ছবির পোস্টারে গৌতম কুণ্ডুর সেই লিমুজিন গাড়ি
‘আশ্চর্য প্রদীপ’ ছবির সেই দুধসাদা লিমুজিনটা মনে আছে তো! ছয় দরজার যে পেল্লায় গাড়িটাকে কলকাতার অপরিসর গলিতে ছবির নায়ক অনিলাভর দোরগোড়ায় হাজির করেছিল প্রদীপের দৈত্য। ‘দৈত্য’ রজতাভ দত্তের সঙ্গে যে গাড়িতে চড়ে মেজাজে কলকাতা চক্কর দিয়েছিলেন ‘অনিলাভ’ শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়।
সেই গাড়ির আসল মালিকের নাম গৌতম কুণ্ডু। হ্যাঁ, রোজ ভ্যালি কর্ণধারই প্রযোজনা করেছিলেন ‘আশ্চর্য প্রদীপ’। আর সেই ছবিরই বিশেষ আকর্ষণ ছিল ওই গাড়ি। কলকাতার রাস্তায় এমন গাড়ি আর কি দেখেছে কেউ!
শুধু ওই বিলাসবহুল লিমুজিন নয়, পাঁচ কোটির একটা রোলস রয়েসও আছে গৌতমের। আছে মার্সিডিজ-বেন্জ। সেই সঙ্গে সারি দিয়ে ছোট-বড়, দেশি-বিদেশি বেশ কিছু চারচাকা তাঁর গাড়িশালে মজুত।
চরম বিলাসিতার এই স্তরে কী ভাবে নিজেকে নিয়ে গেলেন ৪৬ বছরের গৌতম? গল্পটা চমকপ্রদ। রহস্য, থানা-পুলিশ, রূপকথা সবই মজুত। শুনলে মনে হবে, পর্দার অনিলাভ নয়, সত্যিকারের আশ্চর্য প্রদীপটা পেয়েছিলেন গৌতমই!
আদপে তিনি বারাসতের ছেলে। আদি বাড়ি সেখানেই। বারাসতের একটি সিনেমা হলের মালিকানা ছিল গৌতমের পরিবারের। বাবা ছিলেন চিকিত্সক। পেশাগত কারণে তিনি চলে যান শিলং-এ। সেখানেই গৌতমের জন্ম-পড়াশোনা। ক্রমশ স্নাতক স্তরে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা, ফিনান্সে এমবিএ।
এ হেন গৌতমের স্বপ্নের উড়ান শুরু যে রোজ ভ্যালিতে সওয়ার হয়ে, তার জন্ম আসলে গৌতমের প্রয়াত দাদা কাজল কুণ্ডুর হাতে। ‘রোজ ভ্যালি’ নামটাও কাজলের দেওয়া। ১৯৯৫-৯৬ সালে বারাসত ও আগরতলায় রাষ্ট্রায়ত্ত জীবন বিমা সংস্থার এজেন্টের কাজ করতেন কাজল। পরে বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাঙ্কের হয়েও জীবন বিমার এজেন্সি নেন। তাঁর অধীনে কাজ করতে শুরু করেন আরও অনেক এজেন্ট। ক্রমশ ফুলেফেঁপে ওঠেন কাজল। তিনিই প্রথম শুরু করেন ‘রোজ ভ্যালি রিসর্ট অ্যান্ড প্ল্যান্টেশন’ নামে একটি সংস্থা। উঠতি ব্যবসায়ী কাজলের সঙ্গে মাখামাখি শুরু হয় রাজনীতিবিদদের। শোনা যায়, ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন কাজল।
রোজ ভ্যালির পদস্থ কর্তারা জানিয়েছেন, ১৯৯৯ সালে দাদার ব্যবসায় যোগ দেন গৌতম। শিলং থেকে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। সবই ঠিকঠাক চলছিল, এমন সময়ে ২০০৩ সালের ২২ নভেম্বর শিলং-এর কাছে বরাপানিতে দুর্ঘটনায় মারা যান কাজল, তাঁর স্ত্রী ও ছেলে। আগরতলা থেকে গুয়াহাটি যাওয়ার সময়ে পাহাড়ি রাস্তা থেকে গড়িয়ে তাঁদের গাড়ি পড়ে যায় নদীতে। আশ্চর্য ভাবে গাড়িচালক ছিলেন অক্ষত। পরে সেই চালককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের অভিযোগে চার্জশিট পেশ হয়। কিন্তু জামিন পাওয়ার পরেই সেই চালক পালিয়ে যান বলে পুলিশ সূত্রের খবর। আর তাঁর খোঁজ মেলেনি।
দাদার আকস্মিক মৃত্যুর পরেই রোজ ভ্যালির রাশ হাতে পান গৌতম। লাফিয়ে বাড়তে থাকে ব্যবসা। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, ‘রোজ ভ্যালি রিয়েল এস্টেট কন্সট্রাকশন’ মূলত গৌতমেরই মস্তিষ্কপ্রসূত। জমি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে শুরু হয় টাকা তোলা। ঠিক এই ধরনের ব্যবসা করেই সারদার সুদীপ্ত সেন বহু মানুষকে প্রতারণা করেছেন বলে অভিযোগ। দশ বছর ধরে ওই ব্যবসার নাম করে বাজার থেকে টাকা তুলে গিয়েছে রোজ ভ্যালি।
তবে ২০১০ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারের কাছ থেকে বড়সড় ধাক্কা খায় রোজ ভ্যালি। ওই সময়েই রোজ ভ্যালি, সারদা, প্রয়াগ এবং আইকোর সংস্থাগুলি নিয়ে তদন্ত চালিয়ে সবিস্তার রিপোর্ট দেন কলকাতা পুলিশের তত্কালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেন এবং রাজ্য সরকারের অর্থ দফতরের অধীন ইকনমিক অফেন্স সেলের প্রধান নারায়ণ ঘোষ। সেই তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০১০ সালের ২৩ এপ্রিল চারটি সংস্থার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিতে সেবি-র কাছে সুপারিশ করে রাজ্য সরকার।
ইডি সূত্রের খবর, এই ধাক্কার পরেই রোজ ভ্যালি রিয়েল এস্টেট কন্সট্রাকশনের ব্যবসা বন্ধ করে দেন গৌতম। তবে একই সঙ্গে রোজ ভ্যালির ছাতার তলায় অন্যান্য ব্যবসাও শুরু করেন। যার মধ্যে রয়েছে ছবি প্রযোজনা। গৌতমের প্রযোজিত চারটি ছবি জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছে। এক পরিচালকের কথায়, “অন্য ব্যবসায়ী-প্রযোজকদের মতো রদ্দি বাংলা ছবি প্রযোজনা করতেন না গৌতমবাবু। তিনি বেছে বেছে ছবি করতেন। নিজে স্ক্রিপ্ট শুনতেন। অন্য অনেক প্রযোজক যেমন ছবির বিভিন্ন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন, গৌতমবাবু তা করতেন না।”
ছবি প্রযোজনার পাশাপাশি শুরু হয় হোটেল ও রিসর্ট ব্যবসা। এই ব্যবসা মূলত পশ্চিমবঙ্গেই বাড়াচ্ছিলেন গৌতম। মন্দারমণির সমুদ্র সৈকতে তাঁর একটি হোটেলের আইনি বৈধতা নিয়ে এক সময়ে প্রশ্নও ওঠে। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। ইডি-র অভিযোগ, হোটেলের ব্যবসা দেখিয়েই শুরু হয় রোজ ভ্যালির ‘টাইম শেয়ার’-এর ব্যবসা। বিষয়টা কী রকম? তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পে আমানতকারীদের বলা হয়েছিল, শেয়ার কিনলে পরবর্তী কালে সংস্থার হোটেল-রিসর্টে থাকার সুযোগ মিলবে।
সব শেষে গৌতম খুলেছিলেন তাঁর ‘ব্র্যান্ড ভ্যালু কমিউনিকেশন’ সংস্থাটি। এই সংস্থার ছাতার তলায় শুরু হয় বাংলা, ওড়িয়া এবং অসমিয়া সংবাদ চ্যানেল। একটি বাংলা বিনোদন চ্যানেল এবং একটি বাংলা সঙ্গীত চ্যানেলও শুরু করে ওই সংস্থা। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হয় একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র। ইডি ও সিবিআই অফিসারদের মতে, নিজের সংবাদমাধ্যম নিয়ে সাম্প্রতিক অতীতে যে ভাবে খোলাখুলি রাজ্যের শাসক দলের হয়ে প্রচারে নেমেছিলেন গৌতম, তাতে তাঁর সঙ্গে দলের নেতানেত্রীদের যোগাযোগের বিষয়টি অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উল্লেখযোগ্য, সারদার সংবাদমাধ্যমকে ঠিক একই কাজে নামানো হয়েছিল বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এক সময়ে যে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা সুদীপ্ত সেনের কাছ থেকে নিয়মিত টাকা নিয়ে গিয়েছেন বলে অভিযোগ, গত কয়েক বছর ধরে তাঁদেরই ‘নেক-নজরে’ ছিলেন গৌতম। এমনকী ডেলোতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি যে বৈঠক করেছিলেন, তা-ও খোলাখুলি স্বীকার করেছেন গৌতম। সেই বৈঠকে সুদীপ্তও ছিলেন বলে অভিযোগ।
ক্রমশ সারদা কেলেঙ্কারি ধরা পড়েছে। সুদীপ্ত সেন জেলে যাওয়ায় তাঁর ব্যবসা লাটে উঠেছে। কিন্তু ইডি সূত্রের বক্তব্য, শাসক দলের একাংশ গৌতমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে গিয়েছেন। তদন্তকারীদের মতে, এঁরা ভালই জানতেন, সুদীপ্ত সেন শেষ হয়ে গেলেও গৌতম কুণ্ডু ফুরিয়ে যাননি। কারণ বাজার থেকে রোজ ভ্যালি যে পরিমাণ টাকা তুলেছিল, সেটা সারদার প্রায় ছ’গুণ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy