Advertisement
০৩ মে ২০২৪

মাটির কাছেই আছেন ব্রেবোর্নের ক্লাস পালানো মেয়ে

কলেজে পড়ার সময় কখনও ক্লাস ফাঁকি দিয়েছেন? এক মুখ হাসি নিয়ে উত্তরটা দিলেন তিনি। জানালেন, কলেজে ঢোকার পর প্রথম মাসেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এগারোটা সিনেমা দেখেছিলেন।

তারকা প্রাক্তনীর সঙ্গে নিজস্বী। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের এক অনুষ্ঠানে ছাত্রীদের মাঝে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। শনিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

তারকা প্রাক্তনীর সঙ্গে নিজস্বী। লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের এক অনুষ্ঠানে ছাত্রীদের মাঝে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার চেয়ারপার্সন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। শনিবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।

গার্গী গুহঠাকুরতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫৯
Share: Save:

কলেজে পড়ার সময় কখনও ক্লাস ফাঁকি দিয়েছেন?

এক মুখ হাসি নিয়ে উত্তরটা দিলেন তিনি। জানালেন, কলেজে ঢোকার পর প্রথম মাসেই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এগারোটা সিনেমা দেখেছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার বাবা ছিলেন হিন্দি সিনেমা দেখার ঘোর বিরোধী। মেয়ে তাই লেডি ব্রেবোর্নের হস্টেলে এসেই সাধ মিটিয়ে নিয়েছিলেন। ফলও মিলেছিল হাতেনাতে। মান্থলি টেস্টে বেশ খারাপ নম্বর। তখন সত্তরের দশক। ইংরেজির ছাত্রীকে কড়া ধমক দিয়ে শিক্ষিকা বলেছিলেন, পরের পরীক্ষার রেজাল্ট ভাল না হলে বাবা-মাকে জানানো হবে।

আর আজ? ফোর্বস পত্রিকার বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মহিলাদের তালিকায় সে দিনের সেই আবাসিকের নাম জ্বলজ্বল করছে ৩০ নম্বরে। দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক— স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার রাশ তাঁর হাতে। এ সব তকমাই এক লহমায় ঝেড়ে ফেলে কলেজের দিনগুলোয় ফিরে গেলেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। শনিবার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে গল্পে মাতলেন তিনি।

কলেজের প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভর্তি। সামনের সারিতে বসে অরুন্ধতীর শিক্ষিকারা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারিতে তাঁর সহপাঠিনী ও দু-এক বছরের সিনিয়র-রা। মঞ্চে উঠে তিনি অবশ্য আর ক্লাস-পালানো ছাত্রী নন। বরং বাধ্য ছাত্রীর মতোই এক শিক্ষিকার প্রশ্নের উত্তর দিলেন। প্রশ্ন ছিল— পুরুষ-প্রধান জগতে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

আর এই প্রশ্নের উত্তরেই উঠে এল ৪০ হাজার কোটি ডলারের সম্পত্তি সামলানোর পেশাদারি মনোভাব। কাজের জায়গায় কাজ। আর বাড়ির জায়গা বাড়িতে। অরুন্ধতী বললেন, ‘‘পরিস্থিতি বুঝে ঠিক করতে হবে, কোন ক্ষেত্রে কখন সময় দিতে হবে। যিনি বাড়ি ভাল সামলাতে পারেন, তিনি অফিসের কাজও ভাল সামলাতে পারবেন। ভাল করে কাজ করার ইচ্ছে ও আত্মবিশ্বাস থাকলে কাউকে আটকানো যায় না।’’

তবে কাজের জায়গায় বা পারিবারিক জীবনে, কোথাওই কট্টর নারীবাদে বিশ্বাসী নন অরুন্ধতী। তিনি মনে করেন, কোনও জায়গায় পৌঁছতে গেলে কট্টর নারীবাদী হওয়ার দরকার নেই। তাঁর কথায়, ‘‘মিলেমিশে কাজ করা সম্ভব। যেখানে প্রয়োজন সেখানে অবশ্যই কঠিন হতে হবে।’’ এই প্রসঙ্গে এসবিআই বোর্ড-রুমের একটি গল্প বললেন তিনি। যে কোনও বোর্ড-রুমেই সাধারণত কনকনে ঠান্ডা করে এসি চালানো থাকে। কিন্তু শাড়ি পরিহিতাদের ওই কনকনে ঠান্ডায় বসে থাকা খুবই কষ্টকর। তা হলে উপায়? হলুদ সিল্কের শাড়ির ব্যাঙ্ক কর্ত্রী বললেন, ‘‘এসবিআই-এর বোর্ড-রুমে তাপমাত্রা এমন রাখা হয়, যাতে শাড়ি পরিহিতাদের কোনও সমস্যা না হয়। আর যাঁরা কোট পরে থাকেন, তাঁদের গরম লাগলে কোট ও টাই খুলে রাখতে পারেন।’’ শাড়ি বনাম কোটের এই গল্প শুনে হাততালির ঝড় উঠল।

স্টেট ব্যাঙ্কের ১৬ হাজার শাখা। দুই লক্ষ কুড়ি হাজার কর্মী। বাইশ কোটির বেশি গ্রাহক। এই রাজসূয় যজ্ঞ লাগাতার চালানোর চাপ অবশ্যই আছে। তারকা প্রাক্তনীর কাছে কলেজের এক বর্তমান ছাত্রী জানতে চাইল চাপ দূর করার কৌশল। অরুন্ধতীর দাওয়াই— মজার খোরাক খুঁজে নিতে হবে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই। ফের নিজের কর্মক্ষেত্র থেকেই তুলে আনলেন একটি গল্প। তখন তিনি ছিলেন খড়্গপুরের এসবিআইয়ে। সদাব্যস্ত শাখায় কাজের চাপ বেশিই ছিল। অরুন্ধতীর কথায়, ‘‘মোটা মোটা লেজার বইয়ের আড়ালে আমাকে প্রায় দেখাই যেত না। অধিকাংশ সময় দাঁড়িয়ে কাজ করতাম। কাজ হয়ে গেলেও লেজার সরতে দেরি হতো। কারণ যাঁরা লেজার বই সরিয়ে অন্য টেবিলে নিয়ে যাবেন, তাঁদের ডেকে ডেকেও অনেক সময় পাওয়া যেত না। এই পরিস্থিতিতে আমি ম্যানেজারকে বললাম— ‘হরি’, ‘নারায়ণ’ বা ‘শঙ্করের’ মতো ঈশ্বরের নামে যাঁদের নাম, তেমন কাউকে আমার কাজের জন্য রাখা হোক। সে ক্ষেত্রে ঈশ্বরের নামও করা হবে। আবার কাজও করা হবে।’’ আবার হাসির রোল প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে।

গল্পের পর গল্পের পর গল্প। এই ভাবেই যেন কলেজ-পরবর্তী জীবনের কঠিন ধাপগুলো অতি সহজ করে দিলেন অরুন্ধতী।

এমনই এক গল্পে অবশ্য কিঞ্চিৎ বেকায়দায় পড়ে গেলেন তাঁর সিনিয়র দিদিরা! সদ্য কলেজ ও হস্টেলে পা রাখা অরুন্ধতীকে বিপত্তিতে ফেলেছিল তাঁর উচ্চারণ। বাংলার বাইরে বড় হওয়া অরুন্ধতীকে নাম বলতে বলেন সিনিয়র দিদি। হিন্দি উচ্চারণেই নাম বলেছিলেন অরুন্ধতী। ব্যস! সিনিয়র দিদি ধমকে দিলেন, ‘‘নিজের নামও ঠিক করে বলতে জানো না!’’ তার পর? নামতা পড়ার মতো একটানা নিজের নাম বলে যেতে হল অরুন্ধতীকে। এতেও ছাড় নেই। পরের হুকুম— পরের দিন সকালে ‘ফ্রেশার’দের লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে, তেল চকচকে চুলে কলেজের মাঠে প্যারেড করতে হবে। সঙ্গে কলেজের থিম সং। গল্পের এই পর্যন্ত এসে তিনি নিরীহ হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘‘তোমরা সেই গান জানো? আসলে সেটা কলেজের থিম সং-এর প্যারোডি।’’

শুধু সিনিয়র-রা নন, হস্টেলে যাঁদের সঙ্গে তিন বছর কাটিয়েছেন, তাঁদের কাণ্ডকারখানাও বললেন। অরুন্ধতীর কথায়, ‘‘হস্টেলে থাকার সময়, বিশেষ করে পরীক্ষার আগে গরম জল ছিল খুব দামি জিনিস। একদিন রাতে কয়েক জন মিলে কফি তৈরি করব। যে যার ফ্লাস্ক খুলে তো অবাক। জল নেই এক ফোঁটাও।’’ খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, এক বান্ধবী ওই গরম জল দিয়ে মেজাজে পা পরিষ্কার করছে। কার্যত গণধোলাই দেওয়া হয় তাকে। গল্প শেষ করা মাত্র দর্শকাসনে বসা এক জন চিনিয়ে দিলেন সে দিনের ‘আসামি’কে। কফির জলে পেডিকিওর করা সেই বান্ধবীর তখন স্মৃতিতে মুখ লাল। তার পর হেসে খুন তিনিও।

এ ভাবেই হাসি-মজায় গোটা অনুষ্ঠান মাতিয়ে রাখলেন অরুন্ধতী। কলেজ ছেড়ে যাওয়ার সময়ও তিনি এসবিআই চেয়ারপার্সন নন। শিক্ষিকাদের প্রণাম করলেন। সিনিয়র দিদির মতোই বর্তমান ছাত্রীদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে ‘গ্রুপি’ তোলার আবদার রাখলেন। দিলেন অটোগ্রাফ। অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসি়ডেন্ট অজন্তা চৌধুরী, অধ্যক্ষা শিউলি সরকার থেকে ছাত্রীরা— সবাইকে ছুঁয়ে গিয়েছে ’৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ ও হস্টেলের প্রাক্তনীটির মাটির কাছাকাছি থাকার গুণ।

আসলে মাটির কাছাকাছি থাকাকেই জীবনের যাবতীয় সাফল্যের চাবিকাঠি হিসেবে দেখেন তিনি। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মহিলাদের তালিকায় গত বছর তিনি ছিলেন ৩৬। ঠিক তার আগেই রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। স্বামীকে এসএমএস করে সুসংবাদটা জানালেন অরুন্ধতী। পাল্টা এসএমএস এল, ‘রানি এই তালিকায় আজীবন থাকবেন। তোমার মেয়াদ কিন্তু আর তিন বছর!’ এ বছর তালিকায় ৩০ নম্বরে উঠে আসা এসবিআই চেয়ারপার্সনের অবশ্য তাতে হেলদোল নেই। ‘‘চেয়ারের সম্মানেই সম্মান’’, বলছেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE