মুখোমুখি। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব ও শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য। সোমবার উত্তরকন্যায় বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি।
ঠিক যেন সেই পুরনো দিনের মতোই। বয়সে বড় অশোক ভট্টাচার্য স্নেহশীল দাদার মতোই গৌতম দেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ভাল আছ তো?’ তার পরে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, ‘উত্তরকন্যাটা বেশ ভালই তৈরি করেছ।’
শিলিগুড়ি পুরসভার সিপিএমের মেয়র অশোকবাবুর মুখে সে কথা শুনে তৃণমূলের মন্ত্রী গৌতমবাবুর মুখে তখন হাসি। আন্তরিক ভাবেই বললেন, ‘আপনি এক দিন সময় করে এসে জায়গাটা ঘুরে যাবেন।’
ঠিক যেন সেই পুরনো দিনের মতোই। উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে এই দুই প্রবীণ নেতাকে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন ও জানেন, তাঁরা অনেকেই মানছেন, অতীতে বাম আমলে অশোকবাবু নানা কাজে গৌতমবাবুকে পাশে পেয়েছেন। সম্প্রীতি বিষয়ক বৈঠক, মিছিলে ডাকা মাত্র সাড়া দিয়ে অশোকবাবুর পাশে হেঁটেছেন গৌতমবাবু। অশোকবাবুর বাড়িতেও যেতেন গৌতমবাবু। আড়াই দশক ধরে মন্ত্রী অশোকবাবুর বাড়ি ‘রুদ্রেশ্বর ভবন’-এ বাইরের কাঠের ঘরেই বসত আম দরবার। বিশেষ অতিথিদের জায়গা ছিল অন্দরের পাকা ঘরে। কোনও আর্জি থাকলে ফাইলপত্র হাতে নিয়ে সেখানেও দেখা গিয়েছে গৌতমবাবুকে। কখনও নিরাশও হননি গৌতমবাবু। সে জন্য বামেদের অন্দরেও একটা কথা শোনা যায়, বাইরে যতই বিরোধিতা থাকুক না কেন, বরাবরই গৌতমবাবুকে স্নেহশীল অভিভাবকের দৃষ্টিতেই দেখেছেন অশোকবাবু।
কিন্তু এর মধ্যে মহানন্দা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পরে অশোকবাবুকে যে ভাবে গৌতমবাবু ‘উনি তো পঞ্চায়েত সদস্য পর্যন্ত নন’ বলে টিপ্পনী করতেন, তাতে দু’জনের সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছেছে বলে ভেবেছিলেন অনেকে। পক্ষান্তরে, তৃণমূলের অন্দরের খবর, সদ্য সমাপ্ত পুরভোটের প্রাক্কালে অশোকবাবুর কিছু মন্তব্য শুনে গৌতমবাবু একান্ত ঘনিষ্ঠ কয়েক জনের কাছে ‘অশোকদা এমন বলতে পারল’ বলে বেদনা মিশ্রিত বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন।
এই অবস্থায়, অশোকবাবু মেয়র হওয়ার পরে গৌতমবাবুকে এড়িয়ে সরাসরি পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও জনস্বাস্থ্য কারিগরি মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু, কলকাতায় গিয়ে দেখা পাননি। উপরন্তু, মন্ত্রীর সচিব পর্যন্ত অশোকবাবুকে বাইরে অপেক্ষা করিয়েছিলেন। এর পরে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীকে দু’বার চিঠি দিয়ে এ দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সময় স্থির করেন শিলিগুড়ির মেয়র। সেই বৈঠক কেমন পরিবেশে হয়, তা নিয়ে তাই কৌতূহল ছিল অনেকেরই।
গৌতমবাবু কিন্তু মনে রেখেছিলেন, রক্তে শর্করার মাত্রা বেশি থাকায় নিয়মিত ইনসুলিন নেন অশোকবাবু। তাই এ দিন উত্তরকন্যায় মেয়রের আপ্যায়নের জন্য সুগার ফ্রি বিস্কুটও ছিল। তাতেই বোঝা যায়, অনেক কিছু বদলালেও দু’জনের সম্পর্ক যেন অটুট। অশোকবাবু পৌঁছনোর কথা ছিল বেলা ১২টায়। প্রায় আধ ঘণ্টা আগে গৌতমবাবু পৌঁছে যান উত্তরকন্যায়। চেয়ার-টেবিল, তোয়ালের তদারকি করেন নিজেই। ফিশ-ফ্রাই, কেক, কাজু বরফি, ঝুরিভাজা, দু’রকমের বিস্কুট আর দু’দফায় দার্জিলিং চায়ের আয়োজনের তদারকির ফাঁকেই বেলা ১২টার মিনিট পাঁচেক পরে অশোকবাবু পৌঁছন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি মেয়র সহ ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। ফটো সেশনের পরে দু’জনে বৈঠকে বসেন।
প্রত্যক্ষদর্শী অফিসার-কর্মীরা জানাচ্ছেন, বৈঠকেও বোঝা গিয়েছে, দু’জনের সম্পর্ক কতটা গভীর। প্রতিনিধি দলের কয়েক জন একাধিক প্রকল্পের ব্যাপারে দ্রুত বরাদ্দ চাইলে অশোকবাবুই তাঁদের থামিয়ে দিয়েছেন। তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, মন্ত্রীরা চাইলে সব সঙ্গে সঙ্গে করতে পারেন না, নিয়ম মেনে করতে হয়, সেটা বুঝতে হবে।
বৈঠকে শহরের উন্নয়নের রূপরেখা নিয়ে কী আলোচনা হল? কাজের কাজ আদতে কিছু হল কি?
সৌহার্দ্যের পরিবেশ অটুট রাখতে অশোকবাবু জানিয়েছেন, শহরের নানা এলাকায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দফতর, এসজেডিএ অনেক কাজ করছে। সে সব কাজ যেন বন্ধ না হয়। তবে আগামী দিনে শহরে যে কোনও কাজ করার আগে পুরসভার সম্মতি যেন নেওয়া হয়। গৌতমবাবু তাতে রাজি। কিন্তু, তাঁকে এড়িয়ে কলকাতা গিয়ে তদ্বির করলে যে পুরসভা কোনও বরাদ্দ আনতে পারবে না, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন গৌতমবাবু। অতএব, অশোকবাবু বৈঠকের পরে ঘোষণা করেছেন, কলকাতায় যে দফতরেই তিনি চিঠি পাঠান না কেন, তা গৌতমবাবুকে জানিয়ে দেবেন। যাতে গৌতমবাবু পুরসভার আর্জি মঞ্জুরের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারেন। এ ছাড়া, পুরভবন তৈরি, পাট্টা বিলি, নয়া বিল্ডিং আইন, ভূগর্ভস্থ নিকাশি তৈরির জন্য সাহায্য চান মেয়র। মন্ত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করার আশ্বাস দিয়েছেন।
কেমন হল অশোকবাবুর সঙ্গে আপনার বৈঠক? গৌতমবাবুর বক্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী উন্নয়নের সঙ্গে রাজনীতি গুলিয়ে ফেলার পক্ষপাতী নন। সে পথে হেঁটে যা করার করেছি। তা ছাড়া উনি (অশোকবাবু) আমার অচেনা নন। আমাকে আগেও তুমি করেই বলতেন। এখনও বলেছেন। শিলিগুড়ির স্বার্থে ওঁর ডাকে সাড়া দিয়ে হেঁটেছি।’’
আর অশোকবাবুর কথায়, ‘‘ভোটের কথা ভোটের সময়ে হবে। এটা বলতে পারি, গৌতমের সঙ্গে আমার বহু দিনের পরিচয়। অনেক দিন দেখা হয়নি। তাতে কী! যোগাযোগ তো থাকেই। এটাই শিলিগুড়ির সংস্কৃতি।’’
বৈঠকের শেষে অশোকবাবুকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন গৌতমবাবু। গাড়িতে ওঠার আগে গৌতমবাবুর পিঠ চাপড়ে দিলেন অশোকবাবু।
ঠিক যেন সেই পুরনো দিনের মতোই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy