E-Paper

নবীনের স্বরে গানের ত্রিধারায় পূর্ণ আনন্দসন্ধ্যা

১৪২৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারের সঙ্গে সর্বতো ভাবে জড়িত রবীন্দ্রনাথ। পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ গ্রন্থটি সম্মানিত এ বারের আয়োজনে।

সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:১৬
সঙ্গীত পরিবেশনে সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। (বাঁ দিক থেকে) তবলায় দীপমালা ভট্টাচার্য, তানপুরায় অতসী চক্রবর্তী এবং এসরাজে অপরাজিতা চক্রবর্তী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

সঙ্গীত পরিবেশনে সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়। (বাঁ দিক থেকে) তবলায় দীপমালা ভট্টাচার্য, তানপুরায় অতসী চক্রবর্তী এবং এসরাজে অপরাজিতা চক্রবর্তী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

আনন্দ পুরস্কার প্রদানের আয়োজনে সঙ্গীত বরাবরই শ্রীপরিসর তৈরি করে এসেছে। তা এই সম্মাননা-অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য এবং বিশেষত্ব। তবে সে বিশেষত্বেরও বিবর্তন ঘটেছে নানা ভাবে। মার্গগানের যশস্বীরা এই আয়োজনে যেমন তাঁদের সুরমূর্ছনার সুগন্ধ ছড়িয়েছেন, তেমনই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরোধারা পরিবেশন করেছেন রবীন্দ্রনাথের গান। বিচিত্রতার পরম্পরাতেই অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলালের মতো চিরন্তর আখরকে প্রণাম জানিয়েছে এই আয়োজন। নিরীক্ষা আর সুনিবদ্ধ ভাবনার সূত্রেই আনন্দ সম্মাননার আসর ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে বার বার।

আনন্দবাজার পত্রিকার শতবর্ষ উদ্‌‌যাপনের আয়োজনে উপনিষদের শান্তিপাঠ রণিত হয়েছিল। ঐতরেয় উপনিষদের শান্তিমন্ত্র— ‘ওঁ বাঙ্মে মনসি প্রতিষ্ঠিতা/মনো মে বাচি প্রতিষ্ঠিতম্, আবিরাবীর্ম এধি...’। আমার কথা হৃদয়ে প্রতিষ্ঠা পাক, আমার হৃদয় কথায় প্রতিষ্ঠিত হোক। হে ব্রহ্ম, আপনি প্রতিষ্ঠিত হোন আমাতে...। ভৈরবের আঙ্গিকে শুরু হয়ে জৌনপুরিতে পৌঁছেছিল সেই শান্তিমন্ত্র। যে শিল্পী সে দিন তার উপস্থাপনায় ছিলেন, সেই সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শান্তিপাঠ দিয়েই শুরু হল আনন্দ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান। তবে এ বার শান্তিপাঠটি ঈশোপনিষদের— ‘ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে/পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে’— পূর্ণমদঃ বা পূর্ণব্রহ্ম থেকে উদ্ভুত সব কিছুই পূর্ণ। উপনিষদের এই ভাবনায় পূর্ণতার আনন্দবাদ শ্রুতিতে অনূদিত। পূর্ণ থেকে উৎপন্ন সকল কিছুই পূর্ণ। পূর্ণ থেকে পূর্ণ নিলে অবশিষ্টটুকুও পূর্ণ। পরব্রহ্ম থেকে উৎপন্ন জগৎ পূর্ণ। যেমন, মাতৃকোষ থেকে তৈরি হওয়া প্রতিরূপ সন্তানকোষ। অতিপ্রাচীন দর্শনের সুগভীর এই দিশা সমদীপ্তার মিঠে-ভরাট-লাবণ্যময় কণ্ঠে অনুষ্ঠানের সাঙ্গীতিক আবহ তৈরি করে দিল। ভীমপলশ্রী নিবদ্ধ সুরে উপস্থাপন করলেন শিল্পী। পরিবেশনার প্রাপ্তি শিল্পীর উচ্চারণও। দেবভাষার ধ্বনিমাহাত্ম্য সভাগৃহের সমীহ আদায় করল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওঁ আনন্দধ্বনি। ওঁ সঙ্গীত’। শিল্পীর উচ্চারণ সেই আর্ষেরও প্রতিফলন ঘটাল।

১৪২৯ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কারের সঙ্গে সর্বতো ভাবে জড়িত রবীন্দ্রনাথ। পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’ গ্রন্থটি সম্মানিত এ বারের আয়োজনে। সমদীপ্তার পরের নির্বাচন রবীন্দ্রনাথের গান। ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে/হৃদয় তৃষায় হানে রে’। দ্রুতলয়ে ধরলেন শিল্পী। তৃষিত বিরহের আলিম্পনের সঙ্গে প্রাপ্তি খানিক বীররসের আভাসও। বিশেষত, ‘ভয় নাহি, ভয় নাহি’ অংশে দাপুটে লহমা স্বয়ম্প্রকাশ হল। এ গানের রাগ-কাঠামো বৃন্দাবনী সারং। স্বরনির্মিতিকে পূর্ণ মান্যতা দিয়েও মিড়-মাধুর্যে শিল্পী কাফি ঠাটের মাধুর্যের সঙ্গে অনায়াস মিশিয়ে দিলেন গানের বাণী-কাঠামোর অর্থবহতাকে। কাহারবা তালের ব্যবহারেও ছিল বৈচিত্র।

সমদীপ্তার পরের পরিবেশনাও রবীন্দ্রগান। ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’। গানটি তাল ছাড়া টপ্পা-নির্যাসে গাইলেন সমদীপ্তা। ১৯২৫ সালের কোনও এক সময় ভীমরাও শাস্ত্রীর সঙ্গে গানের আলাপচারিতায় বসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভীমরাও শাস্ত্রীয় গানের ধুন ধরছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাংলা কথা বসাচ্ছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু এবং আরও কয়েক জন। অবশ্যই ভীমরাওয়ের ধুন ছাপিয়ে কবিমনে তৈরি হচ্ছিল তাঁর আপন ভুবনের চিরবিস্ময় রসায়ন। এই ভাবেই জন্ম নিয়েছিল প্রথম পঙ্‌ক্তি— ‘সখী, আঁধারে একেলা ঘরে মন মানে না’। খাম্বাজ-নিবদ্ধ চার পঙ্‌ক্তির এই গানের শেষ পঙ্‌ক্তি কী ভাবে গাইতে হবে, আধো উচ্চারণের কোন মৃদু মাধুর্যে, তা আশ্রমকন্যা অমিতা সেনকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন কবি— ‘যেন কার বাণী কভু কানে আনে— কভু আনে না’। আনন্দ-পরিসরে সমদীপ্তা এ গানে সেই আধো উচ্চারণের মায়া তৈরি করলেন।

এ সন্ধ্যার শেষ গানে সমদীপ্তা এলেন হুগলির গুপ্তিপাড়ার প্রায়বিস্মৃত এক জাদুকরের রচনায়। টপ্পা আঙ্গিকের প্রেমের গান এবং ভক্তিসঙ্গীতে যিনি বিস্ময় তৈরি করেছিলেন। তিনি কালী মির্জা। আসল নাম কালিদাস চট্টোপাধ্যায়। কালী মির্জার যে গানটি শিল্পী চয়ন করলেন, তা ঘটনাচক্রে নিধুবাবু বা রামনিধি গুপ্তের রচনা বলেই এখন পরিচিত। ‘শ্যামনাগর হে/আমি আর প্রেম করব না/তুমি ফিরে যাও’। ভৈরবীতে বাঁধা কালী মির্জার এই গানে শিল্পীর সুঠাম দানা আর চর্চিত গায়কির স্পষ্ট ছাপ। আদ্ধা তালে পরিবেশিত এই টপ্পায় স্বরান্ত শব্দের দীর্ঘ ব্যবহার চমৎকৃত করে।

এ সন্ধ্যার আয়োজনে সমদীপ্তা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সঙ্গতে ছিলেন আরও তিন নারী। তবলায় দীপমালা ভট্টাচার্য, এসরাজে অপরাজিতা চক্রবর্তী এবং তানপুরায় অতসী চক্রবর্তী। তিন শিল্পীই মাপা সঙ্গতে গোটা উপস্থাপনার আবহ ধরে রেখেছিলেন। ভারী মুখের তবলার ঠেকা অসামান্য। এসরাজে গানের রাগরূপ প্রতিষ্ঠার গৌরচন্দ্রিকা তুলনাহীন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Ananda Puraskar Kolkata

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy