Advertisement
০৬ মে ২০২৪

ডাক্তারের ভুলে মৃত্যু, ক্ষতিপূরণ সাড়ে ২৫ লক্ষ

নার্সিংহোমের পরিবেশই স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না। তাই রোগীর দেহে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসাশাস্ত্রের ন্যূনতম নিয়মকানুন মানেননি চিকিৎসক। রোগী-মৃত্যুর একটি মামলায় এই পর্যবেক্ষণ বিচারকের। এবং সেই সামগ্রিক গাফিলতির দায়ে সাড়ে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য অলোককুমার খান নামে এক চিকিৎসককে নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালত।

মেহবুব কাদের চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৬
Share: Save:

নার্সিংহোমের পরিবেশই স্বাস্থ্যসম্মত ছিল না। তাই রোগীর দেহে দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।

চিকিৎসাশাস্ত্রের ন্যূনতম নিয়মকানুন মানেননি চিকিৎসক।

রোগী-মৃত্যুর একটি মামলায় এই পর্যবেক্ষণ বিচারকের। এবং সেই সামগ্রিক গাফিলতির দায়ে সাড়ে ২৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য অলোককুমার খান নামে এক চিকিৎসককে নির্দেশ দিয়েছে রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। এবং মৃত রোগীর স্ত্রীর হাতে এই টাকা তুলে দিতে হবে দু’মাসের মধ্যে।

কী ঘটেছিল?

চোয়ালে ব্যথা নিয়ে আনন্দকুমার সিকদার নামে উত্তর ২৪ পরগনার নোয়াপাড়ার এক বাসিন্দা ২০০৯ সালের ৩০ জুন নারকেলডাঙা মেন রোডে নিউরোসার্জন অলোককুমার খানের কাছে যান। অভিযোগ, অলোকবাবু তাঁর নিজের নার্সিংহোমে নানান পরীক্ষানিরীক্ষা করে জানান, আনন্দবাবুর মাথায় টিউমার রয়েছে। চোয়ালে ব্যথা হচ্ছে সেই কারণেই। অবিলম্বে অস্ত্রোপচার করে ওই টিউমার সরিয়ে ফেলা দরকার।

আনন্দবাবুর স্ত্রী শ্যামলীদেবীর অভিযোগ, ২০০৯ সালের ৪ জুলাই তাঁর স্বামীকে নারকেলডাঙা মেন রোডে ওই চিকিৎসকের নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। ৫ জুলাই অস্ত্রোপচার হয় তাঁর মাথায়। অস্ত্রোপচারের পরে পরিজনদের জানানো হয়, রোগীর মাথায় রক্ত জমাট বেঁধে গিয়েছে। স্ক্যানও করানো হয়েছিল। কিন্তু সেই রিপোর্ট রোগীর স্বজনদের দেখানো হয়নি। এমনকী তাঁদের না-জানিয়েই ১০ জুলাই আবার অস্ত্রোপচার করা হয় রোগীর মাথায়। ‘‘দ্বিতীয় বার অপারেশনের পরেই আমার স্বামীর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এতটাই যে, ১৬ জুলাই তাঁকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়। দিন তেরো পরে, ২৯ জুলাই তাঁকে পাঠানো হয় বাইপাসের ধারে এক বেসরকারি হাসপাতালে। ২ অগস্ট ওঁর মৃত্যু হয় সেখানেই,’’ বললেন শ্যামলীদেবী।

স্বামীর মৃত্যুর জন্য চিকিৎসক অলোককুমার খানের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনে রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিল এবং রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থ হন ওই মহিলা। দুই প্রতিষ্ঠানের কাছেই শ্যামলীদেবীর আর্জি ছিল, ওই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হোক। কিন্তু কাউন্সিল বা কমিশন, কারও কাছ থেকেই তিনি সাড়া পাননি বলে অভিযোগ ওই মহিলার। এই অবস্থায় শ্যামলীদেবীর পাশে দাঁড়ায় ‘পিপল ফর বেটার ট্রিটমেন্ট’ বা পিবিটি। ওই সংগঠনের সভাপতি চিকিৎসক কুণাল সাহা রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে তাঁর হয়ে মামলা লড়েন। শ্যামলীদেবী বললেন, ‘‘২০১৩ সালে রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করেছিলাম। এত দিনে বিচার পেলাম।’’

বিদেশ থেকে কলকাতায় এসে অসুস্থ হয়ে মারা যান কুণালবাবুর স্ত্রী অনুরাধা সাহা। জন তিনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনে দীর্ঘদিন ধরে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত মামলা চালিয়ে ক্ষতিপূরণ আদায় করেন ওই ভুক্তভোগী চিকিৎসক। স্বামী-হারা শ্যামলীদেবীর মামলায় তাঁর হয়ে সওয়াল করেন তিনিই। কুণালবাবুর বক্তব্য, আনন্দবাবুর টিউমার মোটেই ‘ম্যালিগন্যান্ট’ (তত জটিল বা মারাত্মক) ছিল না। কিন্তু অস্ত্রোপচারে গাফিলতির ফলেই রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। আদালতে কুণালবাবুর অভিযোগ, আনন্দবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত নথিপত্র দেওয়ার জন্য নার্সিংহোম-কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরোধ করেন শামলীদেবী। কিন্তু নার্সিংহোম-কর্তৃপক্ষ তা দেননি।

মামলায় সওয়াল করতে অভিযুক্ত চিকিৎসকের তরফে কোনও আইনজীবী হাজির হননি।

রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের বিচারক কালিদাস মুখোপাধ্যায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর রায়ে বলেন, ‘‘অভিযুক্ত চিকিৎসক ২০০৯ সালের ২৮ জুলাই প্রেসক্রিপশনে জানান, তাঁর নার্সিংহোমে জীবনদায়ী ওষুধ মজুত নেই। অর্থাৎ ওই চিকিৎসকই স্বীকার করে নিচ্ছেন, তাঁর নিজের নার্সিংহোমে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচার করার উপযুক্ত পরিকাঠামো ছিল না।’’ এর পরেই বিচারকের মন্তব্য, রোগী প্রায় এক মাস ভর্তি ছিলেন ওই নার্সিংহোমে। কিন্তু উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে সেখানেই তাঁর দেহে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে অভিযুক্ত ডাক্তার চিকিৎসাশাস্ত্রের ন্যূনতম নিয়মবিধি মানেননি বলেও মন্তব্য করেন বিচারক। তার পরেই বলেন, ক্ষতিপূরণ বাবদ দু’মাসের মধ্যে অভিযোগকারিণীকে সাড়ে ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার জন্য ওই চিকিৎসককে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগ ও রায়ের ব্যাপারে চিকিৎসক অলোকবাবুর বক্তব্য জানা যায়নি। বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা সত্ত্বেও সাড়া দেননি তিনি। জবাব দেননি এসএমএসেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE