স্বপনকান্তি ঘোষ
বিজেপি শক্তিবৃদ্ধি করছে। অথচ ঘর গোছানোর বদলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে বীরভূমে দলীয় নেতৃত্বও অক্ষত রাখতে পারছে না তৃণমূল। জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধেই দলে ক্ষোভ ধোঁয়াচ্ছে। বিজেপিও এই বিক্ষুব্ধ নেতাদের দলে টানতে আগ্রহী।
পাড়ুই কাণ্ডের পরে ‘বিজেপির সন্ত্রাসের’ প্রতিবাদে শনিবার বিকেলে জেলা জুড়ে প্রতিবাদ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল। অথচ জেলাসদর সিউড়ির মিছিলে দেখা গেল না বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষকেই। তৃণমূল সূত্রের খবর, অনুব্রত মণ্ডলের দাপটে কোণঠাসা স্বপনবাবুকে ইদানীং দলের কর্মসূচিতে বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। যদিও তিনি নিজে এ নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি।
বীরভূমের বেশ কিছু এলাকা, বিশেষত বোলপুর মহকুমায় বিজেপির উত্থানে তৃণমূল ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শঙ্কিত। সম্প্রতি অনুব্রতর খাসতালুক পাড়ুইয়ে যে ভাবে বিজেপি ‘পাল্টা মার’ দিয়েছে, তাতে দলের অনেক পোড় খাওয়া নেতাই অশনি সঙ্কেত দেখছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ দিন বিজেপির ‘সন্ত্রাস’ নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল বের করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের শক্তি জাহির করা ও কর্মী-সমর্থকদের চাঙ্গা করা। তাতে সিউড়ির বিধায়ক না হাঁটায় অন্য রকম ইঙ্গিতও পাচ্ছেন কেউ-কেউ।
২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে আসা শিল্পপতি স্বপনকান্তিকে এক সময়ে ‘দলের সম্পদ’ হিসেবেই বিবেচনা করা হত। গোড়াতেই প্রদেশ তৃণমূলের সম্পাদক এবং উত্তর দিনাজপুরের পর্যবেক্ষক করে দেওয়া হয় তাঁকে। সে বার লোকসভা নির্বাচনে শতাব্দী রায় বীরভূম কেন্দ্রে প্রার্থী হলে স্বপনই হন তাঁর অন্যতম সহায়। দলের তৎকালীন জেলা চেয়ারম্যান (সভাপতি নন) আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। অনুব্রতর সঙ্গে গোড়া থেকেই তাঁদের বনিবনা ছিল না। কিন্তু অনুব্রত তখনও সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেননি।
বিধানসভা ভোটের পরেই অবশ্য সমীকরণটা পাল্টে যায়। সাংগঠনিক স্তরে ডানা ছাঁটা হয় আশিসের। তৃণমূল ভবনের আশীর্বাদে অনুব্রতই হয়ে ওঠেন জেলায় দলের ‘শেষ কথা’। মনিরুল ইসলামের মতো যে নেতারা তাঁর ঘনিষ্ঠ, কার্যত তাঁদের হাতেই চলে যায় ক্ষমতার রাশ। অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখতে পরে আশিসবাবুও অনুব্রতের শরণ নিতে বাধ্য হন। অনুব্রতর সঙ্গে সন্ধি না করে নিজের আসন ধরে রাখা যাবে না বুঝে এ বার লোকসভা ভোটের আগে শতাব্দীও অনুব্রতর সঙ্গে হাত মেলান। কিন্তু স্বপনকান্তির মতো কিছু নেতা বাগ মানেননি। তাঁরা ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে গিয়েছেন। এখন তৃণমূল যখন দুর্বল হচ্ছে, দল আর তাঁদের সে ভাবে পাশে পাচ্ছে না।
সিউড়ির রাস্তায় সন্ত্রাস-বিরোধী মিছিল তৃণমূলের।
কিন্তু সেই মিছিলে নেই বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ।
শনিবার তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
স্বপনবাবুর ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রের খবর, দলের জেলা নেতাদের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ও কাজকর্ম নিয়ে প্রায়ই অনুগামীদের কাছে বিরক্তি প্রকাশ করে আসছিলেন তিনি। কয়েক বার রাজ্য নেতৃত্বকেও সেই বিরক্তির কথা জানিয়েছেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে আসন সমঝোতা নিয়েও তাঁর সঙ্গে জেলা নেতৃত্বের বিরোধ হয়েছিল। শেষমেশ তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে মন্ত্রী মলয় ঘটক গিয়ে মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু এর পরেও অনুব্রতর আধিপত্য খর্ব হয়নি। বরং বারবার হুমকি দেওয়া ও নানা গোলমাল পাকানোর অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও তৃণমূল নেত্রী তাঁকে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে গিয়েছেন। পুলিশও অনুব্রতকে ধরেনি। এর ফলে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছেন স্বপনকান্তির মতো নেতারা।
এ দিন স্বপনকান্তির কিছু অনুগামীকে মিছিলে দেখা গেলেও তিনি নিজে আসেননি। পরে সিউড়িতে নিজের অফিসে বসে তিনি বলেন, “আমি এ নিয়ে কোনও কথা বলব না।” পাশ থেকে তাঁর কয়েক জন অনুগামী বলে ওঠেন, “দাদা তো এখন আর কোনও মিটিং-মিছিলেই যাচ্ছেন না।” ঘনিষ্ঠ মহলের একটি সূত্রের দাবি, পাড়ুইয়ে সাম্প্রতিক সন্ত্রাস এবং বিজেপির উত্থানের জন্য দলের একাংশ অনুব্রতর কৃতকর্মকেই দায়ী করছেন। স্বপনবাবুর মতো নেতারা তার দায় নিতে চান না। সেই কারণেই তিনি এ দিন মিছিলে যাননি। বিধায়কের দায়িত্ব পালন ছাড়া আর কোনও দলীয় কাজে জড়াতে যে তিনি আগ্রহী নন, তা রাজ্য নেতৃত্বকে জানিয়েও দিয়েছেন।
বহু চেষ্টা করেও এ দিন অনুব্রতর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় দাবি করেন, “বীরভূমে তৃণমূল ঐক্যবদ্ধ রয়েছে। স্বপনবাবু হয়তো কোনও কারণে মিছিলে আসতে পারেননি। তার থেকে মনে করার কারণ নেই যে, এর পিছনে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে।” বোলপুরের বিধায়ক তথা মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহও অবশ্য দাবি করেন, “আমরা সবাই এক সঙ্গে আছি। কোথাও কোনও বিভেদ নেই।”
পাথর, খড়িমাটি, খাদান ব্যবসায়ী স্বপনকান্তিকে এক সময়ে যে ভাবে লুফে নিয়েছিল তৃণমূল, সুযোগ পেলে বিজেপিও তা করতে পারে বলে তৃণমূলের জেলা নেতাদের অনেকের আশঙ্কা। কিন্তু বিজেপি কি তাঁকে দলে নিতে আগ্রহী? বিজেপির জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডল বলেন, “স্বপনবাবুর জন্য আমাদের দরজা খোলাই আছে। উনি স্বাগত।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy