Advertisement
১৯ মে ২০২৪

সাড়ে তিন হাজার বছর আগের সংসারের খোঁজ

কোনও এক ‘গাঁ’য়ের বধূর কথা তবে শোনাই শুনুন। মোটেই রূপকথা ছিল না তাঁর জীবনও। সমুদ্রের উপকূলে বাস। এখন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে সেখানে তাঁর একটি ঘর ছিল। কাঁখে করে জল আনা ছিল।

এরেন্দা থেকে পাওয়া গিয়েছে এই মৃত্পাত্রগুলি।—নিজস্ব চিত্র

এরেন্দা থেকে পাওয়া গিয়েছে এই মৃত্পাত্রগুলি।—নিজস্ব চিত্র

অলখ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:৩৩
Share: Save:

কোনও এক ‘গাঁ’য়ের বধূর কথা তবে শোনাই শুনুন। মোটেই রূপকথা ছিল না তাঁর জীবনও। সমুদ্রের উপকূলে বাস। এখন থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে সেখানে তাঁর একটি ঘর ছিল। কাঁখে করে জল আনা ছিল। মাটির উনুনে কাঠকুটো জ্বেলে রান্না করা ছিল। লাল-কালো মাটির সেই পাত্রে তিনি রান্না করতেন মোটা চালের ভাত। মাটির থালাতেই কিংবা কলাপাতায় বেড়ে দিতেন গরম ভাতের সঙ্গে মাছও।

এই সবই অনুমান করা সম্ভব হচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব দফতরের সাম্প্রতিক উৎখননের পরে। তাদের অনুসন্ধানে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, তামিলনাড়ুর উপকূলের মতো পশ্চিমবঙ্গেরও পূর্ব মেদিনীপুরে সমুদ্রের কাছাকাছি এগরার এরেন্দা ও হাটনগরের কাছ থেকে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের ঘর-গেরস্থালির খোঁজ মিলেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্বের অধ্যাপক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় এই উৎখননের নির্দেশক ছিলেন। তিনি জানান, এই জনবসতির সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে এখান থেকে পাওয়া কৃষ্ণ-লোহিত কৌলাল বা লাল-কালো মাটির পাত্রগুলি থেকে। যা বাংলার ক্ষেত্রে পাণ্ডু রাজার ঢিবি বা মঙ্গলকোট থেকে আগে মিলেছে। সেগুলির সময়কাল মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব বারোশো থেকে ন’শো শতক পর্যন্ত। বীরভূমের মহিষঢাল থেকে পাওয়া পাত্র আরও দু’শো বছর আগের। কৌশিকবাবুর মতে, ‘‘এই প্রত্নস্থলও তার সমসাময়িক বলে অনুমান।’’ এখান থেকে পাওয়া নিদর্শনগুলির ঠিক সময় পাওয়ার জন্য কার্বন ১৪ পরীক্ষাও করা হচ্ছে।

সমুদ্রের জন্যই একদল মানুষ এখানে সংসার পেতেছিলেন। সমুদ্র এখান থেকে এখনই মাত্র ৩০ কিলোমিটার মতো দূরে। সম্ভবত তা তখন ছিল আরও কাছে। ছিল সামুদ্রিক খাঁড়ি। সমুদ্রের ধার বলে আবহাওয়া ছিল উষ্ণ। খাঁড়ির জলে সহজে মিলত মাছ। কাছাকাছি নদী থেকেও পাওয়া যেত মাছ।

এখান থেকে মিলেছে হাড়ের তৈরি বঁড়শিও। সাম্প্রতিক অতীতে নদী এখান থেকে দূরে সরে গেলেও এই এলাকার কাছাকাছি দিয়েই এক সময় সুবর্ণরেখা বইত বলে পুরাতত্ত্ববিদদের ধারণা। পাওয়া গিয়েছে শস্যদানাও। যা থেকে বোঝা যায়, নদী পাড়ের পলিমাটিতে উর্বর জমিতে এই বসতির মানুষ

চাষও করতেন। তার মধ্যে ধান অবশ্যই ছিল। চারপাশ ঘেরা ছিল ঘন জঙ্গলে। সেখান থেকে পুরুষেরা শিকার করে আনতেন হরিণ, বুনো শুয়োর। হাড় দিয়ে তৈরি অস্ত্রও মিলেছে এখানে।

উত্তর-পশ্চিম ভারতে সে সময় হরপ্পা বা সরস্বতী সভ্যতার বিকাশ ঘটে গিয়েছে। এই এলাকাতেও ওই সময়ের জনবসতির প্রমাণ মিলেছে অজয়-দামোদর অববাহিকা এলাকা থেকে। পাওয়া গিয়েছে অন্য জায়গায়ও। কিন্তু এগরার সমুদ্র ঘেঁসা এলাকা থেকে এই প্রথম এমন নিদর্শন মিলল। এরেন্দা থেকে যে মাটির বাসন পাওয়া গিয়েছে, তা আগুনে পুড়িয়েই তৈরি হত। তার আগে জল মিশিয়ে নরম করা মাটিতে মিহি বালি মিশিয়ে তাকে পাকের উপযুক্ত করা হত। তবে তারপরে হাত দিয়েই বিভিন্ন অংশ তৈরি করে জু়ড়ে দেওয়া হত আগুনের তাতে। পাত্রগুলোর ভিতরের অংশগুলো ছিল কালো। বাইরেটা লাল। দু’টি রংই উজ্জ্বল। যা থেকে বোঝা যায়, রঙের প্রলেপও পড়েছে। তারপর তাকে ধোয়া হত অনেক যত্নে।

সেই যত্নেই গড়ে উঠত সেই প্রাচীন সংসার। সেই বাসনে মেয়েটি যখন রান্না করত, তখন তার সন্তানের হাতের বালার শব্দও কানে পেত। এরেন্দা থেকে পাওয়া গিয়েছে তামার সরু ছোট বালা।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে পেয়েছে সেই ‘কোনও এক গাঁয়ের বধূ’দের আশা স্বপনের সমাধি।

সহ প্রতিবেদন: অমিত কর মহাপাত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

relics erenda egra 3000 years old
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE