্তায় সমস্ত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশ মৃতের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, ডাম্পারের চালক ও খালাসিকে গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি দেয়। ওই এলাকা দিয়ে ডাম্পার চলাচল নিয়ন্ত্রণের কথাও বলে তারা। এরপরেই অবরোধ ওঠে। উত্তমবাবুর দেহ ময়না-তদন্তের জন্য বারাসাত হাসপাতালে পাঠানো হয়।
স্থানীয় বাসিন্দা সরিফুল ইসলাম বলেন, “মাটি-বোঝাই ডাম্পারগুলি যেহেতু বেআইনি কাজ করে, সে জন্য তারা দ্রুতগতিতে যাতায়াত করে। রাস্তা যেতে রীতিমতো ভয় করে। কখন যে বিশাল আকারের ডাম্পার এসে ধাক্কা দিয়ে যাবে কে জানে?”
এমনিতেই কৃষি জমি বা ভেড়ি থেকে মাটি কাটা বেআইনি। এলাকার বাসিন্দারা জানান, ইটভাটায় মাটি সরবরাহে জন্য শাসন, খড়িবাড়ির বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে রাতের অন্ধকারে কেটে নেওয়া হচ্ছে মাটি। ডাম্পারে করে সেই মাটি নিয়ে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে ইটভাটায়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, এলাকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং স্থানীয় থানাকে টাকা দিয়ে দিনের পর দিন এই বেআইনি কাজ হয়ে চলেছে। রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ হাতে রয়েছে বলে এই মাটি কাটার চক্র কাউকে পরোয়া করে না। যার বলি হচ্ছেন উত্তমবাবুর মতো সাধারণ মানুষ। চলতি বছরেই মাটি-বোঝাই ডাম্পারের ধাক্কায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা হয়েছে বলে জানান স্থানীয় মানুষ। পুলিশের পরিসংখ্যানও সে কথাই বলছে। সম্প্রতি বারাসত-সংলগ্ন খিলকাপুরে বছর সাতেকের একটি শিশু বাড়ির পাশে বল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে ধাক্কা মারে মাটি-বোঝাই একটি ডাম্পার। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই বালকের। ডাম্পার ফেলে চম্পট দেয় চালক। ক্ষুব্ধ জনতা ডাম্পারে আগুন ধরিয়ে দেয়।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় এ দিনের ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, “ডাম্পারটি আটক করা হয়েছে। ধরা পড়েছে চালক। সব কিছু তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।” অন্য দিকে, তৃণমূলের উত্তর ২৪ পরগনার সাধারণ সম্পাদক এবং ওই এলাকার জেলাপরিষদ সদস্য মতিয়ার সাপুঁই বলেন, “যে ভেড়িতে পলি পড়ে মাছ চাষে অনুপযুক্ত হয় তার মাটি চার ফুট করে কেটে দিতে হয়। সেটাই কাটা হচ্ছে। কেউ জোর করে কেটে নিয়ে যাচ্ছে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy