আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলে অবৈধ কয়লায় কারবারে হয়তো কিছুটা ভাটা পড়েছিল। প্রতীকী ছবি।
ওটিটি সিরিজে যেমন হয়। রবিবার ছুটির দিন, রাতে সিটিসেন্টারের একটি বাড়িতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েক জন। অভিযোগ, আচমকাই সেখানে মোটরবাইক নিয়ে হাজির হয় দু’জন। তার পরেই গুলির শব্দ। একটি গর্ত এখনও সেই বাড়ির দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছে, যাকে গুলির ক্ষত বলেই চিনিয়ে দিচ্ছেন স্থানীয়েরা।
এটাই একমাত্র ঘটনা নয়। সম্প্রতি বীরভূম লাগোয়া পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় পরিবহণ দফতরের একটি গাড়িকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার ধাওয়া করে দুষ্কৃতীরা। অভিযোগ, কয়েক রাউন্ড গুলিও চালিয়েছিল তারা।
কয়লা, গরু বা বালি-পাথরের অবৈধ কারবার যেখানে সিবিআই-ইডির তদন্তের চাপে অনেকটাই থমকে, সেখানে পরপর এমন ঘটনা ঘটছে কেন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, প্রকাশ্যে কারবারের রমরমা হয়তো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তলে তলে তা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক দল লোক। যার জন্য তাদের প্রয়োজন পরিবহণ দফতরের ছাড়পত্র। এই কারবার সম্পর্কে ধারণা রয়েছে, এমন এক পরিবহণ দফতরের কর্মীর কথায়, ‘‘চোখ বুজে থাকলে ভাল। না হলে আমাদের থামিয়ে দিতে এরা গুলি চালাতেও পিছ-পা নয়।’’
পুলিশের একটি সূত্রের দাবি, আসানসোল-দুর্গাপুর অঞ্চলে অবৈধ কয়লায় কারবারে হয়তো কিছুটা ভাটা পড়েছিল। কিন্তু রবিবার সিটিসেন্টারে যা ঘটেছে, তাতে কয়লা পরিবহণের বরাত নিয়ে দ্বন্দ্বের তত্ত্ব নতুন করে সামনে আসে। স্থানীয় সূত্রের খবর, কয়লা পাচার মামলায় ধরপাকড় শুরুর পরে, বেআইনি কারবারিদের অনেকে গা-ঢাকা দিয়েছে। তবে কারবারে পুরো ঝাঁপ পড়েনি। খনি অঞ্চলের বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, ডাম্পারের পাশাপাশি কয়লা যাচ্ছে ট্রাকে। এখানে ‘ওভারলোডিং’ কমিয়ে ঢাকা, চাপা দিয়ে কয়লা নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের দাবি, বৈধ কয়লার ফাঁকেই অবৈধ কয়লা পরিবহণের চেষ্টা করছেন অনেকে। তাই ইসিএলের কয়লা পরিবহণ বরাত (ডেলিভারি অর্ডার, সংক্ষেপে ডিও) নিয়ে রেষারেষি শুরু হয়েছে। দুর্গাপুরে গুলিও সে জন্যই চলেছে বলেও পুলিশের দাবি।
একই ভাবে বীরভূমের পাঁচামি, নলহাটি, রামপুরহাটের পাথর খাদান থেকে রোজ ট্রাক-ডাম্পারে পাথর, বালি বোঝাই হয়ে রাজ্যের নানা প্রান্তে যায়। সব ক্ষেত্রেই বৈধ বালি-পাথরের আড়ালে অবৈধ কারবার চলছে বলে সন্দেহ প্রশাসনের একাংশের। বালি তোলায় নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় এখন এই ধরনের ট্রাক আটকানো কঠিন। একমাত্র গাড়ির কাগজপত্রে যদি গাফিলতি থাকে বা বাড়তি ওজন (‘ওভারলোডিং’) হয়, তা হলেই গাড়ি আটকানো সম্ভব, বলছেন পরিবহণ আধিকারিকেরা। বীরভূম লাগোয়া পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়ায় সম্প্রতি বাড়তি বালি বোঝাই গাড়ি ধরতে গিয়ে প্রাণ যেতে বসেছিল পরিবহণ দফতরের কর্মী-আধিকারিকদের। দুষ্কৃতীরা তাদের লক্ষ করে গুলি চালায়।
গরু পরিবহণের ক্ষেত্রেও কিছু বদল এসেছে। গরু বোঝাই গাড়িগুলি আগের মতো উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড হয়ে বীরভূম, দুই বর্ধমানের পথে বিশেষ চলছে না। বরং ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা থেকে ঝাড়গ্রাম হয়ে কিছু গরু বোঝাই গাড়ি ঢুকছে। গাড়িগুলিও ছোট, তাতে গরুর সংখ্যাও আগের থেকে অনেক কম। ঠিকঠাক নথি দেখানোয় সেগুলিকে ছেড়ে দিতে হয়েছে বলেও প্রশাসনের দাবি।
জেলা প্রশাসনগুলির অবশ্য বক্তব্য, বালি ও কয়লা পাচারে নিয়মিত অভিযান চলছে, আদায় হচ্ছে বড় অঙ্কের জরিমানাও। ঝাড়গ্রাম জেলা পুলিশের দাবি, গরু পাচারের অভিযোগে গত ছ’মাসে ৩০টি গাড়ি আটক, ৪৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকে চলতি মাস পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে শ’তিনেক গরু।
তবু ‘কারবার’ চলছে বৈধতার মোড়কে— বলছে প্রশাসনেরই একাংশ। তাদের দাবি, পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে ‘সঠিক পরিকল্পনামাফিক’ পণ্য পরিবহণের উপরে। কারবারিরা এখন সেই পরিবহণের দিকটাই ‘মন দিয়ে দেখছেন’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy