এ বার তাগিদ বদলা নেওয়ার। পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে অপদস্থ হওয়ার শোধ তুলতে জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এ রাজ্যে প্রশিক্ষিত হানাদার-দল পাঠিয়েছে বলে জানতে পেরেছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা। তাঁদের অনুমান, ওই জিহাদি-জঙ্গিরা এখানে নাশকতা চালিয়ে প্রাণহানি ও আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করবে।
খাগড়াগড়-বিস্ফোরণের তদন্তের জেরে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে জেএমবি-র জিহাদি-নেটওয়ার্ক কার্যত বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। সংগঠনের বেশ কিছু চাঁই ধরাও পড়েছে। আর এর প্রতিশোধ নিতেই জেএমবি নেতৃত্ব সাত-দশ জন প্রশিক্ষিত জঙ্গির একটি দলকে রাজ্যে নাশকতা চালাতে পাঠিয়েছে বলে জানতে পেরেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মন্ত্রকের দাবি, ওই জঙ্গিরা বাংলাদেশে জেএমবি-র শিবিরে পুরোদস্তুর তালিমপ্রাপ্ত। উপরন্তু ‘স্পেশ্যাল ট্রেনিং’ নিতে ডিসেম্বরে তাদের সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছিল। সেখানে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গি-নেতাদের কাছ থেকে তারা বিশেষ নির্দেশও পেয়েছে।
এবং নয়াদিল্লির খবর, সৌদি আরব থেকে ফের বাংলাদেশ ঘুরে দলটি এখন পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বাংলাদেশ সফরে, তখনই এ হেন তথ্য পেয়ে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো-র অফিসারেরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন।
আইবি-র আশঙ্কা, ওই প্রশিক্ষিত জঙ্গিরা অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গে নাশকতার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে। আবার খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্তে নিয়োজিত এনআইএ-র অফিসারদের উপরেও হামলা চালাতে পারে, তাঁদের মনোবল ভাঙার উদ্দেশ্যে। জেএমবি’র সেই হানাদার-বাহিনীর হদিস পেতে গোয়েন্দারা এই মুহূর্তে মরিয়া।
আর এমনই প্রেক্ষাপটে আজ, শনিবার ‘একুশে’-র ভাষা উৎসবের আয়োজন হতে চলেছে বাংলাদেশ জুড়ে, যে উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তৃণমূলনেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকা গিয়েছেন। ঘটনা হল, বাংলাদেশের জামাতে ইসলামির মতো কট্টরপন্থী দল ও জেএমবি-র মতো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সঙ্গে তৃণমূল নেতৃত্বের একাংশের দহরম-মহরমের অভিযোগ মাথা চাড়া দিয়েছে, যা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। বর্ধমানের খাগড়াগড়ে যে বাড়ির দোতলায় গত ২ অক্টোবরের বিস্ফোরণে দু’জনের মৃত্যু হয়, তার একতলায় ছিল তৃণমূলের নির্বাচনী কার্যালয়। ঘটনায় ধৃত একাধিক ব্যক্তির এ-ও দাবি, তৃণমূলের স্থানীয় কিছু নেতা জানতেন যে, ওখানে জেএমবি-র বোমা-বিস্ফোরক তৈরির গবেষণাগার তথা কারখানা চলছে।
আইবি-সূত্রের খবর, খাগড়াগড়ের সেই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার শোধ তুলতে জেএমবি এখন লস্কর-ই-তইবা (এলইটি) এবং ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর মতো সন্ত্রাস-সংগঠনের মদত নিচ্ছে। “আমাদের কাছে যা খবর, জেএমবি-র সদস্যেরা সৌদিতে আইএম-এলইটি’র চাঁইদের সঙ্গে দেখা করেছে। ওখানে গা ঢাকা দিয়ে থাকা লোকই পশ্চিমবঙ্গে নাশকতা-অভিযানের ছক চূড়ান্ত করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছে। অপারেশনের খরচের দিকটাও তারা দেখছে” জানাচ্ছেন এক আইবি-কর্তা।
প্রসঙ্গত, খাগড়াগড়-কাণ্ডের তদন্ত যে জঙ্গি-নেটওয়াকের্র হদিস দিয়েছে, সেটি আল-কায়দারই শাখা হিসেবে ভারত-বাংলাদেশ-মায়ানমারে সক্রিয় ছিল বলে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের একাংশ জানতে পেরেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই সাত-দশ জন প্রশিক্ষিত জেএমবি জঙ্গি এ রাজ্যে কী ধরনের নাশকতা ঘটাতে পারে?
আইবি-র ব্যাখ্যা: জনবহুল জায়গায় দেশি গ্রেনেড ফাটানো জেএমবি-র কাছে জলভাত। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য হামলার রেকর্ড তাদের ঝুলিতে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সন্দেহ, প্রথমে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা, পরে বর্ধমানের খাগড়াগড়ে জেএমবি-র বোমা কারখানায় যত আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) তৈরি হয়েছিল, তার ভগ্নাংশ এ পর্যন্ত উদ্ধার করা গিয়েছে। ওখানে তৈরি সব বোমা-গ্রেনেড বাংলাদেশে পাঠানো হয়, তা-ও নয়। এমতাবস্থায় আইবি’র ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ-সীমান্তবর্তী হরেক জেলার বিভিন্ন গোপন ডেরায় সেগুলো লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে পশ্চিমবঙ্গে নাশকতা ঘটানোর উপকরণ এ রাজ্যেই মিলবে।
পাশাপাশি এনআইএ-র তদন্তকারীরাও জিহাদি আক্রমণের ‘টার্গেট’ হতে পারেন বলে আইবি’র আশঙ্কা। বস্তুত গত নভেম্বরে সল্টলেকে এনআইএ-র অস্থায়ী অফিসের সামনে রহস্যজনক বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে আশঙ্কা জোরদার হয়েছে। সেই রহস্যের জট আজও খোলেনি। রাজ্য পুলিশের একাংশ অবশ্য ঘটনাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেন?
এই মহলের তত্ত্ব: যে হেতু ঘটনাস্থলে কোনও তার-ব্যাটারি-ডিটোনেটর মেলেনি, তাই ওটা আদপে ‘বিস্ফোরণ’ ছিল না। যদিও বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, খাগড়াগড়ে জেএমবি-ডেরায় লেড অ্যাজাইড নামে এমন একটি জিনিস পাওয়া গিয়েছে, যার সাহায্যে ডিটোনেটর ছাড়া বিস্ফোরণ ঘটানো অসম্ভব কিছু নয়।
অর্থাৎ বিস্ফোরণের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। আবার সল্টলেকের ওই ঘটনার কিছু ক’দিন পরে গোখেল রোড পুলিশ আবাসনে এনআইএ-র এক ইন্সপেক্টরের বাড়িতে পাথর ছোড়ার অভিযোগ জমা পড়েছে ভবানীপুর থানায়। তারও কোনও কিনারা হয়নি।
সব মিলিয়ে বদলার হানাদারি নিয়ে তাই যথেষ্ট আশঙ্কায় রয়েছে গোয়েন্দা মহল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy