মালদহে আদালতে কৃষ্ণেন্দু। — নিজস্ব চিত্র
সাত সকালে ওঠার পরেই ভিড় উপচে পড়ত বাড়ির দোরগোড়ায়। বেলা বাড়ার আগেই পৌঁছে যেত লাল বাতি লাগানো গাড়ি। সব মিলিয়ে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত দম ফেলার ফুরসৎ ছিল না কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী। কিন্তু, ১৯ মে ভোটের ফল প্রকাশের পরে সব ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। অনেকটাই বদলে গিয়েছে প্রাক্তন মন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা কৃষ্ণেন্দুবাবুর দিনযাপন। হারের ধাক্কা সামলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফের মানুষের ভিড়ে মিশে থাকতে আবার গায়ে কালো কোট তুলে নিয়েছেন ইংরেজবাজারের কৃষ্ণেন্দুবাবু।
পেশায় আইনজীবী। সেই সূত্রেই ফের আদালতে ফিরেছেন কৃষ্ণেন্দুবাবু। মালদহ জেলা আদালতে দাঁড়িয়ে তৃণমূল কর্মীদের হয়ে নিখরচায় মামলা লড়ছেন। তাতে দলের লোকজনও অনেক স্বস্তিতে। অন্তত, মালদহ কোর্টে গিয়ে দেদার টাকা খরচ করে উকিল ধরার ঝক্কি কিছুটা হলেও কমে গিয়েছে তৃণমূলের লোকজনের। অনেকে তো পুরানো মামলাও এখন আগের উকিলের হাত থেকে নিয়ে কৃষ্ণেন্দুবাবুর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করছেন। তাতে অবশ্য কৃষ্ণেন্দু রাজি হচ্ছেন না। তা ছাড়া, তাঁর অন্য কাজও কম নেই! যেমন, ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যানের পদও তাঁর দখলে। সে কাজটাও তো করতে হবে। তাই কোর্টের কাজ মিটিয়ে দুপুরের মধ্যেই একবার ঢুঁ মারছেন পুরসভায়। গাড়িতে নয়, হেঁটেই।
যা দেখেশুনে অনেকে বলছেন, ‘‘এ তো অন্য কৃষ্ণেন্দু মনে হচ্ছে।’’
ঘটনা হল, কৃষ্ণেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে উদ্ধত আচরণের অভিযোগ কিন্তু কম ওঠেনি। সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না বলেও দলীয় মহলে কৃষ্ণেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে নানা সময়ে অভিযোগ উঠেছে। তাঁর মতের বিরুদ্ধাচরণ করলেই হুঁশিয়ারি দিতেন বলেও দলনেত্রীর কাছে একাধিক অভিযোগ গিয়েছে। সেই কৃষ্ণেন্দুবাবু এ বার ৪০ হাজার ভোটে হারের পরে কিছুটা হলেও সংযত হতে বাধ্য হয়েছেন বলে মনে করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের অনেকেই।
মন্ত্রী হওয়ার আগেও তিনি সময় পেলেই আইনজীবী হিসাবে জেলা আদালতে প্র্যাকটিস করতেন। এখন, বেলা ১২টায় পুরসভায় যাওয়ার আগে তিনি ফের আদালতে গিয়ে প্র্যাকটিস শুরু করছেন। গায়ে কালো কোট চাপিয়ে জেলা ও দায়রা বিচারকের এজলাসে রীতিমতো সওয়াল-জবাবও করছেন। গত শুক্রবারও তিনি আদালতে গিয়েছিলেন। বেলা সাড়ে দশটাতেই বাড়ি থেকে ছোট মেয়েকে আদর করে বের হন। বার হওয়ার মুখেই এক কর্মী কালো কোট পরিয়ে দেন।
বাড়ি থেকে হেঁটেই সোজা এজলাসে চলে যান। বিচারক আসার আগে সহকারী আইনজীবী মানবেন্দ্রনারায়ণ দাস ও জয়নারায়ণ চৌধুরির কাছে মামলার খুঁটিনাটি জেনে নেন। পরে ইংরেজবাজার থানার পিয়াসবাড়ির বিজল রাউত (মণ্ডল) নামে এক গৃহবধূকে পুড়িয়ে মারার মামলায় অভিযুক্ত পক্ষের হয়ে এ দিন তিনি ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সোনিয়া মজুমদারের এজলাসে সওয়াল করেন। বিচারকের সামনে তিনি বলেন, ‘‘এই মামলায় গৃহবধূর স্বামী অখিল মণ্ডল জেলে, শাশুড়ি লক্ষ্মীদেবী জমিন পেয়েছেন। যে কোনও শর্তে বাকি অভিযুক্ত ননদ সুনীতি মণ্ডলের আগাম জামিন চাইছি।’’ সরকারি আইনজীবী তীর্থ বসু জামিনের তীব্র বিরেধিতা করেন। বিচারক অবশ্য ৫০০০ টাকা ও দুজন জামিনদারের শর্তে আগাম জামিন মঞ্জুর করেন। জামিন হওয়ায় এজলাস থেকে বেরিয়ে একগাল সাফল্যের হাসি হেসে সোজা চলে যান বার অ্যাসোসিয়েশনে। এখন রোজই কোর্টে কাজ সেরে হেঁটে চলে যান কালীতলার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে। সেখানে হাজির থাকা কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। পাশেই পুরসভা। এর পরে সেখানে নিজের চেম্বারে যান। কৃষ্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘আমি বিধায়ক থাকাকালীনও সময় পেলে জেলা জজ কোর্টে প্র্যাকটিস করতাম। মন্ত্রী হওয়ার পর সেই সুযোগ ছিল না। এখন মন্ত্রী নই, হাতে সময় রয়েছে। দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে রুজু হওয়া মামলাগুলি নিখরচায় লড়ছি। পুরসভাও চালাচ্ছি। দলের কর্মীদের সমস্যাও মেটানোর চেষ্টা করি।’’
যদিও কৃষ্ণেন্দুবাবুর এই নয়া ইনিংস নিয়ে বিরোধীদের টিপ্পনী, ‘‘হেরে গিয়ে কাজ কমেছে. তাই আদালতে যাচ্ছেন। এটা মানুষের কাছে ভিড়তে একটা কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।’’ কৃষ্ণেন্দুবাবুর জবাব, ‘‘মানুষ শিক্ষা দিয়েছে। কিন্তু এখন অনেকেই অনুতপ্ত। যাই হোক, মানুষের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব।’’
তবে তৃণমূল সূত্রে দাবি করা হয়েছে, দলের মালদহের নেতৃত্বের উপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থা ফিরিয়ে আনতেই কৃষ্ণেন্দুবাবুর এই প্রয়াস। ভরাডুবির পরে এ বার দলের ভাবমূর্তি উদ্ধারে সচেষ্ট হয়েছেন কৃষ্ণেন্দু। সে কারণেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy