Advertisement
০২ মে ২০২৪

রিজ-কাণ্ডে অভিযুক্ত জ্ঞানবন্তের পদোন্নতি, গেলেন মুর্শিদাবাদে

রিজওয়ানুর-কাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার জ্ঞানবন্ত সিংহের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। জ্ঞানবন্তকে মুর্শিদাবাদ রেঞ্জের ডিআইজি করা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরেই এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। সাত বছর আগে কড়েয়ার যুবক রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। তখন প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং নাগরিক সমাজ পাশাপাশি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছিল। ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসানের পিছনে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পাশাপাশি এই আন্দোলনেরও সমান গুরুত্ব ছিল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৯
Share: Save:

রিজওয়ানুর-কাণ্ডে অভিযুক্ত পুলিশ অফিসার জ্ঞানবন্ত সিংহের পদোন্নতির সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। জ্ঞানবন্তকে মুর্শিদাবাদ রেঞ্জের ডিআইজি করা হয়েছে। রাজ্য প্রশাসন সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পরেই এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। সাত বছর আগে কড়েয়ার যুবক রিজওয়ানুর রহমানের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘিরে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। তখন প্রধান বিরোধী দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং নাগরিক সমাজ পাশাপাশি রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছিল। ৩৪ বছরের বাম জমানার অবসানের পিছনে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের পাশাপাশি এই আন্দোলনেরও সমান গুরুত্ব ছিল।

আন্দোলন চলাকালীনই রিজওয়ানুরের দাদা রুকবানুর তৃণমূলে যোগ দেন। রাজ্যের রাজনীতিকদের একটি বড় অংশের অভিমত, রিজওয়ানুর কাণ্ডে মাঠে নামার ফলে সংখ্যালঘুদের সহানুভূতি পেয়েছেন মমতা। রুকবানুরকে প্রার্থী করার পিছনে সেটাও বড় কারণ। রিজের দাদাকে প্রথমে কলকাতা পুরসভায় প্রার্থী করেন মমতা। কিন্তু সেখানে হেরে যান রুকবানুর। এর এক বছর পরে ২০১১ সালে তাঁকে নদিয়ার চাপড়া বিধানসভা আসনে প্রার্থী করেন তৃণমূল নেত্রী। সেখান থেকে জিতে এখন তিনি বিধায়ক। অনেকেই মনে করেন, বাম-বিরোধী হাওয়ার সঙ্গে রিজ-কাণ্ডে তৈরি হওয়া সহানুভূতি একযোগে কাজ করেছিল সেখানে। এ দিন জ্ঞানবন্তের পদোন্নতির খবর জানার পরে বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেছেন, “এর পরে সংখ্যালঘুদের কী বলবেন মমতা?”

রিজের দাদা পরিচয়ে যাঁর উত্থান, সেই রুকবানুর এ দিন জ্ঞানবন্তের পদোন্নতির খবর পাওয়ার পরে বলেন, “রিজের দাদা হিসেবে বলছি, রিজ-প্রিয়ঙ্কার বিয়ে ভাঙতে কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডিসি (সদর) জ্ঞানবন্ত সিংহ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।” শাসক দলের বিধায়ক হিসেবে কোনও মন্তব্য করতে না চাইলেও রিজের দাদা হিসেবেই তিনি মমতার কাছে জানতে চান, “কেন এমন হল!” তবে এর জন্য তিনি দল ছাড়া বা বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন। তাঁর বক্তব্য, “আসলে গলদ তো সিবিআই করেছে। তাদের কাছে আবারও আবেদন করছি, জ্ঞানবন্তের ভূমিকা ফের খতিয়ে দেখা হোক।”

রিজের মা কিশওয়ার জহান সাত বছর আগে ছোট ছেলের মৃত্যুতে আওয়াজ তুলে বলেছিলেন, “মুঝে ইনসাফ চাহিয়ে।” এর পরে ২০০৯ সালে রেলমন্ত্রী হওয়ার পরে রেলের এক কমিটিতে তাঁকে সদস্য করেছিলেন মমতা। সেই কিশওয়ারও এ দিন কিন্তু যাবতীয় দায় সিবিআইয়ের ঘাড়েই চাপিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “মমতার হাতে কিছু নেই। উনি কী-ই বা করতে পারেন! সিবিআই-ই তো জ্ঞানবন্তকে ধরল না।”

সিবিআই ছাড়াও অবশ্য রিজ-কাণ্ডে জ্ঞানবন্তের ভূমিকা নিয়ে তদন্ত চালিয়েছিল রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের ভিজিল্যান্স সেল। তার পরে কী ভাবে হঠাৎ এই পদোন্নতি, সেই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় কিছু বলতে চাননি। তবে নবান্নের ব্যাখ্যা, ভিজিল্যান্স সেল রিজ-কাণ্ডের সঙ্গে জ্ঞানবন্তের জড়িত থাকার কোনও প্রমাণ পায়নি। তাই এই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য বিবেচনা করে ও প্রাসঙ্গিক বিষয় খতিয়ে দেখে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার। সোমবারই জ্ঞানবন্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত বন্ধ করে দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি জারি করে স্বরাষ্ট্র দফতরের ভিজিল্যান্স সেল। আর তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে, মঙ্গলবার বিকেলে ওই পুলিশকর্তা মুর্শিদাবাদ রেঞ্জের ডিআইজি-র দায়িত্ব নিয়ে নেন। সেই মুর্শিদাবাদ, যেখানে একসময় এসপি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। সে সময় তাঁর সঙ্গে দাপুটে কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর সংঘাত চরমে পৌঁছয়। বস্তুত, অধীর এক সময় অভিযোগ করেছিলেন, তৎকালীন বাম সরকার তাঁকে প্যাঁচে ফেলতেই জ্ঞানবন্তকে মুর্শিদাবাদে পাঠিয়েছে। এ বারে জ্ঞানবন্তের পদোন্নতি এবং তার পরে আরও বেশি ক্ষমতা নিয়ে মুর্শিদাবাদ রেঞ্জে বদলির মধ্যে ‘মতলব’ দেখতে পাচ্ছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি। অধীরবাবুর প্রশ্ন, না হলে একসময় যাঁর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন মমতা, এখন তাঁকে পুরস্কৃত করলেন কেন? তাঁর অভিযোগ, তাঁকে চাপে রাখতেই জ্ঞানবন্তকে মুর্শিদাবাদে পাঠানো হল।

রিজওয়ানুরের মৃত্যুর তদন্তে সিবিআই যে চার্জশিট দেয়, তাতে জ্ঞানবন্তের নাম ছিল না ঠিকই, কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক স্তরে তদন্ত চালানোর পরামর্শ দেয় রাজ্যকে। সে বছরেরই ১২ ডিসেম্বর জ্ঞানবন্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেয় তৎকালীন বাম সরকার। ওই পুলিশকর্তা তখন কলকাতা পুলিশের ডিসি (সদর)। তৎকালীন এডিজি (আইবি) নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এক বছর তিন মাস পরে সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করেন নপরাজিতবাবু। তাতে তৎকালীন বাম সরকার সন্তুষ্ট হতে পারেনি। নবান্ন সূত্র বলছে, সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখে ‘শৃঙ্খলারক্ষা কর্তৃপক্ষ’ (ডিসিপ্লিনারি অথরিটি) জানায়, রিপোর্টটি দুর্বল। যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করলে সত্য উদ্ঘাটন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, তাঁদের সঙ্গে কথাই বলেনি তদন্তকারী কমিটি। ফলে, জ্ঞানবন্তের বিরুদ্ধে নতুন করে বিভাগীয় তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন রাজ্য সরকার।

এই অবস্থায় ক্ষমতায় এসে যায় তৃণমূল সরকার। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “এডিজি (আইবি) হিসেবে নপরাজিতবাবু যে রিপোর্ট জমা দেন, তা বর্তমান সরকারেরও পছন্দ হয় না। তাই প্রশাসনের শীর্ষমহলের নির্দেশে নপরাজিতবাবুর কাছে ওই রিপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে ফের তাঁকেই নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।” দ্বিতীয় বার এই দায়িত্ব যখন নপরাজিতবাবুর কাছে এল, তিনি তখন ডিজি হয়ে গিয়েছেন। তিনি আর কোনও তদন্ত করেননি। গত বছর সেপ্টেম্বরে তিনি চাকরি থেকেও অবসর নেন। এ দিনও নপরাজিতবাবুর বক্তব্য জানতে তাঁর মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি কোনও উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।

এর মধ্যে একাধিক বার রাজ্য সরকারের বিভাগীয় তদন্তের বিরুদ্ধে এবং নিজের পদোন্নতির জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করেন জ্ঞানবন্ত। কখনও ক্যাট, কখনও হাইকোর্ট। এই নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত জল গড়ায়। কিন্তু সব জায়গা থেকেই তাঁর আর্জি খারিজ করে বিভাগীয় তদন্তের পক্ষে সবুজ সঙ্কেত দেওয়া হয়। সেই তদন্তই সোমবার শেষ করে দিল রাজ্য। কলকাতার যে পুলিশ কমিশনারের অধীনে চাকরি করার সময় রিজ কাণ্ডে অভিযুক্ত হয়েছিলেন জ্ঞানবন্ত, সেই প্রসূন মুখোপাধ্যায় এ দিন এই খবর শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সেই সময় জ্ঞানবন্ত ও অজয় কুমারের সঙ্গে প্রসূনকেও তাঁর নিজের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিল রাজ্য সরকার। এ দিন জ্ঞানবন্তের পদোন্নতির খবরে খুশি প্রসূনবাবু বলেন, “এত দিনে জ্ঞানবন্ত বিচার পেল!”

পদোন্নতি দিয়ে জ্ঞানবন্তকে ফিরিয়ে আনা হলেও নবান্ন সূত্রে খবর, ভবিষ্যতে যাতে তিনি এক্তিয়ার মেনেই কাজ করেন, সে জন্য সরকার তাঁকে সতর্ক করে দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE