Advertisement
০৪ মে ২০২৪

মাঝরাতে সঙ্ঘ-অমিত ভোটবৈঠক

আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপি-কে পোক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে (আরএসএস) সামিল করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ। তারই অঙ্গ হিসেবে গত মঙ্গলবার প্রায় মধ্যরাতে সঙ্ঘের সদর দফতর কেশব ভবনে যান তিনি।

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৫ ০৪:২৪
Share: Save:

আগামী বছরের বিধানসভা ভোটে এ রাজ্যে বিজেপি-কে পোক্ত জায়গায় নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘকে (আরএসএস) সামিল করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিলেন দলীয় সভাপতি অমিত শাহ। তারই অঙ্গ হিসেবে গত মঙ্গলবার প্রায় মধ্যরাতে সঙ্ঘের সদর দফতর কেশব ভবনে যান তিনি। বিজেপি সভাপতির সঙ্গে ছিলেন দলের সর্বভারতীয় সংগঠন সম্পাদক রামলাল এবং সহ-সংগঠন সম্পাদক শিবপ্রকাশ। বিডন স্ট্রিটের সঙ্ঘ কার্যালয়ে বিজেপি সভাপতির যাওয়া এবং দীর্ঘ বৈঠকের ব্যাপারটি কাকপক্ষীতেও টের পায়নি! এমনকী সে দিন বিজেপির আরও কয়েক জন সর্বভারতীয় নেতা কলকাতায় থাকলেও তাঁদেরও এই বৈঠকের ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রাখা হয়েছিল!

সঙ্ঘ সূত্রের খবর, সে দিনের বৈঠকে সামিল হতে কলকাতায় এসেছিলেন আরএসএসের সহ-সম্পাদক ভাগাইয়াজি। ছিলেন সঙ্ঘের পূর্ব ক্ষেত্রের (পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি) প্রচারক প্রদীপ জোশীও। এক সময় অরুণাচল প্রদেশের দায়িত্বে থাকা এই নেতা বর্তমানে কলকাতা থেকে কয়েকটি রাজ্যের দায়িত্ব পালন করেন।

উল্লেখ্য, মাস কয়েক আগেই পশ্চিমবঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের কাজের বিস্তৃতির জন্য সঙ্ঘপ্রধান মোহন ভাগবত সংগঠনে বেশ কিছু পরিবর্তন করেছেন। অন্ধ্রপ্রদেশের ভাগাইয়াজি এখন কলকাতাকে কেন্দ্র করেই তাঁর কাজকর্ম চালাচ্ছেন। এ ছাড়াও দীর্ঘদিন পর এ রাজ্যের এক প্রচারক অদ্বৈত দত্তকে সর্বভারতীয় স্তরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন সঙ্ঘপ্রধান। তিনিও মূলত কলকাতায় থেকেই কাজ করছেন। আর বেশ কিছু দিন তাঁর নিজের সচিব থাকা বিদ্যুৎ মুখোপাধ্যায়কে এখন দক্ষিণবঙ্গের প্রান্ত প্রচারকের দায়িত্ব দিয়েছেন মোহন ভাগবত। রাজ্যস্তরে সংগঠনের এই পরিবর্তনের পর কেশব ভবনও এখন রাজ্যে সঙ্ঘ পরিবারের সক্রিয়তা বাড়ানোর উপরে বিশেষ জোর দিয়েছে।

রাজ্য বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘এক সময় সঙ্ঘের প্রবীণ প্রচারকরা এ রাজ্যে শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি আর কোন তিথিতে কী খাওয়া উচিত আর কী উচিত নয়, তা নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন! রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধির দিকে খেয়ালই ছিল না তাঁদের!’’ কিন্তু এখন মোহন ভাগবতের নেতৃত্বে সঙ্ঘ পরিবারের সমস্ত সংগঠনের কাজকর্মের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এসেছে জানিয়ে ওই নেতা বলেন, ‘‘শুধু বিজেপিতেই সঙ্ঘের ৪২ জন রাজ্য স্তরের প্রচারক সারা দেশে সংগঠন বাড়ানোর কাজ করছেন। গত মাসের শেষে তাঁদের নিয়ে মুম্বইয়ে তিন দিনের শিবিরও করেছে আরএসএস।’’ সঙ্ঘ সূত্রের খবর, মুম্বইয়ে ওই শিবিরে উপস্থিত ছিলেন সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক সুরেশ (ভাইয়াজি) জোশী। সেই শিবিরেই বলে দেওয়া হয়েছে, সঙ্ঘের মূল আদর্শের সঙ্গে কোথাও আপস না করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আরও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বাংলার মাটিতে রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধিও যে জরুরি, তা-ও উপলব্ধি করেছে সঙ্ঘ। ওই নেতার কথায়, ‘‘সেই কারণে অমিত শাহও তাঁর পরিকল্পনার ব্যাপারে সঙ্ঘের অনুমোদন নিতে গিয়েছিলেন।’’

দলের সভাপতি হওয়ার পর অমিত শাহ চার বার কলকাতায় এসেছেন। প্রথম বার এসেছিলেন গত বছর সেপ্টেম্বরে। তার পর ফের নভেম্বরে। দু’দফাতেই কলকাতায় সভা করেছিলেন তিনি। আর এ বছর জানুয়ারিতে এসে বর্ধমানে গিয়েছিলেন সভা করতে। প্রতি সফরেই কলকাতায় রাত্রিবাস করলেও এক বারও সঙ্ঘ দফতরে যাননি তিনি। ব্যতিক্রম হল এ বারে।

বিজেপির এক সূত্রের দাবি, অমিত শাহ দিল্লিতে কেশব কু়ঞ্জে মাঝে মধ্যেই যান। আমদাবাদে সঙ্ঘ দফতরেও তাঁর নিয়মিত যাতায়াত। কিন্তু অন্য রাজ্যে সঙ্ঘ কার্যালয়ে তিনি সাধারণত যান না। ফলে কলকাতায় এসে সঙ্ঘ কার্যালয়ে যাওয়ার মধ্যে বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে বলেই জানাচ্ছে ওই সূত্রটি।

কী আলোচনা হয়েছে সে দিনের বৈঠকে?

সঙ্ঘ সূত্রের খবর, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে, কোথায় কোথায় দুর্বলতা, কী ভাবে তার মোকাবিলা করা হবে, সে সবের একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা হাতে নিয়েই সঙ্ঘ নেতাদের কাছে যান অমিত। প্রায় দু’ঘণ্টার ওই বৈঠকের পরে বিজেপি সভাপতির পরিকল্পনার সঙ্গে সহমত হয়েছে সঙ্ঘ। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে হঠাতে সঙ্ঘ পরিবার সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নামবে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়েছে অমিতকে। তবে তার জন্য বেশ কিছু শর্তও দিয়েছে সঙ্ঘ।

কী সেই শর্ত?

সঙ্ঘের তরফে বিজেপি সভাপতিকে বলা হয়েছে, রাজ্যের মানুষ তৃণমূলের অপশাসন থেকে মুক্তি চায়। এ জন্য ক্ষয়িষ্ণু বামের তুলনায় বিজেপির উপরেই ভরসা রাখতে চান একটা বড় সংখ্যক মানুষ। এই অবস্থায় লড়াইয়ে থাকতে গেলে রাজ্য বিজেপির এক জন উপযুক্ত নেতা দরকার। যিনি তৃণমূলের অপশাসন নিয়ে মাঠে নেমে দলকে ভাল জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন।

সঙ্ঘের এক সূত্রের বক্তব্য, ‘‘যোগ্য নেতৃত্বের হাতে কর্তৃত্ব দেওয়ার অর্থ, রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বে বদল। সঙ্ঘেরএই পরামর্শ বিজেপি সভাপতি মেনে নিয়েছেন। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই রাজ্য বিজেপিতে ব্যাপক রদবদল হতে পারে। সিদ্ধার্থনাথ সিংহকে সরিয়ে এ রাজ্যে দলের দায়িত্ব কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের হাতে তুলে দেওয়া তারই ইঙ্গিত।’’ বিজেপিরই একটি শীর্ষ সূত্রের দাবি, বুধবার সকালে কলকাতা ছাড়ার আগে মঙ্গলবার মধ্যরাতের বৈঠকের ব্যাপারে কৈলাসকে বিস্তারিত জানিয়েছেন অমিত।

তা হলে কার নেতৃত্বে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে লড়বে বিজেপি?

সঙ্ঘ সূত্রের দাবি, দক্ষিণবঙ্গের এক চিকিৎসক নেতাকে রাজ্য সভাপতি করার জন্য অমিতকে বলা হয়েছিল। কিন্তু অমিত তাঁকে সভাপতির বদলে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিতে বেশি আগ্রহী। তিনি চান, মমতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো লড়াকু মেজাজের কাউকে নেতৃত্বে আনতে। সে দিনের বৈঠকে হালে দলে সামিল হওয়া এক অভিনেত্রীর নাম নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অমিত আরএসএস নেতাদের বলেছেন, ওই অভিনেত্রীকে সামনে রেখে আন্দোলন আর সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণে সংগঠন গড়ার কাজ হলে দু’দিক থেকেই লাভবান হওয়া যাবে।

তবে ওই অভিনেত্রীর রাজনৈতিক বিচক্ষণতায় খুশি হলেও তাঁর জীবনচর্চা নিয়ে কিছু আপত্তি রয়েছে সঙ্ঘ নেতাদের। সঙ্ঘ সূত্রে বলা হচ্ছে, গত ২২ জুন ওই অভিনেত্রীকে কেশব ভবনে ডেকে পাঠিয়ে ঘণ্টাখানেক কথা বলেছেন জাতীয় স্তরে বিজেপির সঙ্গে সঙ্ঘের প্রধান সমন্বয়কারী সহ-সম্পাদক কৃষ্ণগোপাল। সেই আলোচনার সঙ্গে বিজেপির নেতৃত্ব পরিবর্তনের কোনও যোগসূত্র ছিল না ঠিকই। কিন্তু ওই অভিনেত্রীর সঙ্গে কথা বলার পরে তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিবাচক মনোভাবই পোষণ করেছেন কৃষ্ণগোপাল। সঙ্ঘের নেতাদের কারও কারও মতে, ওই অভিনেত্রীর লড়াকু মেজাজ তাঁকে আগামী নির্বাচনে বিজেপির তুরুপের তাসে পরিণত করতে পারে। যদিও সঙ্ঘের এক কর্তার কথায়, ‘‘বিজেপির মতো রক্ষণশীল দলের নেতৃত্ব দিতে হলে ওঁর জীবনযাত্রার ধরনধারণে বদল আনা দরকার।’’

অমিত শাহের সঙ্গে সঙ্ঘ নেতাদের রাতের বৈঠকে এক সাংসদের হাতে দলের রাজ্য নেতৃত্বের ভার তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও কথা হয়েছে। সঙ্ঘ সূত্রের খবর, অমিত নিজেই ওই সাংসদের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন।

সে দিনের বৈঠকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সেটা হল, গত কয়েক মাসে শাসক দলে যে সব নেতা বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন, তাঁদের ভোটের আগে দলে নেওয়া হবে। বিজেপি সভাপতির ঘনিষ্ঠ এক নেতার দাবি, ভোটের মুখে তৃণমূলে বড় ধরনের ভাঙন ধরতে পারে। ওই নেতার কথায়, ‘‘ভাই-ভাইপোবাদের বিরুদ্ধে যাঁরা, তাঁদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। ভোটের আগে তাঁরা বিজেপিতে বা পৃথক কোনও মঞ্চে সামিল হতে পারেন।’’

রাজ্য নেতৃত্বে পরিবর্তনের পাশাপাশি বেশ কয়েক দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানো, সারদা-রোজভ্যালির মতো বেআইনি লগ্নি সংস্থা নিয়ে তদন্ত বা খাগড়াগড় বিস্ফোরণের মতো ঘটনার তদন্ত দ্রুত শেষ করার বিষয়েও উভয় পক্ষের আলোচনা হয়েছে। মধ্যরাতের বৈঠকে বিজেপি সভাপতি সঙ্ঘ নেতৃত্বকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, ‘‘অচিরেই বিজেপির ভিন্ন রূপ দেখতে পাবে রাজ্যবাসী।’’

কিন্তু তা কার হাত ধরে, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Amit Shah Bengal RSS abpnewsletters
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE