Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪

রাজ্য প্রকাশ করবে গোপন নেতাজি-ফাইল, চাপে কেন্দ্র

রাজ্য প্রশাসনের হেফাজতে থাকা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত যাবতীয় গোপন ফাইল প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী জানান, মানিকতলা মোড়ের কাছে কলকাতা পুলিশের ডিসি (উত্তর) অফিসের মহাফেজখানায় ফাইলগুলি রাখা থাকবে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:৩৩
Share: Save:

রাজ্য প্রশাসনের হেফাজতে থাকা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত যাবতীয় গোপন ফাইল প্রকাশ্যে আনার সিদ্ধান্ত নিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। শুক্রবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী জানান, মানিকতলা মোড়ের কাছে কলকাতা পুলিশের ডিসি (উত্তর) অফিসের মহাফেজখানায় ফাইলগুলি রাখা থাকবে। আগামী শুক্রবার থেকে সাধারণ মানুষ সেগুলি দেখতে পাবেন।

গোপন ফাইলের সংখ্যা ৬৫। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এর মধ্যে কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের (এসবি)-র

কাছে আছে ৫৫টি ফাইল। রাজ্য পুলিশের কাছে ৯টি। ‘‘আর একটা আছে এ দিক-ও দিক কোথাও’’— বলেছেন তিনি।

মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, ‘‘ভাবতে অবাক লাগে, আমরা তাঁর জন্মদিন জানি, মৃত্যুদিন জানি না। আদৌ মারা গিয়েছেন কি না, সেটাও জানি না।’’ ফাইল প্রকাশের কারণ হিসেবে মমতার এই যুক্তি আখেরে ফরওয়ার্ড ব্লক এবং মুখোপাধ্যায় কমিশনের ‘বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু হয়নি’ গোছের তত্ত্বকেই মান্যতা দিল বলে মনে করছেন অনেকে। তাঁদের মতে, নিজের যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে তৃণমূলেরই ইতিহাসবিদ-সাংসদ সুগত বসু, প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু, এমনকী নেতাজি রিসার্চ ব্যুরোর তত্ত্বও এ দিন মাথায় রাখেননি মুখ্যমন্ত্রী।

ফাইল প্রকাশ নিয়ে মতামত জানতে চাওয়া হলে হার্ভার্ড থেকে ফোনে সুগতবাবু বলেন, ‘‘সঠিক সিদ্ধান্ত। তথ্য জানার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হল। আমি সংসদেও বলেছি, ৫০ বছরের পুরনো সব তথ্য ও নথি প্রকাশ্যে আনা উচিত। অনেক দেশ আজকাল তারও আগে নথিপত্র জনসাধারণের জন্য বের করে দিচ্ছে।’’

ঘটনাচক্রে, সুগতবাবুরই ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট’ বইয়ে বিমান দুর্ঘটনার তারিখটা পরিষ্কার দেওয়া আছে— ১৮ অগস্ট, ১৯৪৫। নেতাজির মৃত্যুরহস্যের অনুসন্ধানে গঠিত শাহনওয়াজ কমিশন, খোসলা কমিশন এবং মুখোপাধ্যায় কমিশন নিয়ে আলোচনাও ছিল বইয়ের শেষ অধ্যায়ে। একমাত্র মুখোপাধ্যায় কমিশন বলেছিল, নেতাজির ডেথ সার্টিফিকেট নেই। তাইওয়ান সরকারের বক্তব্য ছিল, ওই দিনে বিমান দুর্ঘটনার কোনও রেকর্ড তাদের হাতে নেই। এবং সুগতবাবু তাঁর বইয়ে পরিষ্কার দেখিয়েছিলেন, ঘটনার দু’দিন আগে জাপান আত্মসমর্পণ করে, জাপ-অধীনে তাইওয়ানও ছিল টালমাটাল। বিমান দুর্ঘটনার নথি না-ই থাকতে পারে। বইয়ে এ-ও আছে, পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণ নয়, পূর্বপরিকল্পিত (প্রিকনসিভ্ড) ধারণাই গুরুত্ব পেয়েছিল মুখোপাধ্যায় কমিশনে। সুগতবাবুর কথায়, ‘‘ইতিহাসবিদ হিসেবে আমার যা লেখার ছিল, ওই অধ্যায়ে লিখে দিয়েছি।’’ তা হলে মমতা কেন নবান্নে দাঁড়িয়ে বললেন, নেতাজি আদৌ মারা গিয়েছেন কি না ‘আমরা জানি না’? সুগতবাবুর বক্তব্য, ‘‘ওটা ওঁর বলার ধরন।’’

মুখ্যমন্ত্রী এ দিন বলেছেন, ‘‘ফাইলগুলি খতিয়ে দেখা হয়েছে। সেগুলির সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার কোনও যোগ পাওয়া যায়নি।’’ ইতিহাসবিদ মহলের একটি অংশের বক্তব্য, যোগ থাকার কথাও নয়। বড়জোর কলকাতায় লালবাজার নেতাজির গতিবিধির উপরে কী ভাবে নজর রাখছিল— সেটুকু বোঝা যেতে পারে ওই ফাইল থেকে। শরৎচন্দ্র বসু ও সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে ‘ব্রাদার্স এগেনস্ট দ্য রাজ’-এর লেখক লেনার্ড গর্ডনও বলছেন, ‘‘আগে দেখা যাক। পুরনো ব্রিটিশ ফাইলও হতে পারে।’’ তবে প্রকাশিত ফাইলগুলি যে তাইহোকুর বিমান দুর্ঘটনা-রহস্যে আলো ফেলবে,

এমনটা মনে করেন না তিনিও। বরং সেগুলিকে দিনের আলোয় নিয়ে আসার গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তই তাঁর কাছে মূল্যবান।

কেউ কেউ অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে গণতান্ত্রিক ভাবনার চেয়ে আসন্ন ভোটের বাজারে বিজেপিকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা দেখছেন। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ দিন বলেছেন, ‘‘কাগজগুলি প্রকাশ্যে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনেক বার অনুরোধ করেছি। কিন্তু কিছু হয়নি। তাই আমরাই ওই বীর স্বাধীনতা সংগ্রামীর সমস্ত নথি প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছি।’’ প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেতাজিকে নিয়ে ৩০টি গোপন ফাইল আছে। ভোটের আগে নরেন্দ্র মোদী সেগুলি প্রকাশ করবেন বলেছিলেন, কিন্তু এখনও করে উঠতে পারেননি। বস্তুত, মমতার ঘনিষ্ঠ মহল মনে করছে, রাজ্যের কাছে থাকা সমস্ত ফাইল প্রকাশ করে অত্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। বল এখন কেন্দ্রের কোর্টে।

সুগতবাবু বলছিলেন, ‘‘ফাইলগুলি যত অন্ধকারে থাকবে, লোকে তত বেশি নেতাজির মৃত্যুরহস্য নিয়ে কথা বলবে। তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে নয়।’’ কিন্তু অনেকের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী নিজে কেন এ দিন সেই মৃত্যুরহস্যেই আটকে রইলেন? এ দিন নবান্নে তিনি বলেন, ‘‘নেতাজি বাংলায় দাঁড়িয়ে রাজনীতি করেছেন। এখান থেকেই বাইরে চলে গেলেন। আর ফিরে এলেন না। সেই রহস্য আজও জানতে পারিনি।’’ বিরোধীদের একাংশের মতে, এ দিন এক দিকে বাঙালি আবেগে ভর করে কেন্দ্র তথা বিজেপিকে চাপে ফেলতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে কাছে টানতে চাইলেন ফরওয়ার্ড ব্লককে। এর আগে ফব দফতরে গিয়ে প্রবীণ নেতা অশোক ঘোষের সঙ্গে দেখা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন নেতাজি-আবেগ অস্ত্র করে ফব-কে ফের তিনি বার্তা দিলেন বলেও মনে করা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Netaji Subhas Chandra Bose File Trinamool BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE